ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চলতে থাকলে বিদেশি বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যাবে
ড. এম এম আকাশ, অর্থনীতিবিদ ও চিন্তক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক ‘ভিউজ বাংলাদেশ’-এর সঙ্গে কথা বলেছেন, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় ধ্বংসাত্মক তৎপরতা, যুক্তরাষ্ট্রের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার লাল তালিকায় বাংলাদেশের নাম থাকা ও জাতীয় সংগীত পরিবর্তন বিষয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, অর্থনীতিবিষয়ক লেখক এম এ খালেক ও ‘ভিউজ বাংলাদেশ’-এর সহযোগী সম্পাদক গিরীশ গৈরিক।
ভিউজ বাংলাদেশ: প্রতিবারই দেখা যায়, দেশে যখন গণআন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তিত হয়, তখন মহল বিশেষ ধ্বংসাত্মক তৎপরতায় লিপ্ত হয়। এবারও তার কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। বিভিন্ন স্থানে মানুষ সমবেত হয়ে শিল্প-কারখানা বা কোনো নেতার বাড়ি আক্রমণ করেছে। এ ধরনের তৎপরতার কারণ কী?
ড. এম এম আকাশ: সাধারণত গণআন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তিত হলে বিক্ষুব্ধ জনতা কোনো কোনো সময় উত্তেজিত হয়ে বিভিন্ন স্থানে হামলা বা ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালাতে পারে। এটা এক দিন বা দুই-তিন দিনের জন্য হতে পারে; কিন্তু এ ধরনের তৎপরতা যদি অব্যাহতভাবে চলতে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে এর পেছনে কোনো বিশেষ মহলের ইন্ধন আছে, যারা অরাজকতার সুযোগে তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে চায়। অথবা চিহ্নিত দুষ্কৃতকারীরাও এটা করতে পারে। কথায় বলে, কারও বাড়িতে আগুন লাগলে স্বার্থান্বেষী মহল তাতে আলু পুড়িয়ে খেতে চায়। তবে এ ধরনের মাসাধিককালব্যাপী ক্ষোভের ঘটনা খুব একটা স্বাভাবিক নয়।
ভিউজ বাংলাদেশ: সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার লাল তালিকায় বাংলাদেশসহ ২১টি দেশের তালিকা প্রকাশ করেছে তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এটা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইমেজ ক্ষুণ্ন করবে কি না?
ড. এম এম আকাশ: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে কয়টি দেশে তাদের নাগরিকদের ভ্রমণের জন্য সতর্কতা জারি করেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের নামও আছে। ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ইমেজ ক্ষুণ্ন হবে। এই তালিকায় যেসব দেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, সেসব দেশে রাজনৈতিক এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা নেই, এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কোনো দেশে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে সংশ্লিষ্ট দেশটির সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থা কেমন, তা বিবেচনায় নেয়। কারণ বিনিয়োগ একটি দীর্ঘ মেয়াদি প্রক্রিয়া। কেউই চাইবে না, কোনো দেশে বিনিয়োগ করে তার পুঁজি এবং জীবনের নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন হোক।
এই তালিকা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের নিরাপত্তার মান নিয়ে সংশয় সৃষ্টি করবে। বাইরের মানুষ বুঝতে পারবে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থা এখনো স্থিতিশীল হয়নি। তাই তারা বাংলাদেশের সঙ্গে বিনিয়োগ-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ‘ধীরে চলো’ নীতি অনুসরণ করতে পারে। বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আছে। আমরা ভাবছি, বাংলাদেশ এখন স্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে আছে। আগামীতে আরও স্থিতিশীল হবে; কিন্তু বিদেশিরা তা নাও ভাবতে পারে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই তালিকা প্রকাশের কারণে তাদের মনে সন্দেহ আরও দৃঢ হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই তালিকার একটি নেতিবাচক প্রভাব নিশ্চিতভাবেই আছে।
ভিউজ বাংলাদেশ: ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের পর একটি মহল থেকে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের জন্য প্রস্তাব করা হচ্ছে। এটা আপনি কীভাবে দেখছেন?
ড. এম এম আকাশ: জাতীয় সংগীত কী হবে সেটা মীমাংসিত বিষয়। একটি মহল এই মীমাংসিত বিষয় নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করছে। আমাদের জাতীয় সংগীত কী হবে, জাতীয় পতাকা কেমন হবে- এসব বিষয় স্বাধীনতার পরপরই নির্ধারিত হয়েছে। কাজেই মীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টির এই প্রচেষ্টা সমর্থনযোগ্য নয়। এমনকি সংবিধানকে নতুন করে লেখার দাবিও করছেন কেউ কেউ। আমাদের সংবিধানের মূলনীতি কি হবে, সবরকম মৌলিক মানবাধিকার কীভাবে সংরক্ষিত হবে এসব মৌলিক বিষয় নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ আছে বলে মনে হয় না।
বিভিন্ন সামরিক ও স্বৈরাচারি শাসনামলে সংবিধানের কিছু কিছু বিষয় পরিবর্তিত হয়েছে; কিন্তু এই পরিবর্তনগুলো জনমতের ভিত্তিতে হয়নি। কিছু কিছু বিষয় আছে, যা স্বৈরাচারি সরকারও পরিবর্তন করতে সাহসী হয়নি। তার মধ্যে রয়েছে জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত ইত্যাদি। এখন এই পর্যায়ে এসে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি উত্থাপন করা উদ্দেশ্যমূলক বলেই আমি মনে করি। আপাত নির্দোষ মোড়কে এর পেছনে দেশকে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রাথমিক কৌশল লুকায়িত রয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে