Views Bangladesh Logo

কঠোর কর্মসূচির দিকে ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা

Manik Miazee

মানিক মিয়াজী

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (বিসিএস) কর্মরত ২৫টি পেশাভিত্তিক ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রশাসন ক্যাডারের ‘একচেটিয়া’ আধিপত্য ও বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে রোববার (২ মার্চ) পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করেছেন। দাবি আদায় না হলে তারা আরও কঠোর আন্দোলনে যাবেন বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক ড. মুহম্মদ মফিজুর রহমান জানিয়েছেন, তারা মূলত তিনটি দাবি নিয়ে স্বোচ্চার। এগুলো হলো- ক্যাডার বৈষম্য দূরীকরণ, সব ক্যাডারের সমান মর্যাদা এবং সাম্প্রতিক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার।

তিনি বলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে আমরা অচলাবস্থাসহ সর্বাত্মক কর্মসূচিতে যাব।

কেন এই আন্দোলন?
গত কয়েক বছর ধরেই বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডার ও অন্যান্য পেশাভিত্তিক ক্যাডারগুলোর (যেমন: শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শুল্ক) মধ্যে ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধার বৈষম্য চরমে পৌঁছেছে। ২০২৩ সালে গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত রিপোর্টে এই বৈষম্যকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে বলেও অভিযোগ ওঠে। রিপোর্টে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারকে মূল প্রশাসনিক কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন করা, উপসচিব পদে কোটা পদ্ধতি জারি রাখা এবং প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ‘সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিসে’ বিশেষ সুবিধার প্রস্তাব করা হয়।

আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করে জানিয়েছেন, ‘ক্যাডার যার, মন্ত্রণালয় তার’ নীতির লঙ্ঘন হয়েছে। পেশাভিত্তিক ক্যাডারগুলোর নিজস্ব মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ নেই। যেমন কৃষি ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কৃষি মন্ত্রণালয়ে না রেখে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করা হয়।

পদোন্নতি ও কোটা ব্যবস্থায় বৈষম্য রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তারা। তাদের দাবি, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা দ্রুত পদোন্নতি পেলেও অন্যান্য ক্যাডারে তা হয় না।

ফেসবুকে বৈষম্যের প্রতিবাদ জানানোর অভিযোগে ২৫ ক্যাডারের ১৩ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।

কর্মবিরতির দিনের চিত্র
রোববার সকাল থেকেই রাজধানীর খামারবাড়ি, সচিবালয় সংলগ্ন দপ্তরগুলো এবং বিভাগীয় শহরগুলোর সরকারি অফিসে কর্মকর্তারা কালোব্যাজ পরে নীরব প্রতিবাদে অংশ নেন।

খামারবাড়ির প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সামনে এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমাদের কৃষি সম্প্রসারণের কাজে বাজেট কম, পদোন্নতি আটকে আছে। অথচ প্রশাসন ক্যাডারের লোকেরা সব সুবিধা ভোগ করছেন।

কর্মবিরতির প্রভাবে স্বাস্থ্য, কৃষি ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কিছু দপ্তরে ফাইল চলাচল ও সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। তবে জরুরি সেবা (হাসপাতাল, জরুরি ভেটেরিনারি সেবা) স্বাভাবিক ছিল বলে নিশ্চিত করা হয়।

সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট, কেন বিতর্ক?
আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক ড. মফিজুর রহমান শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনকে ‘প্রশাসনিক ফ্যাসিজমের দলিল’ আখ্যা দেন। তার মতে, রিপোর্টে উল্লেখিত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়িত হলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডার হবে দুর্বল। এগুলোকে ‘ক্যাডার বহির্ভূত’ করার মাধ্যমে মেধাবী প্রার্থীদের আকর্ষণ কমানো হচ্ছে।

গণিত বাদ দিয়ে মেধা যাচাইয়ে মুখস্থনির্ভর পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করে প্রকৃত মেধাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, জেলা পরিষদ বিলুপ্তিতে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে প্রশাসন ক্যাডারের হাতে কেন্দ্রীভূত করা হচ্ছে।

পরিষদের প্রস্তাব
সব ক্যাডারের জন্য পৃথক পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয় গঠন। উপসচিব পদে কোটা বাতিল করে মেধাভিত্তিক নিয়োগ। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন করে ‘মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়’ করা।

অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের একাত্মতা
আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন ২৫ ক্যাডারের প্রাক্তন কর্মকর্তারাও। গত শুক্রবার গঠিত বৈষম্যবিরোধী অবসরপ্রাপ্ত ২৫ ক্যাডার সমন্বয় পরিষদের সমন্বয়ক আহমেদ আলী চৌধুরী ইকবাল বলেন, আমরা জীবনের শেষ সময়ে দাঁড়িয়েও দেখছি, আমাদের উত্তরসূরিরা একই বৈষম্যের শিকার। প্রশাসন ক্যাডারের দাপটে রাষ্ট্রযন্ত্র এখন অকার্যকর।

এই পরিষদ রোববার খামারবাড়িতে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়ে মানববন্ধনের আয়োজন করে এবং কর্মরত সহকর্মীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে।

ফেসবুক পোস্টে বরখাস্ত: নতুন সংকট
মোংলা কাস্টম হাউসের কমিশনার এ কে এম মাহবুবুর রহমানের সাময়িক বরখাস্ত এই আন্দোলনে নতুন মাত্রা জুগিয়েছে। জানুয়ারিতে জাতীয় প্রতিরক্ষা কোর্স (এনডিসি) থেকে তার নাম বাদ পড়ায় তিনি ফেসবুকে একটি স্টাটাস দেন, যাতে প্রশাসন ক্যাডারের ‘নিরঙ্কুশ ক্ষমতা’ ও বৈষম্যের সমালোচনা করা হয়। ৩ ফেব্রুয়ারি তাকে ‘অসদাচরণ’-এর অভিযোগে বরখাস্ত করা হয়।

এই ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ব্যবহারকারীরা #StopCadreDiscrimination হ্যাশট্যাগে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেক কর্মকর্তা।

সরকারের নীরবতা ও ভবিষ্যৎ আন্দোলনের রূপরেখা
আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, সরকার এ পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে বলেছে, ‘ক্যাডার ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সব ইস্যু আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী সমাধান করা হবে।’

তবে পরিষদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী সপ্তাহে নেয়া হতে পারে কিছু কর্মসূচি। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- পর্যায়ক্রমে ধর্মঘট। এর মধ্যে থাকবে সপ্তাহে দুই দিন অফিস বর্জন। গণঅভিযান। এর মধ্যে থাকবে রাজধানী ও বিভাগীয় শহরে মানববন্ধন, র‌্যালি। আইনি লড়াই। এর অংশ হিসেবে উচ্চ আদালতে রিট আবেদনের মাধ্যমে বরখাস্তের আদেশ ও সংস্কার রিপোর্ট চ্যালেঞ্জ করা।

সংকট কেন গভীর হচ্ছে?
রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. এস এম আলী রেজা বলেন, বিসিএস কাঠামোয় বৈষম্য নতুন নয়। ব্রিটিশ আমলের ‘সিভিল সার্ভিস’ মডেলে প্রশাসন ক্যাডারকে ‘মেইন স্ট্রিম’ হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে, বাকিদের দেখানো হয়েছে ‘সেকেন্ড ক্লাস’ হিসেবে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই কাঠামো সংস্কার জরুরি।

তিনি বলেন, পেশাভিত্তিক ক্যাডারগুলোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো না হলে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাত পিছিয়ে পড়বে। সরকারকে অবশ্যই ক্যাডারগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে। ২৫ ক্যাডারের এই আন্দোলন বিষয়ে সরকার যদি দ্রুত সংলাপের মাধ্যমে সংকট নিরসনে এগিয়ে না আসে, তবে এই অচলাবস্থা জাতীয় উন্নয়নের গতিকে শ্লথ করবে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ