লেখাপড়ার খরচ জোগাতে গিয়ে আর কোনো শিক্ষার্থী যেন আত্মহত্যা না করে
পরীক্ষার ফি দিতে না পারায় রংপুরের পীরগাছায় মাহফুজুর রহমান নামে অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। খবরটি মর্মান্তিক। স্তব্ধ করে দেয়ার মতো। শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। একবিংশ শতাব্দীর সিকিভাগ পার হওয়ার পর কেন এরকম এক কষ্টকর খবর আমাদের পত্রিকায় পাতায় পড়তে হবে? তাহলে আমাদের এত শিক্ষাদীক্ষা, উন্নয়নের অর্থ কী? মাহফুজের আত্মহত্যা আমাদের পুরো সভ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, রোববার (৮ ডিসেম্বর) দুপুরে এ ঘটনাটি ঘটে। সোমবার সকালে পুলিশ ওই শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়েছে। এ ঘটনায় আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারী আমির আলী ও সহকারী শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন শিক্ষার্থীর বাবা।
পুলিশ, নিহতের স্বজন ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে , ওই স্কুলের চলমান অষ্টম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় মাহফুজুর রহমান পরীক্ষার ফি ছাড়াই পাঁচটি বিষয়ের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। রোববার সকালেও সে গণিত বিষয়ের পরীক্ষায় ফি ছাড়াই অংশগ্রহণ করতে যায়। যথা নিয়মে মাহফুজুর রহমান সকাল ১০টায় সহপাঠীদের সঙ্গে পরীক্ষায় অংশ নেয়। এ সময় পরীক্ষার ফি না দেয়ার অভিযোগে মাহফুজুর রহমানকে পরীক্ষা চলাকালীন অবস্থায় শ্রেণিকক্ষ থেকে বের করে দেয়া হয়।
এরপরে অফিস সহকারী আমীর হোসেন প্রধান শিক্ষকের কক্ষে নিয়ে যান মাহফুজুর রহমানকে। সেখানে সহকারী শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম ও আব্দুল হান্নান পরীক্ষার ফি না দেয়া এবং অষ্টম শ্রেণির নিবন্ধন না করায় মাহফুজুর রহমানকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন। এ অপমান সইতে না পেয়ে মাহফুজুর রহমান ওই দিন নিজ বাড়িতে এসে শোবার ঘরের আড়ার সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে।
আমরা ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানাই। ঘটনাটি যদি সত্য হয়, তাহলে অবশ্যই অপরাধীর উপযুক্ত শাস্তি চাই। এ ধরনের ঘটনা এবারই প্রথম নয়। এর আগেও চাঁদপুর বাগাদি গণি উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সাথী আক্তার মাত্র ৮০ টাকার জন্য আত্মহত্যা করেছিল। এরকম আরও অনেক ঘটনা হয়তো রয়ে যায় অজানা, খবরের কাগজে সেসব হয়তো প্রকাশিত হয় না।
নিয়মিত স্কুলের বেতন, পরীক্ষার ফি না দিতে পারার বেদনা অনেক শিক্ষার্থীর জীবনেই আছে। তার সঙ্গে আছে অপমানের অভিজ্ঞতা। এর কারণ আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীবান্ধব নয়। শিক্ষা প্রচারের চেয়ে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাণিজ্যপ্রসারে আগ্রহী বেশি।
তা ছাড়া আমাদের শিক্ষা খাতে বরাদ্দও খুব কম। উপবৃত্তির পরিমাণও কম। অনেক শিক্ষার্থীই আসেন দরিদ্র পরিবার থেকে। সরকারি কিছু স্কুলে তারা হয়তো কম বেতনে পড়তে পারে; কিন্তু সেখানে শিক্ষার মান খুব খারাপ। বেসরকারি স্কুলগুলো একটু ভালো শিক্ষার নামে মোটা অঙ্কের বেতন দাবি করে। অনেকের পক্ষেই তা সংকুলান করা সম্ভব হয় না।
মাহফুজুর রহমান আমাদের শুধু কষ্টই দিয়ে যায়নি, লজ্জাও দিয়ে গেছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ভঙ্গুরদশা, অমানবিকতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছে। যে স্কুলে শিশুরা যায় মানুষ হতে, সেখানে যদি সামান্য বেতনের জন্য তাকে লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হয়, এই লজ্জা আমাদের সবার। আমরা চাই শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিটি মানুষের বোধোদয় হোক। এমন আর কোনো কিশোর-কিশোরী যেন বেতন দিতে না পেরে, পরীক্ষার ফি না দিতে পেরে, অপমানিত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে না নেয়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে