Views Bangladesh Logo

সিলেটের কোয়ারিগুলোর পাথর লুট অব্যাহত, তীব্র হচ্ছে ভূমিকম্পের আশঙ্কা

বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের অব্যাহত পাথর লুটপাটে হুমকির মুখে সিলেটের চারটি পাথর কোয়ারি ও একটি টিলা। একের পর এক বোমা মেশিনের তাণ্ডবে কোয়ারিগুলোকে ছিন্নভিন্ন করে পাথর লুটে নিচ্ছেন তারা অভিযোগ স্থানীয় ও পরিবেশবিদদের।

কোয়ারিগুলো হচ্ছে কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি, জাফলং পাথর কোয়ারি, কানাইঘাটের লোভাছড়া কোয়ারি এবং বিছনাকান্দি পাথর কোয়ারি। এছাড়া ভোলাগঞ্জের পাথরবেষ্টিত শাহ আরেফিন টিলায় রয়েছে একজন ওলির মাজার। ওপরের পাথরগুলোই এসব কোয়ারি ও টিলার রক্ষাকবচ।

গেল সাত মাসে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে বলে কোয়ারিগুলোর সূত্রে জানা গেছে।

জাফলং থেকে ভোলাগঞ্জ পর্যন্ত ভূমিকম্পের ডেঞ্জার জোন। পাথর লুট বন্ধ না হলে ভূমিকম্পের আশঙ্কা আরও তীব্র হবে বলেও মনে করছেন পরিবেশবিদরা।

স্থানীয়দের অভিযোগ, পাথর লুটপাটে আগে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নাম জড়িত ছিল। ২০১৪ সালে অবৈধভাবে পাথর তুলতে গিয়ে অন্তত ৫০ জন শ্রমিকের মৃত্যুতে প্রশাসন বন্ধ করে দেয় পাথর উত্তোলন। শ্রমিক মৃত্যুর মিছিল কমে আসে।

বিষয়টি নিয়ে উচ্চ আদালতে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনার সরকার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এই নিষেধাজ্ঞা এখনো বহাল থাকলেও গত বছরের ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট। আইন না মেনে ফের চলছে পাথর লুটের মহোৎসব। আর লুটেরাদের স্থান এখন দখলে নিয়েছে বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো।

স্থানীয়রা বলছেন, কোয়ারিগুলো রক্ষায় শত শত পাথরখেকোর বিরুদ্ধে ৩০ থেকে ৩৫টি মামলা হলেও সবাই আগের মতো রাজনৈতিক প্রভাবেই ধরাছোঁয়ার বাইরে। নিয়মিত অভিযান চললেও তাতে পাত্তা দেন না তাদের সিন্ডিকেট।

শুধুমাত্র জাফলংয়েই দুই শতাধিক পাথরখেকোর বিরুদ্ধে আটটি মামলা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি
দেশের বৃহত্তম পাথর কোয়ারি ভোলাগঞ্জে অবাধে পাথর লুটপাট চলছে ৫ আগস্টের পরদিন থেকেই। এখানে রয়েছে রেলওয়ের রোপওয়ে বাংকার। এই বাংকার পাহারায় ছিলেন রেলওয়ের নিরাপত্তাকর্মীরা। প্রথমেই হামলা চালানো হলে সরে যান তারা। এরপর থেকে চলে আসছে লুটপাট।

অভিযোগ রয়েছে, এই লুটের নেতৃত্বে আছেন স্থানীয় যুবদল নেতা রাজন আহমদ, রুবেল আহমদ বাহার ও জেলা যুবদল নেতা মোস্তাকিম ফরহাদ। তাদের নেতৃত্বে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, ব্যবসায়ীদের যৌথ সিন্ডিকেট সাত মাসে সাদা পাথর, বাংকারসহ অন্তত আড়াই হাজার কোটি টাকার পাথর লুট করে নিয়েছে। বিজিবি ও পুলিশের স্থানীয় সদস্যরাও প্রকাশ্যেই উত্তোলিত পাথর থেকে চাঁদাবাজি করছেন, রয়েছে এমন অভিযোগও।

ভোলাগঞ্জের শাহ আরেফিন টিলাটি থেকেও ৫ আগস্টের পর থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকার পাথর লুটে নিয়ে প্রায় মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। উত্তোলিত পাথরে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে বিতর্কিত হন কোম্পানীগঞ্জ থানার সাব-ইন্সপেক্টরসহ ১৩ পুলিশ সদস্য। এ ঘটনায় তাদের প্রত্যাহারও করে নেয়া হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তির অভিযোগ, পুলিশ, উপজেলা প্রশাসন ও পাথরখেকোদের সিন্ডিকেট শাহ আরেফিন মাজারসহ মসজিদ ও মাদ্রাসার মাটি খুঁড়ে শেষ করে দিয়েছে। লুট করেছে পাথরসহ আশপাশের খনিজ সম্পদও।

সরকার এটির বন্দোবস্ত দিলে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব পেত। অন্যদিকে হাজার হাজার মানুষ বৈধভাবে কাজের সুযোগ পেতেন বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরাও।

সরেজমিন জানা গেছে, কোম্পানীগঞ্জের পাথরখেকো মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আইয়ুব আলী, রফিক মিয়া, মনির মিয়া, আব্দুল করিম, আব্দুর রশিদসহ প্রায় ৪০/৫০ জনের নেতৃত্বে হাজার হাজার শ্রমিক ড্রেজার ও ভেকু মেশিন লাগিয়ে গভীর গর্তের নিচ থেকে পাথর উত্তোলন করছেন। ২৩ জানুয়ারি পরিবেশ আইনে যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তারা হলেন কাঠালবাড়ী গ্রামের জিয়াদ আলীর ছেলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ (৪৫), জালিয়ারপাড় গ্রামের মৃত রহিম উল্লাহর ছেলে মনির মিয়া (৪৫), একই গ্রামের মৃত নঈম উল্লাহর ছেলে আব্দুল করিম (৫০), আব্দুর রশীদ (৫৫), চিকাডহর গ্রামের মৃত মনফর আলীর ছেলে আইয়ুব আলী (৫৫), আঞ্জু মিয়া (৫০), সোহরাব আলী (৩৯), তৈয়াব আলী (৪৫), বতুল্লাহ মিয়া (৪০), মৃত ইউনুস আলীর ছেলে আব্দুল হান্নান (৪০), আনোয়ার আলী (৫৫), একই গ্রামের মৃত উস্তার আলীর ছেলে আনফর আলী (৫৫), মৃত রফিক উল্লাহর ছেলে গরীব উল্লাহ (৫৮), জালিয়ারপাড় গ্রামের মৃত আব্দুল গনির ছেলে মো. ইব্রাহিম (৪০), মৃত আব্দুল গনির ছেলে আব্দুন নূর (৪৫), মৃত আব্দুল মিয়ার ছেলে মো. ইসমাইল (৩৮), মৃত কনাই মিয়ার ছেলে আলী হোসেন (৩৫), মাসুক মিয়ার ছেলে আবুল হোসেন (৩০), ফয়জুর রহমান (৩৮), মৃত আহাদ আলীর ছেলে রফিক মিয়া (৩৫), আব্দুল খালিকের ছেলে বাবুল মিয়া (৪০), মৃত গুকুর আলীর ছেলে যশর মিয়াসহ (৫০) আরও ৫০ জন। তবে আসামিদের আটকে পুলিশ কিংবা উপজেলা প্রশাসনের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।

জাফলং পাথর কোয়ারি
জাফলংয়ে ৫ আগস্টের পর প্রথম দিকে মাটির উপরে থাকা পাথর লুট করা হয়। গত দুই মাস ধরে চলছে কয়েকশ বোমা মেশিন দিয়ে ভূগর্ভের পাথর উত্তোলনও। বোমা মেশিনের তাণ্ডবে এখন ছিন্নভিন্ন পাথররাজ্য খ্যাত জাফলং।

আগস্টে মাত্র দশ দিনের লুটের পরিসংখ্যান জানিয়েছিল উপজেলা প্রশাসন। তারা বলেছিল, ওই সময়ে ১২৫ কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে।

আর স্থানীয়দের অভিযোগ, সাত মাসে জাফলং থেকে অন্তত দুই হাজার কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে। তারা বলছেন, জেলা বিএনপির পদ স্থগিত হওয়া নেতা রফিকুল ইসলাম শাহ্পরাণ ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শাহ আলম স্বপনের নেতৃত্বে সর্বদলীয় পাথরখেকো চক্র এই কোয়ারিতে লুটপাট চালাচ্ছে। সম্প্রতি এতে যোগ দিয়েছেন যুবদল ও ছাত্রদলের নেতারা।

কানাইঘাটের লোভাছড়া কোয়ারি
কানাইঘাটের লোভাছড়ায় জমা ছিল উত্তোলিত পাথর; কিন্তু ৫ আগস্টের পর সেগুলোও রক্ষা করা যায়নি। শেখ হাসিনা সরকারের শেষদিকে লোভাছড়া কোয়ারি ইজারা দেয়া হলেও উত্তোলিত পাথর সরিয়ে নিতে পারেনি পাথরখেকোরা। পাথর লুট বন্ধ হওয়ায় সিলেটের কোয়ারিগুলোতে যৌবন ফিরে এসেছিল; কিন্তু তারপর লিজ না নিয়েই তিনটি পাথর কোয়ারি থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে। যে যেভাবে পারছে সেভাবেই চলছে পাথর লুট।

বিছনাকান্দি পাথর কোয়ারি
দেশের অন্যতম বড় পাথর কোয়ারি বিছনাকান্দি এখন পাথরশূন্য। দুই মাসে কোয়ারির উপরের অংশে থাকা অন্তত ৩০০ কোটি টাকার পাথর লোপাট করা হয়েছে। এই কোয়ারির লুটের পাথর জব্দ করতে গিয়ে গোয়াইনঘাটের পুলিশও বিতর্কিত হয়।

পরিবেশবিদদের দাবি, যেভাবে সিন্ডিকেট করে পাথর লুট চলছে, সেটি পুলিশ দিয়ে দমানো সম্ভব নয়। আর পুলিশ, বিজিবি ও পাথরখেকো সিন্ডিকেট এক হয়ে গেছে। এখন প্রয়োজন যৌথ অভিযান। সেনাবাহিনীর সদস্যরা যেভাবে হরিপুরের চোরাই রাজ্যকে ধ্বংস করেছেন সেভাবে যৌথবাহিনীর সদস্যরা জাফলং, ভোলাগঞ্জ ও বিছনাকান্দিতে নামলে পাথর লুট বন্ধ করা সম্ভব হবে।

সিলেট পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. বদরুল ইসলাম জানান, জাফলংয়ে পাথর লুট বন্ধ রাখতে ইতোমধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ২০ থেকে ২৫ দিন অভিযান চালানো হয়েছে।

তিনি জানান, মামলাও হচ্ছে। পুলিশ সুপারকে আসামিদের তালিকা দেয়া এবং সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। এভাবে চলতে দেয়া যায় না। এ নিয়ে জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে যৌথ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘স্থানীয় থানাগুলোর তালিকা ছাড়াও স্থানীয়দের কাছ থেকে পাথর সিন্ডিকেট চক্রের বেশ কিছু নাম পেয়েছি। যাচাইবাছাই প্রক্রিয়া শেষে দ্রুত আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে।’

জেলা প্রশাসকের মন্তব্য জানার জন্য অফিসিয়াল সেলফোনে কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ