পুলিশ সপ্তাহ পালনে নেই দৃশ্যমান প্রস্তুতি
প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের শুরুতে পুলিশ সপ্তাহ পালিত হলেও, এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো প্রস্তুতি নজরে পড়েনি। সাধারণত ডিসেম্বরেই পুলিশ সপ্তাহ পালনের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়; কিন্তু এবার ২ জানুয়ারি পার হয়ে গেলেও এ ব্যাপারে জানা যাচ্ছে না কিছুই, ফলে আয়োজনটি নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
সাধারণত পুলিশ সপ্তাহ পালনের মাধ্যমে পুলিশ বিভাগের কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাজের মূল্যায়ন করা হয়। পুলিশ বিভাগের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়ন এবং তাদের কাজের সাফল্য-ব্যর্থতার মূল্যায়ন করাই এই আয়োজনের লক্ষ্য। পুলিশের দক্ষতা এবং কাজের মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে সদস্যদের পদকে ভূষিত করা হয়।
২০২৪ সালের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পুলিশের ৩৫ সদস্যকে বিপিএম ও ৬০ জনকে পিপিএম পদক দেওয়া হয়। আর গুরুত্বপূর্ণ মামলার রহস্য উদ্ঘাটন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, দক্ষতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, সততা ও শৃঙ্খলামূলক আচরণের জন্য ৮৫ জনকে বিপিএম-সেবা, ২১০ জনকে পিপিএম-সেবা পদক দেয়া হয়। ২০২১ থেকে ২০২৩- এই তিন বছর বিপিএম ও পিপিএম পদক দেয়া হয় ১৫টি করে। ২০১৯ সালে এই পদকের সংখ্যা ছিল ১১৮টি। এ ছাড়া ২০১৭ সালে ১৮২, ২০১৬ সালে ১৩২, ২০১৫ সালে ১০২, ২০১৪ সালে ৮৬, ২০১৩ সালে ২০ এবং ২০১২ সালে ৪০ জন পুলিশ সদস্যকে এই পদক দেয়া হয়।
পুলিশের একটি সূত্রে জানা যায়, এ বছর পদক না দেয়ার ঘোষণা আসতে পারে। এমনকি পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এই আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়ে কিছুই জানা যায়নি।
এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগরের সঙ্গে কথা হলে তিনি ভিউজ বাংলাদেশকে জানান, ‘পুলিশ সপ্তাহ পালন নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেটা এখনো বলা যাচ্ছে না।’
পুলিশ সপ্তাহ পালনকে কেন্দ্র করে প্রতি বছরই বিভাগের সদস্যরা সরকার এবং কর্তৃপক্ষের সামনে নিজেদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন। এ বছর সে রকম কোনো দাবি তোলা হবে কিনা সে বিষয়েও কিছুই জানা যায়নি।
মিরপুর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ মাকছেদুর রহমান ও মতিঝিল বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. শাহরিয়ার আলীর কাছে পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে তাদের প্রত্যাশা জানতে চাইলে তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন।
তবে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে আর্থিক লেনদেনে বদলি, পদোন্নতি ও নানা ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনায় সমালোচিত হয়েছে পুলিশ বাহিনী। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে নির্বিচারে অস্ত্র ব্যবহারের কারণে তাদের প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট হয়েছে, বেড়েছে ক্ষোভ। এ অবস্থায়, তারা বাহিনীর সংস্কারের ওপর জোর দিচ্ছে, একইসঙ্গে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়ে চাচ্ছে কার্যকর পদক্ষেপ। গণ অভ্যুত্থানের সময় নিজেদের বাহিনীর সদস্যদের হত্যা তাদের একধরনের ভীতিকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে বলে জানান তারা।
পুলিশ সদর দপ্তরের বরাত দিয়ে পাঠানো এক বার্তায় নিহত পুলিশের সংখ্যা ৪৪ জন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পরে এখন পর্যন্ত ১৮৭ জন পুলিশ সদস্য কর্মক্ষেত্রে যোগদান করেনি।
এদিকে, আন্দোলনে গুলি করে মানুষ হত্যার অভিযোগে এখন পর্যন্ত ৯৫২ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন থানা ও আদালতে এসব মামলা হয়। ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন ২৮ পুলিশ সদস্য। আসামির তালিকায় ছয়জন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক, সাবেক ৩৬ অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক, ৫ জন অতিরিক্ত আইজিপি, সাবেক ও বর্তমান বেশ কয়েকজন ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি, পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, সহকারী পুলিশ সুপার, পরিদর্শক, উপপরিদর্শক, কনস্টেবল ছাড়াও বিভিন্ন পদ-পদবির সদস্য রয়েছেন।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই আয়োজন বাধাগ্রস্ত হওয়াকে খুব বড় করে দেখছেন না অপরাধবিদরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক এবিএম নাজমুস সাকিব এ ব্যাপারে ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘৫ আগস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে পুলিশ বাহিনী একধরনের বিধ্বস্ত অবস্থায় রয়েছে। তাদের কাঠামোর যে ভারসাম্য অতীতে ছিল তা বর্তমানে নেই। পুলিশ এখনো তাদের আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়নি। এই পরিস্থিতিতে এ বছর পুলিশ সপ্তাহ পালন না হলেও সেটা অস্বাভাবিক কিছু না।’
তিনি বলেন, ‘এই অবস্থায়, পুলিশের মনোবল তৈরি করার ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে ও তাদের কাজের স্বীকৃতি প্রদানের গুরুত্বকেও অস্বীকার করা যাবে না।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে