এ মুহূর্তে দেশে নেই শেখ মুজিব ও জিয়া পরিবারের কেউই
বাংলাদেশ বর্তমানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিভিন্ন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। তার সঙ্গে দেশ ছেড়েছেন ছোটবোন শেখ রেহানা। এরপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের ক্ষমতা গ্রহণ করলেও কমেনি রাজনৈতিক এবং সামাজিক অস্থিরতা। এরই মধ্যে বিএনপি দ্রুততম সময়ে নির্বাচন দাবি করছে। এদিকে, সরকারের দিক থেকে বারবারই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের ওপর। এ অবস্থায়, দেশে ‘বিরাজনীতিকরণের’ চেষ্টা হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে অনেকেই আশঙ্কা করছেন। গত নভেম্বরের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ‘মাইনাস-২ ফর্মুলা’র বিষয়ে সরকারকে সতর্ক করার পর বিষয়টি নিয়ে দলটির ভেতরে ও বাইরে নানা ধরনের আলোচনা শুরু হয়। এই জল্পনাকল্পনার মধ্যেই গতকাল মঙ্গলবার চিকিৎসার উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়ার দেশত্যাগের পর এ মুহূর্তে দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতাশালী দুই পরিবারের- মুজিব এবং জিয়া- কেউই নেই। শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর খালেদা জিয়ার দেশত্যাগ দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে আরও জটিল করে তুলতে পারে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, একই সময়ে দুই পরিবারের সবাই দেশের বাইরে অবস্থান এমন কোনো রেকর্ড অতীতে নেই।
শেখ মুজিব পরিবারের সদস্যদের বর্তমান অবস্থান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুই কন্যা- শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানার- পাঁচ পুত্রকন্যা। এখন তাদের মধ্যে কেউই বাংলাদেশে নেই।
শেখ হাসিনা: শেখ হাসিনা ওয়াজেদ (জন্ম: ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭) বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও রাজনীতিবিদ, যিনি ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল এবং পরবর্তীতে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বিশ বছরেরও বেশি সময় সম্মিলিতভাবে দায়িত্ব পালন করার ফলে, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে দায়িত্ব পালনকারী প্রধানমন্ত্রী। ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলন এবং অসহযোগ আন্দোলনের ফলে ঘটিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশ ত্যাগের মধ্য দিয়ে তার দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনকালের অবসান ঘটে। যদিও তিনি পদত্যাগ করেছেন কিনা না এ নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়েছে। শেখ হাসিনাকে ট্রাভেল ডকুমেন্ট দিয়েছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এখন ভারতে অবস্থান করছেন তিনি।
শেখ রেহানা: বড় বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে বর্তমানে তার অবস্থানের বিষয়টি পরিষ্কার নয়। শেখ রেহানার ব্রিটিশ পাসপোর্টও রয়েছে। তাই তিনি বড় বোনের সঙ্গে ভারতে আছেন, নাকি অন্য কোথাও চলে গেছেন- এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।
সজীব ওয়াজেদ জয়: সজীব আহমেদ ওয়াজেদ জয় শেখ হাসিনা ও পরমাণু বিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়া দম্পতির প্রথম সন্তান। তিনি একাদশ জাতীয় সংসদ ২০১৯ থেকে নভেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবৈতনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন।
সায়মা ওয়াজেদ পুতুল: সায়মা ওয়াজেদ পুতুল একজন প্রখ্যাত অটিজম বিশেষজ্ঞ। তিনি বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া ও শেখ হাসিনা দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান। অটিজম ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক। বর্তমানে তিনি ১ নভেম্বর ২০২৩ সাল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। শেখ হাসিনার মেয়ে হলেও তিনি সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। বর্তমান তিনি কর্মক্ষেত্রের সুবাদে ভারতের দিল্লিতে অবস্থান করছেন।
রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি: শেখ রেহানার ছেলে রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সরাসরি জড়িত নন। তবে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণায় নেপথ্যে থেকে ভূমিকা পালন করেছেন ববি। সিআরআইয়ের মাধ্যমে তিনি অনলাইনভিত্তিক প্রচারণায় ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাজ্যে রয়েছেন।
টিউলিপ সিদ্দিক: শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক ব্রিটিশ লেবার পার্টি এবং কো-অপারেটিভ পার্টির রাজনীতিবিদ। তিনি ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে লন্ডনের হ্যামস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসন থেকে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এর পূর্বে তিনি রিজেন্ট পার্কের কাউন্সিলর এবং ২০১০ সালে ক্যামডেন কাউন্সিলের কালচার অ্যান্ড কমিউনিটির সদস্য ছিলেন। তিনি ৯ জুলাই ২০২৪ সাল থেকে ট্রেজারির অর্থনৈতিক সেক্রেটারি এবং সিটি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন।
আজমিনা সিদ্দিক: শেখ রেহানার ছোট মেয়ে ও টিউলিপ সিদ্দিকের ছোট বোন আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীও এ মুহূর্তে বাংলাদেশে নেই।
বিস্তৃত শেখ পরিবারের সদস্যরা: শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই শেখ ফজলুল করিম সেলিম আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। তার দুই ছেলে শেখ ফজলে ফাহিম ও শেখ ফজলে নাইম। ফাহিম ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি ছিলেন। ৫ আগস্টের পর থেকে শেখ সেলিমের পরিবার আত্মগোপনে আছে। শেখ পরিবারের ঘনিষ্ঠ সূত্র দাবি করছে, শেখ সেলিম এখনো দেশেই আছেন। তবে এই তথ্যের সত্যতার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
শেখ সেলিমের ভাই শেখ ফজলুল হক মনির দুই সন্তান শেখ ফজলে শামস পরশ ও শেখ ফজলে নূর তাপস। ৫ আগস্টের পর থেকে তাদের খোঁজ নেই। শেখ তাপস ঢাকার সাবেক এমপি ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র। সরকার পতনের দুই দিন আগে সিঙ্গাপুর যান তিনি। শেখ পরশও দেশ ছেড়েছেন বলে জানা যায়।
শেখ সেলিমের ছোট ভাই শেখ ফজলুর রহমান মারুফ ক্যাসিনো বিতর্কের সময় আলোচনায় এসেছিলেন। তিনি বর্তমানে সিঙ্গাপুরে আছেন বলে জানা গেছে। তার ভগ্নিপতি যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীও আত্মগোপনে আছেন।
শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ বরিশাল-১ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। তার ছেলে সাদিক আব্দুল্লাহ ছিলেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র। ৫ আগস্টের পর হাসনাত আব্দুল্লাহ ও ছোট ছেলে সুকান্ত আব্দুল্লাহ দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান বলে জানা গেছে। তবে সাদিক আব্দুল্লাহ কোথায় আছেন- এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তার ছোট ভাই আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র। তিনি কোথায় আছেন তা জানা যাচ্ছে না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ভাই শেখ আবু নাসেরের পাঁচ ছেলে। তাদের মধ্যে দুজন শেখ হেলাল উদ্দিন ও শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল গত সংসদেও সদস্য ছিলেন। আবার শেখ হেলালের ছেলে শেখ তন্ময়ও গত দুই সংসদের সদস্য ছিলেন। হেলাল ও তন্ময় বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন।
হেলালের আরেক ভাই শেখ জুয়েল। ৫ আগস্টের পর জুয়েল দেশে ছিলেন। তবে তাদের আরও তিন ভাই শেখ সোহেল, শেখ রুবেল ও শেখ বেলাল এখন কোথায় আছেন তা কেউ জানে না। শেখ হাসিনার ফুফাতো বোন শেখ ফাতেমা বেগমের এক ছেলে নূর-ই আলম চৌধুরী (লিটন চৌধুরী) একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ ছিলেন। আরেক ছেলে মুজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন চৌধুরী) ফরিদপুর-৪ আসন থেকে টানা তিনবারের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ৫ আগস্টের পর থেকে এই দুই ভাইও আত্মগোপনে আছেন।
জিয়া পরিবারের সদস্যদের বর্তমান অবস্থান
বাংলাদেশের অষ্টম রাষ্ট্রপতি এবং প্রাক্তন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের পরিবারের সদস্যা হলেন স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, বড় ছেলে তারেক রহমান, তারেকের স্ত্রী ড. জোবাইদা রহমান এবং তাদের সন্তান জাইমা রহমান, জিয়াউর রহমানের ছোট ছেলে আরাফাত রহমানের স্ত্রী শর্মিলা রহমান এবং তাদের দুই সন্তান জাহিয়া রহমান, জাফিয়া রহমান।
বেগম খালেদা জিয়া: সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া উন্নত চিকিৎসার জন্য ৭ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছেন।
তারেক রহমান: বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘদিন ধরে লন্ডনে অবস্থান করছেন। মায়ের আগমনের পর তিনি স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমান ও কন্যা ব্যারিস্টার জাইমা রহমানসহ বিমানবন্দরে মাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন।
জাইমা রহমান: তারেক রহমান এবং জোবাইদা রহমান দম্পতির একমাত্র কন্যা জাইমা রহমান বর্তমানে লন্ডনে রয়েছেন।
সৈয়দা শর্মিলা রহমান সিঁথি: খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শর্মিলা রহমান সিঁথি বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করছেন। তিনি খালেদা জিয়ার সঙ্গে লন্ডনে গেছেন।
জাহিয়া রহমান ও জাফিয়া রহমান: আরাফাত রহমান কোকোর দুই কন্যা জাহিয়া রহমান ও জাফিয়া রহমান লন্ডনে বসবাস করছেন।
রাজনীতির শূন্যস্থান
শেখ মুজিব পরিবার এবং জিয়া পরিবার বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুইটি প্রধান শক্তি। শেখ হাসিনা সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বর্তমান আওয়ামী লীগের সভাপতি আর খালেদা জিয়া বিএনপি চেয়ারপারসন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী, তিনিও দীর্ঘদিন ধরে দেশের রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। তবে, ৫ আগস্ট ২০২৪ সালে শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে দেশত্যাগ করে বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হয়। কার্যত বর্তমান দেশের রাজনীতি থেকে দূরের রয়েছে স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেয়া দল আওয়ামী লীগ।
বর্তমানে দেশে ক্ষমতায় রয়েছেন ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারে তাদের প্রচেষ্টা নানা বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সরকারকে অবশ্যই নিরপেক্ষতা বজায় রেখে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ তৈরি করতে হবে।
২০০৬ সালে ফখরুদ্দিন-মঈন উদ্দিনের নেতৃত্বে ১/১১ সরকার একটি নতুন দিক নির্দেশনা দেওয়ার চেষ্টা করে। তারা ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা চালু করতে চেয়েছিল, যা শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে বাদ দেওয়ার একটি পরিকল্পনা ছিল। তবে, এই প্রচেষ্টা পুরোপুরি সফল হয়নি এবং দুই নেত্রী পরবর্তীতে রাজনীতিতে ফিরে আসেন।
যদি কোনো কারণে দীর্ঘসময় এই দুই পরিবারের সদস্যরা দেশের রাজনীতি এবং দেশ থেকে দূরে থাকেন কিংবা তাদের অনুপস্থিতি দেশের রাজনীতিতে একটি বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি করতে পারে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই শূন্যতা নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য একটি সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু একই সঙ্গে এটি অস্থিতিশীলতার ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে। অনেকে আরও বলেছেন, দুই পরিবারের অনুপস্থিতিতে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা দেশের গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘমেয়াদে হুমকির কারণ হতে পারে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে