মানবিক করিডোর নয়, রাখাইনে সহায়তা পাঠাতে ‘কৌশলগত অপেক্ষা’য় ঢাকা
রাখাইন রাজ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত ও মানবিক বিপর্যয়ের প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারে ত্রাণ পাঠানোর প্রস্তাবে সদুত্তর দিয়েছে বাংলাদেশ। যদিও ‘মানবিক করিডোর’ শব্দটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তবু সীমান্ত ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক সহায়তা পৌঁছাতে সরকারের অবস্থান এখন ‘সতর্ক ইতিবাচকতা’ মধ্যে সীমাবদ্ধ।
ঢাকার পররাষ্ট্র কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ সরাসরি কোনো করিডোর খুলছে না; বরং এটি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে রাখাইনে সহায়তা পাঠানোর একটি “সহযোগিতামূলক প্রক্রিয়া” হিসেবে দেখছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সিনিয়র কর্মকর্তা ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা করিডোর বলছি না- এটা রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর শব্দ। আমাদের মূল লক্ষ্য, নির্দিষ্ট শর্তে, সীমান্ত ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের কাছে সহায়তা পৌঁছানো।’
সরকার জানিয়েছে, সহায়তা পাঠানোর আগে তিনটি মূল শর্ত পূরণ জরুরি: রাখাইনে কার্যকর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, জাতিসংঘ বা নিরপেক্ষ সংস্থার তত্ত্বাবধানে ত্রাণ বিতরণ এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা বিবেচনায় রাখার নিশ্চয়তা।
জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিষয়ক বিভাগ বলেছে, সীমান্ত অতিক্রম করে সাহায্য পাঠানোর জন্য দুই দেশের সম্মতি বাধ্যতামূলক। ঢাকা এ বিষয়ে উন্মুক্ত থাকলেও, মিয়ানমারের পক্ষ থেকে এখনো স্পষ্ট সংকেত মেলেনি।
বিএনপি এই পদক্ষেপকে দেশের জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকি আখ্যা দিয়ে বলেছে, ‘জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া এমন কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না।’ দলের মহাসচিব আরও বলেন, ‘এটি সীমান্তকে আরও জটিল করে তুলতে পারে এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।’
কক্সবাজার, টেকনাফ, উখিয়া- এই অঞ্চলগুলোতে সহায়তা পৌঁছানোর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে উদ্বেগ বিরাজ করছে। এক স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বলেন, ‘রাখাইন থেকে আরও শরণার্থী ঢুকে পড়লে পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এর সঙ্গে নিরাপত্তা ও পরিবেশগত চাপ বাড়বে।’
রোহিঙ্গা নেতারা জাতিসংঘের কাছে একটি আন্তর্জাতিক ‘সেইফ জোন’ তৈরির আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘ত্রাণ চাই; কিন্তু সম্মান ও নিরাপত্তা ছাড়া নয়। শুধুমাত্র খাবার দিলে সমস্যার সমাধান হবে না।’
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ‘মানবিক করিডোর’ দেয়া নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে আলোচনা চলছে, সেটিকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান। তিনি বলেছেন, ‘অনেকে বলছেন, করিডোর বিষয়ে সরকার কথা বলছে না কেন? অস্তিত্বহীন জিনিস নিয়ে কী আলোচনা করব?’
এ বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দিয়ে খলিলুর রহমান বলেন, ‘মানবিক করিডোর হচ্ছে একটা জরুরি সময়ে দুর্যোগপূর্ণ জায়গা থেকে মানুষকে সরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা। এখানে কাউকে সরানো হচ্ছে না। যেটা করা হচ্ছে তাতে এখানে ত্রাণসামগ্রী ও উপকরণ অন্য রুটে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। জাতিসংঘ আমাদের এতটুকু বলেছে, পণ্যটি বাংলাদেশের সীমান্ত দিয়ে রাখাইনে নেয়ার জন্য।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাখাইনে সহায়তা পাঠানোর এই প্রক্রিয়া একটি মানবিক প্রয়াস হলেও এর ভেতরে রয়েছে কৌশলগত ও রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান, চীন-ভারতের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং মিয়ানমারের অন্তর্দ্বন্দ্ব- সব মিলিয়ে এটি এখন একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর ইস্যু।
সরকারের ইচ্ছা ও মানবিক দায়িত্বের বিষয়টি যেমন প্রশংসনীয়, তেমনি স্পষ্ট কৌশল ছাড়া এই ধরনের উদ্যোগ ভবিষ্যতে নানা বিপর্যয়ের দ্বার খুলতে পারে।
সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার আগে স্থানীয় জনগণের উদ্বেগ, রাজনৈতিক ঐকমত্য, আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং বাস্তবায়নের সক্ষমতা- সবগুলো বিষয়ের সমন্বয় জরুরি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে