চুকনগর গণহত্যা
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক দিনে সবচেয়ে বড় গণহত্যা
আজ ২০ মে, ঐতিহাসিক চুকনগর গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আজকের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চুকনগরের বিভিন্ন স্থানে গুলি করে কয়েক হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। বিশ্বের গণহত্যার ইতিহাসগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে, বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণহত্যাগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম।
বিশ্বের ইতিহাসে এর আগে এক দিনে একসাথে এত মানুষকে প্রাণ দিতে হয়নি কখনো। সেদিন সীমানা পাড়ি দিতে এসে চুকনগর এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিল ১২ হাজারের অধিক নিরীহ মানুষ। কিন্তু এদেশীয় দোসরদের সহায়তায় মাত্র ৩/৪ ঘণ্টার ব্যবধানে কমপক্ষে ১২ হাজার মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী। তবে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সেই গণহত্যার বিবরণ কতটুকু আছে তা আজ বিবেচ্য বিষয়।
খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার গুরুত্বপূর্ণ একটি বাজার চুকনগর। যশোর-খুলনা ও সাতীরা জেলার মিলনস্থলে অবস্থিত এই বাজারটি। এটি স্থানীয় ব্যবসা বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।
এই চুকনগর বাজারের অদূরেই রয়েছে পাতোখোলা বিল, বাদামতলার, বটতলা, রায়পাড়া। পাতোখোলা বিল, বাদামতলার, বটতলা, রায়পাড়ার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ভদ্র নদী। আজ এই নদী মৃত প্রায় হলেও সেই সময় এই ভদ্রা ছিল প্রমত্তা।
স্থানীয়রা জানান, ১৯৭১সালের ১৮ মে থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হাজার হাজার মানুষ নদীপথে, সড়কপথে চুকনগরের আশেপাশের এলাকায় জড়ো হতে থাকে। উদ্দেশ্য ভারতে পাড়ি জমানো। বৃহত্তর খুলনার বাগেরহাট, রামপাল, মোড়লগঞ্জ, কচুয়া, শরণখোলা, মংলা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, চালনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ি, গোপালগঞ্জসহ বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় ১ লাখ মানুষ চুকনগরসহ আশেপাশের কয়েকটি গ্রামে জড়ো হয়। ১৯ মে রাতের মধ্যে এসব আশ্রয়হীন মানুষ তাদের সহায় সম্বল নিয়ে চুকনগরের তাঁতীপাড়া, লোপাড়া, রায়পাড়া, মালতিয়া, পুটিমারি, পাতোখোলা বিল, বাজারের ভিতর, চুকনগর মন্দির, রোস্তমপুর ও এর আশেপাশের গ্রামাঞ্চলে আশ্রয় নেয়। কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। এলাকাজুড়ে শুধু লোক আর লোক। নিরাশ্রয় এসব মানুষের গন্তব্য নিরাপদে যশোর, সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাওয়া। পাক সেনাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে কয়েক হাজার মানুষ পুটিমারি বিলে জড়ো হয়। ভারতে যাওয়ার জন্য আগে থেকেই এখানে অবস্থান করছিল আরও কয়েক হাজার মানুষ। সবমিলয়ে চুকনগর বাজার ও এর আশেপাশের গ্রামাঞ্চলে জড়ো হয় প্রায় লাখ খানেক মানুষ।
তারা আরও জানান, ২০ মে সকাল থেকে যাত্রা শুরু করে এসব শরনার্থীরা। কেউ কেউ সকালের দিকে যাত্রা করে। অন্যরা সকালের খাওয়া-দাওয়া শেষে রওনা হবে। এজন্য সবাই রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কারও রান্না শেষ হয়েছে। কেউবা শুরু করেছে। কেউবা ভাতের থালা নিয়ে বসেছে। ঠিক এমন মুহূর্তে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ৩টি জীপ চুকনগর-সাতক্ষীরা সড়ক ধরে মালতিয়া মোড়ের ঝাউতলায় এসে হঠাৎ থেমে যায়। রাস্তার পাশে পাট ক্ষেতে কাজ করছিলেন চিকন মোড়ল (৭০) নামের এক বৃদ্ধ। গাড়ির শব্দে সে উঠে দাঁড়ালে পাকবাহিনী তাকেই প্রথমে গুলি করে মারে। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর তাণ্ডবলীলা।
স্থানীয়রা জানান, এরপর পাকবাহিনী চলে আসে চুকনগর বাজারে। শুরু হয় গুলি আর গুলি। গুলির শব্দে এখানে জড়ো হওয়া নারী-পুরুষের আর্তচিৎকারে আকাশ, বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। চারিদিকে শুধু কাঁন্নার শব্দ। হুড়োহুড়ি আর দৌড়াদৌড়ি। এ সময় পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে কত অবুঝ শিশু যে মারা গেছে তার কোনো হিসেব নেই। এরপর সবকিছুই এক সময় নীরব হয়ে যায়। চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ।
তারা জানান, পাকিস্তানি নরপশুরা সেদিন চুকনগর বাজার, মন্দিরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় ঢুকে নিরীহ মানুষকে অকাতরে গুলি করে মারে। এমনকি কোথাও লুকিয়ে থেকেও তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি কেউ। সেদিন চুকনগর মৃত নগরীতে পরিণত হয়। পাকবহিনীর এই তাণ্ডবলীলা চলে ৩/৪ ঘণ্টা ধরে। এই স্বল্প সময়ে বর্বর এই বাহিনী চুকনগরে যেন মানুষ মারার হোলিখেলায় মেতে উঠেছিল।
পাকবহিনীর এই তাণ্ডবলীলা চলকালে অসহায় মায়ের কোলে শিশুর লাশ আবার মাকে হারিয়ে কত শিশু অসহায়ের মতো বসে কাঁদছে- এমন দৃশ্য ছিল বলেও জানান প্রত্যদর্শীদের অনেকে।
তারা জানান, চুকনগরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ভদ্রা নদীতে ছিল লাশের বহর। ছিল তাজা রক্তের স্রোত। কোথাও পা দেয়ার জায়গা ছিল না। চুকনগর বাজারের ওলিতে-গলিতে শুধু লাশ আর লাশ। পাকবাহিনীর বর্বর পৈচাশিক হত্যাযজ্ঞের পর চুকনগর বাজার শকুন ও কুকুরের দখলে চলে যায়। অনেক মৃতপ্রায় ব্যক্তিকে নিয়ে টানাটানি করে শকুন আর কুকুর। এলাকার সাধারণ মানুষ কিছু লাশ বিভিন্ন স্থানে মাটি দেয় আর কিছু লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়। এই করুণ দৃশ্য কখনও ভুলবার নয়। সেদিন চুকনগরে কতজন মানুষ মারা গেছে তার কোনো সঠিক হিসেব নেই।
এলাকার প্রবীন ব্যক্তিদের কাছ থেকে জানা যায়, ভদ্রা নদীতে লাশ পড়ে ছিল ১০ হাজারের বেশি। এর চেয়ে কম হবে না। এ ছাড়াও স্থানীয়ভাবে আরও কয়েক হাজার মানুষকে মাটি চাপা দেয়া হয়েছিল। এত অল্প সময়ে এক জায়গাতেই এত লোককে হত্যা করার মতো কোনো নজির আজ পর্যন্ত কারোর জানা নেই।
চুকনগরের এই নৃশংস দৃশ্য পৃথিবীর ইতিহাসে সব গণহত্যার চেয়ে বর্বর বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এ দিনটি শুধু চুকনগরের জন্য নয়, সারাদেশের জন্য একটি ভয়াল ও স্মৃতিবাহী দিন। স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি অবিস্মরণীয় দিন। বেদনাবিধূর ও শোকাবহ দিন।
এলাকার সাধারণ মানুষের দাবি, এখানে একটি মুক্তিযোদ্ধা যাদুঘর, মুক্তিযোদ্ধা পাঠাগার এবং চুকনগর গণহত্যায় নাম না জানা হাজারো শহীদের স্বরণে হাসপাতাল নির্মাণ করা হোক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে