পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার ২০২৪ পাওয়ার পর প্রথম প্রতিক্রিয়া
আমাদের ঠিক ধারণা নেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে কী হতে চলেছে
নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পর পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে নোবেল কমিটি থেকে ফোন করা হয়। এর মাধ্যমে জানা যায় পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তির প্রথম প্রতিক্রিয়া। নোবেল কমিটির ওয়েবসাইট থেকে ২০২৪ সালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজয়ীদের সাক্ষাৎকারগুলো বাংলায় ভাষান্তরসহ প্রকাশিত হচ্ছে ‘ভিউজ বাংলাদেশ’-এর পাঠকদের উদ্দেশে। আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী জন জোশেফ হোপফিল্ডের সঙ্গে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার-২০২৪ অর্জন করেছেন ব্রিটিশ-কানাডিন কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও কগনেটিভ সাইকোলজিস্ট জিওফ্রে হিন্টন। আজ প্রকাশিত হলো জিওফ্রে হিন্টনের সাক্ষাৎকার।
পদার্থবিজ্ঞানে ২০২৪ নোবেল পুরস্কার বিজয়ী জিওফ্রে হিন্টন ক্যালিফোর্নিয়ার হোটেল রুম থেকে স্টকহোমের নোবেল কমিটির ফোন ধরেন খুব ভোরবেলা। সুইডিশ উচ্চারণ বুঝতে তার সময় লাগে, কয়েকবার বলার পর তিনি বোঝেন পদার্থবিজ্ঞানে তার নোবেল পুরস্কার পাওয়ার খবরটা সত্যি। ধারণকৃত এই সাক্ষাৎকারে তিনি কথা বলেছেন মেশিন লানিংয়ের অবস্থা নিয়ে, গবেষণার নিরাপত্তা নিয়ে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে মানুষের যে ভয়, তিনি মনে করেন এই পুরস্কারটি কৃত্রিম বুদ্ধিমতার ভয়কে আরও গুরুত্ব সহকারে দেখতে শেখাবে।
জিওফ্রে হিন্টন: হ্যালো?
এডাম স্মিথ: হ্যালো, আমি কি জিওফ্রে হিন্টনের সঙ্গে কথা বলছি?
জিওফ্রে হিন্টন: হ্যাঁ।
এডাম স্মিথ: নোবেল প্রাইজ কমিটি থেকে এডাম স্মিথ বলছি।
জিওফ্রে হিন্টন: জি, বলুন। আমি জানি আপনি কে। অনেক আগে থেকেই আমি জানি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর প্রথম প্রতিক্রিয়া জানার জন্য ফোন কর হয়।
এডাম স্মিথ: ঠিক তাই। আমি আপনার সঙ্গে কয়েক মিনিট কথা বলতে পারি?
জিওফ্রে হিন্টন: জি, বলুন।
এডাম স্মিথ: অনেক ধন্যবাদ। প্রথমে অবশ্যই অনেক অভিনন্দন।
জিওফ্রে হিন্টন: অনেক ধন্যবাদ।
এডাম স্মিথ: আজ আপনি কোথায়? কোথায় বসে খবরটি শুনলেন?
জিওফ্রে হিন্টন: ক্যালিফোর্নিয়ার একটি গরিবি হোটেলে আছি। এতই কমদামি হোটেল যে, এদের ইন্টারনেট সংযোগও নেই। ভালো ফোন লাইনও নেই। আজ আমার একটা এমআরআই স্ক্যান করার কথা। মনে হয় বাদ দিতে হবে। পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়ে যাব, তা তো আর ভাবিনি। সত্যিই আমি বিস্মিত।
এডাম স্মিথ: আচ্ছা, খুবই স্পর্শকাতর জায়গা এমন একটি খবর শোনার জন্য। কারণ আপনি বোধহয় কিছুটা একা এখন। তবে আজ সারা দিন ধরে আপনার ওপর দিয়ে যে ঝড় যাবে, তার জন্য হয়তো এই মুহূর্তটুকু আপনার দরকার, নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার জন্য।
জিওফ্রে হিন্টন: হ্যাঁ, এখন মাত্র বেলা ২টা বাজে এখানে।
এডাম স্মিথ: ও খোদা, আমি খুবই দুঃখিত। হায়, আমি বুঝতে পারিনি আপনি…
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পথপ্রদর্শক জিওফ্রে হিন্টন ২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর কানাডার টরন্টো শহরে রয়টার্স ফাইন্যান্সিয়াল অ্যান্ড রিস্ক সামিটে কথা বলেন। (রয়টার্স ফটো)
জিওফ্রে হিন্টন: আমি ভেবেছিলাম, ৩টা হয়তো বাজে।
এডাম স্মিথ: আমি জানি না বিছানায় যাওয়ার মতো আর উত্তাপ পাবেন কি না, নাকি সারা দিনের দীর্ঘ অভিনন্দন বার্তার জন্য প্রস্তুতি নেবেন।
জিওফ্রে হিন্টন: মনে হয় না আর বিছানায় যাওয়ার মতো অবস্থা থাকবে।
এডাম স্মিথ: যাক, ভালো, বিস্ময়ের ধ্বনি আপনার কণ্ঠস্বরে। তো আপনার প্রথম চিন্তা কী ছিল খবরটি শোনার পর?
জিওফ্রে হিন্টন: আমার প্রথম চিন্তা ছিল কীভাবে আমি নিশ্চিত হব এটা কোনো ফেক কল কি না।
এডাম স্মিথ: তারপর কীভাবে নিশ্চিত হলেন যে এটা ফেক কল না?
জিওফ্রে হিন্টন: কলটা এসেছিল সুইডেন থেকে। আর যিনি কথা বলছিলেন তিনি কথা বলছিলেন সুইডিশ উচ্চারণে। কয়েকটি সুইডিশ উচ্চারণ একদম বুঝতে পারিনি।
এডাম স্মিথ: বুঝতে সময় লেগেছে তাহলে?
জিওফ্রে হিন্টন: হ্যাঁ, কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে বটে।
এডাম স্মিথ: কীভাবে নিজেকে বর্ণনা করবেন আপনি? নিজেকে কি কম্পিউটার বিজ্ঞানী বলবেন? না কি বলবেন আপনি একজন পদার্থবিজ্ঞানী, এই কাজ করার সময় রসায়ন বুঝতে চেয়েছেন?
জিওফ্রে হিন্টন: নিজের সম্পর্কে আমি বলতে পছন্দ করব যে, জানে না যে কোন বিষয়ের লোক সে; কিন্তু জানতে চায় মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে। মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে এটা বুঝতে আমি এমন এক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে কাজ করছি, যা খুব দারুণ কাজ করছে।
এডাম স্মিথ: এটা উল্লেখ্য, প্রযুক্তি কী অঘটনা ঘটাতে পারে এই নিয়ে আপনি জনসম্মুখে ভয় ধরিয়েছেন। আপনি এবং আপনার মতো অন্যরা প্রযুক্তি নিয়ে যে ভয়ের কথা বলছেন, তা দূর করার জন্য এখন কী করা দরকার বলে আপনি মনে করেন?
জিওফ্রে হিন্টন: জলবায়ু পরিবর্তনের চেয়ে এটা ভিন্নরকম বলে আমার মনে হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে সবাই জানেন কী করতে হবে। আমাদের কার্বন পোড়ানো বন্ধ করতে হবে। এর জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার। বড় কোম্পানিগুলো অধিক লাভের আশায় এটা করতে চায় না; কিন্তু কী করতে হবে এটা পরিষ্কার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তারে ক্ষেত্রে আমাদের ঠিক ধারণা নেই কী হতে চলেছে আর আমাদেরই-বা কী করতে হবে।
আমার ভালো লাগতো যদি আমার হাতে সাধারণ এক তরিকা থাকত যে, এই করলেই সব ঠিক থাকবে; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমার সেরকম কিছু জানা নেই। এই জিনিসগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। মানুষের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি আমরা এখন এমন এক দিখণ্ডি বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে দাঁড়িয়ে আমাদের খুঁজতে হবে সেই হুমকি মোকাবিলার কোনো উপায় আছে কি না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করব এটা নিয়ে ভাবা, কাজ করা আমাদের সবার জন্যই এখন গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য আমাদের প্রচুর গবেষণা করতে হবে। আমার মনে হয় সরকার একটা জিনিস করতে পারে, নিরাপত্তা গবেষণার জন্য বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থ সংস্থান করতে উৎসাহী করতে পারে। যাতে ওপেনএআই-এর মতো কোম্পানিগুলো যেমন মন চাইলেই কিছু গবেষণা করল, এমন যেন না হয়।
এডাম স্মিথ: আপনি জানেন, অ্যাসিলোমার কনফারেন্সে বায়োটেকনোলজিরা যখন একত্রিত হয়েছিলেন, তারাও এমন কিছু কথা বলেছিলেন যে, এখানে বিপদের আশঙ্কা আছে এবং আমাদের এ নিয়ে কাজ করা দরকার। আপনার কথার সঙ্গে কি বায়োটেকনোলজি বিপ্লবের কোনো মিল আছে?
জিওফ্রে হিন্টন: হ্যাঁ, বায়োটেকনোলজির সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মিল রয়েছে। তারা যা করেছেন ভালো করেছেন। ক্লোনিংয়ের মতো যে বিষয়গুলো জীববিজ্ঞানীরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছেন দুর্ভাগ্যবশত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে তা রাখা সম্ভব হয়নি। তাই আমি মনে করি, এটা নিয়ন্ত্রণ এখন আরও কঠিন হয়ে পড়েছে; কিন্তু আমি মনে করি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বালোলজিস্টদের মডেল অনুসরণ করা ভালো। এট ভালো যে জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি চুক্তি অর্জন সম্ভব হয়েছিল, এবং বিজ্ঞানীরই তা করেছিলেন।
এডাম স্মিথ: তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সংকটটি কম লোকই আসলে বুঝতে পারছেন? এ ক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিতে কি এই নিয়ে মানুষের সচেতনতা বাড়বে বলে মনে করেন?
জিওফ্রে হিন্টন: কিছুটা বাড়বে বলে মনে করি। আমি মনে করি এখন মানুষ আমার কথা আরও গুরুত্ব দিয়ে শুনবেন। আমার কথাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করবেন।
এডাম স্মিথ: আপনার কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনে না বলে কি আপনি উদ্বিগ্ন?
জিওফ্রে হিন্টন: অনেক ভাষাবিদ, যারা চমস্কির ভাষাবিজ্ঞান স্কুলের অনুসারী, তারা মনে করেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভাষাগত ব্যাপারটা তারা বুঝতে পেরেছেন। তারা মনে করেন মানুষ যেভাবে ভাষা শিখে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভাষাগত দক্ষতার ব্যাপারটা ওরকম না। আমি মনে করি, তারা সম্পূর্ণ ভুল। চমস্কির ভাষাবিজ্ঞানের স্কুলে উৎপাদিত যে কোনো কিছুর চেয়ে নিউরাল নেটগুলোর ভাষা-প্রক্রিয়াকরণে অনেক ভালো। তবে এটি নিয়ে এখনো অনেক বিতর্ক রয়েছে, বিশেষ করে ভাষাবিদদের মধ্যে।
এডাম স্মিথ: আপনার বর্তমান অবস্থায় ফিরে আসতে চাইছিলাম। এই মধ্যরাতে হোটেলে আপনার সঙ্গে আর কে আছে? নির্জন এক জায়গায় এমন একটি খবর শুনে কাউকে জড়িয়ে ধরার মতো কেউ তো আছে আশপাশে, বা উদযাপন করার মতো?
জিওফ্রে হিন্টন: হ্যাঁ, আমার পার্টনার আছে আমার সঙ্গে। আর সে খুবই উত্তেজিত।
এডাম স্মিথ: যাক, ভালো। রাখছি এখনকার মতো। আবারও অনেক অভিনন্দন।
জিওফ্রে হিন্টন: ধন্যবাদ। ঠিক আছে।
এডাম স্মিথ: বাই।
সূত্র: নোবেল প্রাইজ ডটওআরজি
অনুবাদ: কামরুল আহসান।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে