একটি মৃত্যু, অনেক প্রশ্ন
স্বাভাবিক মৃত্যুর বাইরেও দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু হয়। এটা নতুন কিছু নয়; কিন্তু সে দুর্ঘটনা যদি মানুষের অবহেলা, দায়িত্বজ্ঞানহীনের কারণে হয়, তাহলে সেটা হত্যাকাণ্ড, বা ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার হিসেবে বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন। দেশে এমন কিছু দুর্ঘটনা দেখা যায়, যা মনুষ্যসৃষ্ট। গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপালে যে মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, তা হত্যাকাণ্ডেরই শামিল।
গত ১২ মে (রোববার) এই হাসপাতালে ৫৩ বছর বয়সী মমতাজ বেগমকে লিফটে চড়িয়ে ১১ তলা থেকে ৪ তলার হৃদরোগ বিভাগে নেওয়া হচ্ছিল চিকিৎসকের পরামর্শে। রোগীর মেয়ে এবং অন্য আত্মীয় ছিলেন সঙ্গে; কিন্তু লিফটি ৯ তলার মাঝামাঝি আটকে যায়। রোগীর সঙ্গে থাকা আত্মীয়দেরও দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তারা লিফটম্যানকে ফোন করলে সেই লিফটম্যান তিন মিনিট পর আসে; কিন্তু ঘটনা দেখে সে চলে যায় এবং ৪৫ মিনিট পর ফিরে আসে। জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করা হয় এবং পুলিশ এসে তাদের উদ্ধার করে। পুলিশ আসার ঠিক এক-দুই মিনিট আগেই হৃদরোগের পেশেন্ট মমতা বেগম মারা যান।
শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি সরকারি, যেখানে দায়িত্ব পালনের কুখ্যাতি থাকে, থাকে ১০০ টাকার ক্রয় দুইশ বা পাঁচশ নয়, ১০ হাজার টাকায় কেনার অভিযোগ। এই অবহেলা, এই দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জবাব দেবে কে, লিফটম্যান, নাকি মেডিকেল কলেজ প্রশাসন, না কি মন্ত্রণালয়? খুঁজতে গেলে যে অনেককিছু পেঁচিয়ে যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
ওই লিফটে কোনো এসি অথবা ফ্যানের ব্যবস্থা ছিল না। জানা গেছে, ওই লিফটসহ একাধিক লিফটের ফ্যানগুলোও অকেজো হয়ে আছে। লিফট এমন একটি জিনিস যা শুধু একবার স্থাপন করলেই হয় না, এটির মেইনটেন্যান্স না করলে বিপত্তি অবধারিত। এ কথা নিশ্চয়ই কর্তপক্ষের কাছে অজানা নয়! কোনো লিফট সঠিকভাবে সার্ভিসিং করা হলে, নিয়মিত মেইনটেন্যান্স করা হলে তা শত বছরও চলতে পারে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে লাখ লাখ লিফট চলছে। এমনকি কোনো কোনো লিফটের বয়স প্রায় শত বছর। আধুনিক লিফটের পাশাপাশি পুরোনো আমলের কেচি গেটের লিফটও দেখা যায় বিভিন্ন প্রদেশে। অথচ সেগুলো দিব্যি চলছে। সেখানেও যে দুর্ঘটনা ঘটে না, তা নয়। তবে বাংলাদেশের অনুপাতে তা খুবই সামান্য।
শুধু লিফট নয়, গাজীপুরের হাসপাতালটিতে এমনকি ফ্যান, যা খালি চোখে দেখা যায় তাও অকেজো হয়ে আছে। একটি হাসপাতালে এভাবে ফ্যান নষ্ট হয়ে থাকে কী করে? লিফটের বহু ধরনের কোয়ালিটি আছে। বাংলাদেশে এখন পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশের লিফট আসে। একটি লিফট যেমন ১০ লাখ টাকায় পাওয়া যায়, তেমনি একই আকারের লিফট দেড় কোটি টাকায়ও পাওয়া যায়। কোনটা ক্রয় করবেন সেটা একান্তই ক্রেতার ইচ্ছা। এই লিফট ক্রয় নিয়ে বাংলাদেশে বহু অভিযোগ আছে। লিফট কিনতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের, বিভাগের কর্মকর্তারা বিভিন্ন দেশ সফর করে থাকেন। এমনকি সুদূর ইউক্রেন, ফিনল্যান্ডে সফর করে থাকেন। এমন অভিযোগ পত্র-পত্রিকায় আছে যে, লিফট কোম্পানির সঙ্গে যোগসাজশে নিম্নমানের লিফট কেনা হয়েছে অথবা দাম কয়েকগুণ বেশি দেখানো হয়েছে।
ওই হতভাগা নারীর মৃত্যু নিয়ে যদি সত্যিই কোনো তদন্ত হয়, তাহলে এটাও দেখা প্রয়োজন, কোন দেশের কোন কোম্পানির লিফট কত টাকায় ক্রয় করা হয়েছে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, সেখানেও একটি বড় ঘাপলা পাওয়া যাবে পর্দা কেলেঙ্কারির মতো। তবে তদন্ত জিনিসটা বহুকাল ধরে বাংলাদেশে একটি আইওয়াশ হয়ে আছে। তদন্তের প্রতি জনগণের আস্থা শূন্যের কোঠায়। সেটা স্যোসাল মিডিয়ায় বহু মন্তব্যে দেখা যায়।
গাজীপুরের এই হাসপাতালে সাংবাদিক প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না এবং দুর্ব্যবহার করা হয় বলে বেসরকারি ‘দেশ’ টেলিভিশনের গাজীপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন। হাসপাতাল একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। সেখানে সাংবাদিক প্রবেশ করতে না দেয়ার অভিযোগ গুরুতর। হাসপাতালে সাংবাদিক প্রবেশে কেন নিষেধাজ্ঞা, সেটাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। মমতাজ বেগমের মৃত্যুর তদন্ত ও যথাযথ বিচার হওয়া খুবই প্রয়োজন। দেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে এ ধরনের ঘটনার পূর্ণ তদন্ত অতি জরুরি। তা না হলে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।
লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে