বিনিয়োগে আমাদের জন্য খুব ভালো খবর নেই
আসছে বাজেট। আগামী অর্থবছরের আয়-ব্যয়-ইজা বা সার্বিক অর্থনীতির পরিকল্পনার জন্য ব্যাংক, বিনিয়োগ, পুঁজিবাজার, রাজস্ব খাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান অর্থনীতির সূচকগুলো বাজেটের জন্য কতটা সহযোগী হবে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যনীতির প্রভাব এবং বিনিয়োগ টানতে কর পরিকল্পনা কীভাবে সহায়ক হতে পারে সেসব বিষয় নিয়ে ভিউজ বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি সেলিয়া সুলতানার সঙ্গে আলাপ করেছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম মাসরুর রিয়াজ।
ভিউজ বাংলাদেশ: আমরা দেখছি রেমিট্যান্স প্রবাহ ভালো, রিজার্ভ ইতিবাচকভাবে বাড়ছে, কারেন্ট ও ট্রেড অ্যাকাউন্টসে ব্যালেন্সও সহায়তা করছে; কিন্তু একইভাবে বিনিয়োগে পিছিয়ে। সব মিলে অর্থনীতির সূচকগুলো এই মুহূর্তে কতটা বাজেট সহযোগী হচ্ছে সরকারের জন্য?
এম মাসরুর রিয়াজ: দেখুন, গত দশ মাসে ইন্টেরিম গভর্মেন্ট দায়িত্ব নেয়ার পর বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। কোনো গোষ্ঠীকে মাথায় রেখে ব্যাংকিং, বিনিয়োগ, জ্বালানি বা শিল্পে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে না যা খাতগুলো বা অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক। ব্যবস্থাপনায় এই গভর্নেন্স ফেরত আসা একটি ভালো দিক। আরেকটি বিষয় হলো সময়ের দাবিতে অনেক সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন ছিল যা পূর্বে নেয়া হয়নি। সেগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নেয়া হয়েছে। ফলে যে সূচকগুলো আছে সেগুলোতে অনেকক্ষেত্রেই উন্নতির দিকে আছে। তার মধ্যে একটি হলো ব্যালেন্স অব পেমেন্ট। জুলাই পর্যন্ত ব্যালেন্স অব পেমেন্টের যে পতন ছিল সেটি রোধ হয়েছে, ফলে রিজার্ভ ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ও ট্রেড অ্যাকাউন্টের ঘাটতি কমে এসেছে, এক্সপোর্ট ও রেমিট্যান্স এই ব্যালেন্স তৈরিতে সহায়তা করেছে। এক্সপোর্টের ভালো হওয়ার কারণ গত বছর থেকে নর্থ আমেরিকার বাজারে ইতিবাচক চাহিদা দেখা যাচ্ছে। সামনে নিতে পারব কি না সেটি নির্ভর করছে ট্রাম্প ট্যারিফকে আমরা কীভাবে সমাধান করব। ৯০ দিন পর ট্রাম্প ট্যারিফকে আমরা একটি স্থায়ী সমাধানে আনতে পারব কি না। আরেকটি হলো পোশাক খাতে যে জ্বালানি সমস্যা চলছে সেটি আমরা কীভাবে সমাধান করব। তা না হলে আমাদের আউটপুট ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রেমিট্যান্স একটি ভালো ধারায় আছে মূল কারণ হলো টাকা পাচার কমে গেছে, সরকার কড়া অবস্থার কারণে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। ফলে ভালো সূচক আমরা দেখছি।
ভিউজ বাংলাদেশ: বিনিয়োগের বাজারের সঙ্গে কর্মসংস্থানের জড়িত, অনেক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সামনের বছর বিনিয়োগ সূচকে কতটা আশাবাদী হতে পারি আমরা?
এম মাসরুর রিয়াজ: বিনিয়োগে আমাদের জন্য খুব ভালো খবর নেই। কয়েকদিন আগেই বিদেশি বিনিয়োগের ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম কোয়ার্টারের প্রতিবেদন দিয়েছে, যেখানে ৭০%-৭১% কমেছে বিনিয়োগ। সে সময় জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের আন্দোলন ছিল তবুও আমরা আশা করব এখান যেহেতু ভোট না হলেও জনসমর্থন নিয়ে একটি সরকার আছে। গভর্নেন্স বা নীতিনির্ভর পরিবেশ সৃষ্টি করছে। ফলে বিনিয়োগ বাড়ার কথা। আমাদের অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত যে পরিস্থিতি তা দেখতে হবে। সেখানেও যদি ধারাবাহিক পতন ঘটে তা হবে উদ্বেগের।
ভিউজ বাংলাদেশ: সামনের বছর ট্রাম্প ট্যারিফসহ বিভিন্ন দেশের যে নীতিগুলো আরোপ হচ্ছে তা কি আমাদের ভাবাবে?
এম মাসরুর রিয়াজ: বাংলাদেশের বিনিয়োগে অনেক দুর্বলতা আছে দীর্ঘদিন ধরে। বিনিয়োগকারী, অবকাঠামো তার সঙ্গে বিনিয়োগকারীরা যে অভিযোগ করেন তা হলো রাজস্ব খাতে (ট্যাক্স, ভ্যাট, কাস্টমস) অনেক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। যদিও গত কয়েক বছরে ব্যক্তিগত ট্যাক্সের হার কিছুটা কমানো হয়েছে তবে বিভিন্ন ধরনের ট্যাক্স যোগ করা হয় তা এখনো অনেক বেশি। ট্যাক্স কমপ্লায়েন্সে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। ট্যাক্স কর্মকর্তাদের ঐচ্ছিক ক্ষমতার কারণে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। তবে গত কয়েক মাসে আশ্চর্যজনকভাবে এনবিআর অনেকগুলো সংস্কার করেছে। কথায় কথায় অডিটের যে নিয়ম সেটি স্থগিত রাখা হয়েছে। বাণিজ্য সহজ করতে “অথরাইজড ইকোনমিক অপারেটর” আওতা বাড়ানো হয়েছে। ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডোর কাজ চলছে। এগুলো ভালো উদ্যোগ কিন্তু সার্বিক যে করনীতি সেটি শুধুমাত্র রাজস্ব আহরণনির্ভর। এটি প্রয়োজন আছে, তবে একই সঙ্গে বিনিয়োগবান্ধব উপাদান থাকতে হবে। তবে তা নতুন যে সম্ভাবনা আসছে সেগুলোকে মাথায় রেখে।
ভিউজ বাংলাদেশ: কীভাবে?
এম মাসরুর রিয়াজ: বাজারকে যদি আরও শক্তিশালী করতে চাই তাহলে লজিস্টিকসের মাধ্যমে লোকাল ও গ্লোবাল প্রতিযোগিতা বাড়ানো, ব্যবসা-বাণিজ্যে খরচ কমিয়ে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সেখানে আমি কর ছাড়ের কিছু অংশ ডাইভার্ট করতে পারি এবং চলমান রাখতে পারি। সেজন্য এটাকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আলোকে ব্যালেন্স করতে হবে। যারা পেয়ে এসেছে তাদের আরও পাওয়ার যৌক্তিকতা আছে কিনা সেটি দ্রুত এনালাইসিস করে পরিকল্পনা করতে হবে। অথবা একটি সময় বেঁধে দিতে হবে যেন সুযোগগুলো অন্যরা পেতে পারেন।
ভিউজ বাংলাদেশ: বিনিয়োগকারীরা চাইছেন, কর বা রাজস্ব বাড়ানো বা কমানো সংসদের হাতে না দিয়ে এনবিআরের হাতে থাকা জরুরি। এখন অনেক সংস্কার চলছে, আপনি বলছেন গভর্নেন্স ফেরত আসছে তাহলে এই চর্চার শুরু কতটা ফল দেবে বলে আপনি মনে করেন?
এম মাসরুর রিয়াজ: কিছু বিষয় সংসদের হাতে থাকবে এটাই স্বাভাবিক, অর্থনীতির বিল বা সংশোধন; কিন্তু যেসব বিষয়ের দ্রুত সমাধান প্রয়োজন সেসব বিষয় সংসদে দ্রুত সমাধান হয়ে ওঠে না। কারণ অনেক নিয়মকানুন আছে। সেক্ষেত্রে বাস্তবায়নকারী সংস্থার হাতে বা রেগুলেটরি বডির হাতে কিছু ক্ষমতা থাকতে পারে। তবে দেখতে হবে। বড় বিষয়গুলো সংসদে যাক; কিন্তু কিছু ছোট ছোট বিষয় সমাধানে বা সিদ্ধান্তে রেগুলেটরির সেইফ গার্ড থাকতে পারে। আলোচনার মেজার থাকতে পারে। পাবলিক প্রাইভেট কমিটি থাকতে পারে। আলোচনার ভিত্তিতে রিকমেন্ডেশন যেতে পারে কমিটি থেকে যা বোর্ড পর্যায়ে অনুমোদন আসতে পারে।
ভিউজ বাংলাদেশ: গত কয়েক বছরের বাজেট ও মুদ্রানীতিতে আমরা মূল্যস্ফীতিকে সামল দেয়ার চেষ্টা করছি। ব্যাংকে ঋণের সুদ বৃদ্ধি বিনিয়োগে অনীহার কারণও বলছেন অনেকে। এবার বাজেটের আকার কমানো হচ্ছে, মূল্যস্ফীতির ঘর কতটা স্বস্তি ফিরবে বলে মনে হয়?
এম মাসরুর রিয়াজ: মুদ্রানীতি এখনো রক্ষণশীল অবস্থানে আছে। এটি সঠিক পদক্ষেপ। বাৎসরিক পরিকল্পনার একটি বড় উপাদান। এমনভাবে করা যাবে না যে মূল্যস্ফীতি সামলানো আরও কঠিন করে দেবে। ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ ব্যালেন্স অব পেমেন্ট একটি স্বস্তির ধারায় আছে। বাজেটে এমন কিছু করা যাবে না যেটা অপ্রয়োজনীয় আমদানি চাহিদা বাড়িয়ে দেয়। তাই মুদ্রানীতির সঙ্গে বাজেটের সামঞ্জস্য থাকতে হবে।
ভিউজ বাংলাদেশ: আমাদের সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
এম মাসরুর রিয়াজ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে