ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক
শূন্য-সমষ্টি নয়, পারস্পরিক লাভজনক দৃষ্টিভঙ্গি হবে মূল
জানুয়ারির ৭ তারিখ বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের দৌড় অনেক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট পক্ষের জন্য রাজনৈতিকভাবে স্নায়ুবিনাশী ছিল। এর কারণ পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছিল, দেশের জাতীয় নির্বাচন দৃশ্যত বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক রাজনীতির জন্য একটি জীবন-মরণ বাজির প্রতিযোগিতা হয়ে উঠেছে। হয়তো বাজিটি এত চড়া নয়, তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে একটি প্রতিযোগিতার ব্যাপার যে আছে, সেটা বাস্তব এবং তা বেশ কিছু সময় ধরে চলছে। প্রতিযোগিতার বিষয়টিকে চীনের বিআরআই মোকাবিলায় ভারতের বাফার রাষ্ট্র-সংক্রান্ত অগ্রাধিকার; চীনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি রাশিয়াকে বিশ্বব্যাপী বিচ্ছিন্ন করায় যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অগ্রাধিকারগুলো যে প্রেক্ষাপট থেকেই দেখা হোক না কেন, মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে রাশিয়ার অবকাঠামোগত স্বার্থ রয়েছে এবং সম্প্রতি তারা বাংলাদেশের পক্ষে প্রকাশ্য রাজনৈতিক সমর্থনকারী হয়ে উঠেছে। অনেকের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা বা উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে কর্তৃত্ববাদ, একচ্ছত্র শাসন এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমনের অভিযোগ। এসবের ভেতর দিয়েই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছেন।
নতুন সরকার এবং তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের নিজ নিজ দায়িত্ব গ্রহণের পর উত্তেজনা এখন কমে আসায় পশ্চিমারা বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে কাজের সম্পর্ক বজায় রাখার দিকে মন দিয়েছে। এটি নির্বাচন-পরবর্তী বিবৃতিগুলো থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়। নতুন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি পশ্চিমারা ধীরেসুস্থে ও ভেবেচিন্তে নিজেদের অবস্থান ঠিক করলেও আওয়ামী লীগ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ মিত্ররা এই শাসনের ধারাবাহিকতাকে বিপুলভাবে অভিনন্দিত করেছে। এর একটি প্রধান ও বড়মাপের উদাহরণ হচ্ছে ভারত।
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে দেখা করেছেন এবং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন এবং শিগগিরই দিল্লি সফর করবেন বলে জানিয়েছেন। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনারের সঙ্গে বৈঠকটি হাছান মাহমুদ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর তার প্রথম কূটনৈতিক ব্যস্ততা হিসেবে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আরও জোরদার করতে ৭ ফেব্রুয়ারি ভারতের সঙ্গে তার দ্বিপক্ষীয় সফরের সিরিজ শুরু করবেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অথবা রাজনৈতিক মানসিকতায় ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ প্রভাব অনস্বীকার্য। উপরন্তু, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে দুই প্রতিবেশী দেশ যে পারস্পরিক উন্নত সম্পর্ক গড়ে তুলেছে এবং উপভোগ করেছে, তা অকাট্য। তাছাড়া, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সরকার ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ, বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রবেশাধিকারের বিষয়টি, দুদেশের মধ্যকার সংযোগ প্রকল্প এবং ভারতবিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে সমাধান করেছেন। ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ের বেশ কিছু বিশেষজ্ঞ এবং এমনকি অনেক ভারতীয় গণমাধ্যম বিশ্লেষকের মতে, ভারত এর বিনিময়ে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক বিপর্যয় উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ সরকারকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে।
যদিও কিছু সংবাদমাধ্যম, সীমান্তের দুপাশের কতিপয় বিশেষজ্ঞ সর্বশেষ মন্ত্রিসভায় ভারতপন্থি মুখের অভাব রয়েছে বলে প্রশ্ন তুলেছেন বা কটাক্ষ করেছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে হাছান মাহমুদ সবার আগে ভারত সফর এবং ভারত থেকে তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কার্যকাল শুরু করা স্পষ্টতই এর বিপরীত ইঙ্গিত দেয়।
২০২১-২২ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশ দিল্লির জন্য একটি আঞ্চলিক অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মিত্র কারণ ভারত বাংলাদেশকে তার আগে তাকানো ও ব্যবস্থা নেওয়ার নীতির জন্য একটি অপরিহার্য বাফার রাষ্ট্র বলে গণ্য করে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে জড়িত। এটি এমন একটি ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার, যা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রাধান্য নেই, এমন পরিস্থিতিতেও স্বীকার করতে হবে এবং তার প্রয়োজনও রয়েছে।
বাংলাদেশ যে একটি শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য অংশীদার হয়ে উঠেছে, তা প্রধানমন্ত্রী হাসিনার নেতৃত্বের একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক কার্যকরতা, কারণ ভারতবিরোধী মনোভাব তেজি অবস্থায় রয়েছে এবং এ ধরনের প্রবণতা কেবল বাংলাদেশেই নয়, এই অঞ্চলেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মালদ্বীপের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সম্প্রতি ‘ভারত ভাগো' স্লোগানে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। এটি এমন এক স্লোগান, যা স্পষ্টতই এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিরোধী দল বিএনপি গ্রহণ করেছে। বিএনপিপন্থি কর্মী, নেতা ও পৃষ্ঠপোষকদের সোশ্যাল মিডিয়া এ ধরনের বয়ান দিয়ে একটা ঝোঁক তৈরি করছে বলে জানা গেছে। কারও কারও কাছে এটি বিরোধীদের একটি মরিয়া পদক্ষেপ, অন্যদের জন্য বিষয়টি এমন জনবিতর্ক হতে পারে, যেখানে রাজনৈতিক বিরোধীরা শেষ পর্যন্ত নিজেদের পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পেয়েছে। বিষয়টি আদতে কী, শুধু সময়ই তা বলে দেবে। যাই হোক, মালদ্বীপের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে, দিল্লি এবং এই প্রবণতা অনুসরণকারীরা স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের নেতৃত্বে এমন এক মিত্র চাইবে, যার ওপর দিল্লি নির্ভর করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল বারবার এ নির্ভরতার ব্যাপারটি প্রমাণ করেছে। নিঃসন্দেহে হাছান মাহমুদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তার প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরের সময় ভারতের প্রতি একই প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করবেন।
অন্যান্য ভারতীয় উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে, ভারতের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অতিরিক্ত মাখামাখি। ভারত ও চীন উভয়ই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কূটনীতি এবং ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের মূল সাফল্য হচ্ছে এশিয়ার দুই বৃহৎ রাষ্ট্রের কাছ থেকে অংশীদারত্বের প্রত্যাশাগুলো পূরণ করা। তারা প্রকৃত বিষয়গুলোতে সংঘর্ষে লিপ্ত হোক বা না হোক, এসব প্রতিযোগিতামূলক স্বার্থ বজায় রাখতে তিনি পারদর্শী এবং অনুকরণীয় বিচক্ষণতা প্রদর্শন করেছেন।
২০২২ সালে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে চীনের সঙ্গে জোট বেঁধেছে; চীনের বিআরআইর অধীনে অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়তার ক্ষেত্রে বেইজিং সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। সুতরাং, চীনের সঙ্গে অংশীদারত্ব বাংলাদেশের জন্য, এক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে অংশীদারত্বের চেয়ে বেশি না হলেও, গুরুত্বপূর্ণ। যখনই বাংলাদেশের অভিমুখ নিয়ে উত্তেজনা চরমে উঠেছে তখনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই দুই আঞ্চলিক বৃহৎ শক্তিকে এই বাস্তবতা উপলব্ধি করাতে সক্ষম হয়েছেন।
ভারত ও চীনের প্রতি বাংলাদেশের সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গি শূন্য-সমষ্টির কৌশলগত বিষয়ে জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পারস্পরিক লাভজনক সম্পর্কের অগ্রাধিকার প্রতিফলিত করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ তার সফরের সময় এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পরবর্তী পাঁচ বছরের শাসনামলে যথাক্রমে ভারত ও চীন উভয়ের কাছেই দৃঢ়তার সঙ্গে এটি নিশ্চিত করবেন। দিল্লিকে উপলব্ধি করতে হবে যে, কৌশলগত এবং পারস্পরিক কল্যাণকর সম্পর্ক বজায় রাখা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি মূল নীতি। আওয়ামী লীগ শাসনের অধীনে বাংলাদেশ শূন্য-সমষ্টি কৌশলগত বিষয়ে জাতীয় স্বার্থের ওপর ভিত্তি করে ভূরাজনীতিতে মনোনিবেশ করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিক অংশীদারত্ব সামলানোয় বেশ পারদর্শী হয়েছেন এবং এটি এখন বাংলাদেশের শুধু বৈদেশিক নীতিই নয়, একটি কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের মতবাদ বজায় রাখার জন্য ভূ-রাজনৈতিক চর্চারও মূল বিষয়। ভারত ও চীন উভয়ই স্বস্তিতে থাকবে এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্ক কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই মসৃণভাবে এগিয়ে যাবে, যদি বেইজিং এবং দিল্লি উভয়ই বিষয়টি মনে রাখে। কারণ এটিই হবে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার মূল নীতি।
লেখক: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে