ডিসেম্বরে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩০ শতাংশ ফুল বিক্রি
শহীদ বুদ্ধিজীবী এবং মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩০ শতাংশ ফুল বিক্রি হয়েছে বলে দাবি করেন ব্যবসায়ীরা। স্বাধীনতার পর থেকেই শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবসসহ বিভিন্ন জাতীয় দিবসে ফুলের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ফুল ছাড়া এসব উৎসব পালন চিন্তাই করা যায় না। সেই ফুলের বাজারের বেহাল দশায় বছরের শেষে এসে ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত পড়েছে।
চারটি মূল জাতীয় দিবসকে সামনে রেখে প্রতি বছর ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত দেশে অর্ধশত কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয় বলে জানিয়েছেন, ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীরা। আর শুধু ডিসেম্বর মাসেই শহীদ বুদ্ধিজীবী এবং বিজয় দিবসকে ঘিরে রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়। তবে, এবারের চিত্র অন্যরকম। রাজধানীর আগারগাঁও, শাহবাগ, গুলশান, যাত্রাবাড়ী পাইকারীসহ খুচরা ফুল ব্যবসায়ীদের অভিমত চলতি বছর ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। আগারগাঁও ফ্লাওয়ার গার্ডেনের ফুল ব্যবসায়ী মো. সোহেল মিয়া জানান, অন্যান্য বছরের মতো এ বছর ১৪ ডিসেম্বর ও ১৬ ডিসেম্বর ব্যবসা ভালো হয়নি।
বাংলাদেশ ফুল ব্যবসায়ী সোসাইটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইমামুল হোসাইন বলেন, ‘বুদ্ধিজীবী ও বিজয় দিবস উপলক্ষে রাজধানীতে ২ কোটি টাকার ফুল বিক্রির লক্ষ্য ছিল; কিন্তু সেই প্রত্যাশা আমাদের পূরণ হয়নি। লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩০ শতাংশ ফুল বিক্রি হয়েছে।’ তিনি বলেন, এ বছর স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালতে তেমন কোনো অনুষ্ঠান না থাকায় এবং সভা-সমাবেশ ও সেমিনার কম হওয়ায় এই অবস্থা। বিপুল পরিমাণ ফুল পচে যাচ্ছে এবং প্রতিদিন পচে যাওয়া ফুল ট্রাকে করে ফেলতে হচ্ছে।’
শাহবাগ ফুল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও আনিকা পুষ্প বিতানের মালিক মো. আবুল কালাম বলেন, 'আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শাসনামলে যে ব্যবসা হয়েছে এবার তা ক্ষতির সন্মুখীন।' তিনি বলেন, 'গত বছর ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী ও ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে একাই আমি ১৩০টি শ্রদ্ধাঞ্জলি বিক্রি করেছি, সেইসঙ্গে শাহবাগে ১৫শ শ্রদ্ধাঞ্জলি বিক্রি হয়েছে। এবার পুরো শাহবাগ ফুল মার্কেটে মাত্র ৫০টি বিক্রি হয়েছে। মার্কেট মন্দা থাকায় ব্যক্তিগতভাবে এবার আমার এই দুদিনে ১ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।'
জানা গেছে, শাহবাগে ৪০টি ফুলের দোকান রয়েছে। কমবেশি প্রতিটি দোকানেই ব্যবসার ক্ষতি হয়েছে। এ বছর দেশের বিভিন্ন জেলা বাদেও ভালো বেচাকেনার আশায় ভারত ও চায়না থেকেও ফুল আনা হয়েছিল; কিন্তু আশানুরূপ ব্যবসা হয়নি বলে জানান ব্যবসায়ীরা। তারা বলেন, সন্ধ্যা হলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহবাগ গেট বন্ধ করে দেয়াতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কেউ প্রবেশ করতে পারছে না, ফলে এ এলাকার দোকানগুলোতে ফুল ব্যবসায় ধস নেমে এসেছে। দুপুরের পরেই ফুল বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়।
মো. আবুল কালাম বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন কলেজের ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, চারুকলা, রমনা পার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বেড়াতে এসে ফুল কেনেন। এবার নানারকম বিধিনিষেধ থাকায় সেভাবে ক্রেতারা আসেননি।' জানা যায়, শুধু শাহবাগের ফুলের বাজারে ৪০টি দোকানে গত বছর বিক্রি হয়েছিল ৪ কোটি টাকার ফুল। এ বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে দুই কোটির কাছাকাছি। আগারগাঁ ফ্লাওয়ার গার্ডেনের ফুল ব্যবসায়ী মো. সোহেল মিয়া জানান, 'অন্যান্য বছরের মতো এ বছর ১৪ ডিসেম্বর ও ১৬ ডিসেম্বর ব্যবসা হয়নি। তাকিয়ে আছি মাতৃভাষা দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি ও ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের দিকে।'
'প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে কেন্দ্র করে সারা ঢাকা শহরে আমাদের ৩৫ থেকে ৪০ কোটি টাকার ফুলের বাণিজ্য হয়। করোনাভাইরাস চলাকালেও ১০-১৫ কোটি টাকার ব্যবসা করেছি। আসছে ৭ মার্চ, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, বাংলা নববর্ষ ও ভ্যালেন্টাইনস ডে-তে আশানুরূপ বিক্রি না হলে পথে বসার উপক্রম হবে। কারণ আমাদের মধ্যে অনেক ব্যবসায়ী লোন নিয়ে ব্যবসা করছেন।' এদিকে ফুলের চাহিদা কম থাকায় কমছে বিভিন্নরকম ফুলের দামও।
রাজধানীর মিরপুর থেকে ফুল কিনতে শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) শাহবাগে ফুলের বাজারে আসেন আবির। তিনি জানালেন, ভাইয়ের বিয়ে তাই ফুল কিনতে এসেছেন। এখানে প্রতি পিস গোলাপ ১০ টাকা, রজনীগন্ধার নহর ২০ টাকা , গাজরা ৫০ টাকা, বিয়ের মালা ৪০০ টাকা, খোঁপার মালা কিনেছেন ১৫০ টাকায় ও গাঁদাফুলের মালা কিনেছেন ১০০ টাকায়। পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, রজনীগন্ধা ফুলের প্রতিটি স্টিক বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকা, গোলাপ ১২ টাকা থেকে ১৫ টাকা, জারবেরা বিক্রি হচ্ছে ১০-১৭ টাকা, চন্দ্র মল্লিকা প্রতিপিস ২-৩ টাকা ও গাঁদাফুল হাজার বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়।
ব্যবসায়ীদের দাবি, তারা যে দামে ফুল কিনছেন, তারচেয়ে কম দামে বিক্রি করার ফলে তারা বড় অঙ্কের ক্ষতির মুখোমুখি এ বছর। দেশের মোট চাহিদার শতকরা ৭০ শতাংশ ফুল আসে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা, নাভারণ, নির্বানখোলা ও হাড়িয়া গ্রামের ফুলচাষিদের থেকে। এখানে প্রায় ছয় হাজার পরিবার এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়াও দেশের আরও ২৬টি জেলায় ৬ হাজার হেক্টর জমিতে ফুল চাষ হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, ফুলের বিক্রি আশানুরূপ না হলে পথে বসবেন এই ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েক লাখ মানুষ, যার প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে