কালো টাকা সাদা করার সুযোগদান কার স্বার্থে?
অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী আগামী অর্থবছরের (২০২৪-২৫) যে বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন তার সার্বিক আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে আয় ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা এবং ব্যয়ের পরিমাণ হচ্ছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য স্থানীয় ও বিদেশি বিভিন্ন সূত্র থেকে ঋণ গ্রহণ করা হবে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা অনুদান পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় রাজস্ব আহরণে ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশ ক্রমেই বৈদেশিক ঋণনির্ভর একটি দেশে পরিণত হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপির রেশিও হচ্ছে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম। স্থানীয় এবং বিদেশি সূত্র থেকে সরকারের গৃহীত ঋণের পরিমাণ মোট জিডিপির প্রায় ৪০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এটা প্রায় বিপজ্জনক পর্যায়ের কাছাকাছি। গত ৫ বছরে অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে সরকারের গৃহীত ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণ বেড়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে সরকারের গৃহীত ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৮ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। বিদেশি ঋণের কিস্তি এবং সুদ বাবদ প্রতি বছর বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।
২০১৩-১৪ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের সুদ এবং কিস্তি বাবদ পরিশোধ করা হয়েছিল ১২৯ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসে এর পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি অর্থাৎ ২৬৮ কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেট গতানুগতিক। এতে নতুনত্ব নেই বললেই চলে। তাই বাজেট নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে তেমন প্রতিক্রিয়া নেই। তবে একটি বিষয় নিয়ে অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্ট মহলে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। বাজেটে ১৫ শতাংশ ট্যাক্স প্রদান সাপেক্ষে কালো টাকা সাদা করার অবারিত সুযোগ দেয়া হয়েছে।
ইস্যুটি অনেকের কাছেই বিস্ময়কর মনে হয়েছে। যদিও এ ধরনের সুযোগ অতীতে বারবার দেয়া হয়েছে; কিন্তু কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দান নিয়ে এবারের মতো এতটা আলোচনা হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সাবেক পুলিশ প্রধানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং অনিয়মের মাধ্যমে নজীরবিহীন সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উত্থাপিত হবার কারণে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দানের ইস্যুটি আলোচনার টেবিলে ঝড় তুলেছে। একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে তাদের সম্পদ হাতিয়ে নেয়ার বিভিন্ন ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার ফলে সাবেক পুলিশ প্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগ অত্যন্ত গুরুত্ব লাভ করেছে।
কালো টাকা সাদা করার সুযোগদানের বিষয়টি অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনার দাবি রাখে। অনেকেই কালো টাকা এবং অপ্রদর্শিত বা অঘোষিত টাকাকে একই অর্থে ব্যবহার করে থাকেন; কিন্তু বিষয়টি মোটেও তা নয়। কালো টাকা এবং অপ্রদর্শিত বা অঘোষিত অর্থ যারা সংরক্ষণ এবং ব্যবহার করেন তারা উভয়ই আইনের দৃষ্টিতে অপরাধী। অপ্রদর্শিত বা অঘোষিত অর্থও এক পর্যায়ে কালো টাকা হিসেবে বিবেচিত হয়; কিন্তু তা সত্ত্বেও কালো টাকা আর অপ্রদর্শিত বা অঘোষিত অর্থকে একই পাল্লায় পরিমাপের কোনো সুযোগ নেই। অপ্রদর্শিত বা অঘোষিত অর্থ হচ্ছে সেই অর্থ বা টাকা, যা বৈধভাবে উপার্জিত কিন্তু ট্যাক্স নেটওয়ার্কের বাইরে থাকে। অর্থাৎ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাদের বৈধ উপার্জনের যে অংশ ট্যাক্স ফাইলে প্রদর্শন করেন না, সেটাই অপ্রদর্শিত অর্থ। আর যে টাকা বা অর্থ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে উপার্জিত হয় এবং ট্যাক্স নেটওয়ার্কের বাইরে থাকে তাকে কালো টাকা বলা হয়।
কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাদের বৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বছরে ১০ কোটি টাকা আয় করলেন। সেই টাকা থেকে ৫ কোটি টাকা তিনি ট্যাক্স ফাইলে প্রদর্শন করলেন আর ৫ কোটি টাকা লুকিয়ে রাখলেন। তাহলে এই লুকিয়ে রাখা ৫ কোটি টাকা অপ্রদর্শিত অর্থ হিসেবে বিবেচিত হবে। আর কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি চুরি, ডাকাতি বা চোরাচালানির মাধ্যমে বছরে ১০ কোটি টাকা অর্জন করলেন এবং সেই টাকা তিনি ট্যাক্স ফাইলে প্রদর্শন করলেন না। তাহলে এই টাকা কালো টাকা হিসেবে গণ্য হবে। দেশের প্রচলিত আইনের বাধ্যবাধকতার কারণে অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ ট্যাক্স নেটওয়ার্কে প্রদর্শনের সুযোগ নেই। কালো টাকা মালিকরা একই সঙ্গে দুটি অপরাধ করেন। তারা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করেন এবং তা দেশের প্রচলিত ট্যাক্স নেটওয়ার্কের বাইরে রাখেন। আর অপ্রদর্শিত বা অঘোষিত অর্থের মালিকরা তাদের বৈধভাবে উপার্জিত অর্থ ট্যাক্স নেটওয়ার্কের বাইরে রাখেন। এরা একটি অপরাধ করেন।
কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত বা অঘোষিত অর্থের মালিকরা তাদের উপার্জিত অর্থ নিশ্চয়ই ফেলে রাখবেন না। আবার স্বাভাবিক পন্থায় তা ব্যবহার করতেও পারবেন না। তাই এ ক্ষেত্রে তার মানি লন্ডারিংয়ের আশ্রয় গ্রহণ করেন। কালো টাকা এবং অপ্রদর্শিত অর্থের মালিক এবং যারা মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে যুক্ত তারা কখনোই তাদের টাকা উপার্জনের পন্থা এবং টাকার পরিমাণ কারও কাছে প্রকাশ করেন না। কাজেই প্রতি বছর একটি দেশে বা বিশ্বের কি পরিমাণ কালো টাকা সৃষ্টি এবং মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বৈধতা দেয়া হয় তার সঠিক পরিসংখ্যান কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দিতে পারবে না। অনুমানভিত্তিক কিছু তথ্য-উপাত্ত প্রদর্শন করা যেতে পারে মাত্র।
আগে মনে করা হতো, অর্থ পাচার শুধু দরিদ্র এবং উন্নয়নশীল দেশের সমস্যা। বিত্তবান দেশগুলো এই সমস্যা থেকে মুক্ত। আসলে তা নয়। সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণা এবং প্রাপ্ত পরিসংখ্যান থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, উন্নত দেশ থেকেই অর্থ পাচার হয়ে তুলনামূলক কম উন্নত বা দরিদ্র দেশে আসছে। বিশ্বের এমন কোনো দেশ নেই যারা অর্থ পাচার এবং মানি লন্ডারিং থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। কোনো দেশে দেশ অর্থ পাচারকে প্রকাশ্যে উৎসাহিত করছে। যেমন, মালয়েশিয়া ‘সেকেন্ড হোম’ প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের দেশে অন্য দেশ থেকে অর্থ পাচারকে উৎসাহিত করছে। নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ অথবা নগদে নিয়ে যাবার শর্তে দেশটিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নাগরিকত্ব প্রদান করা হচ্ছে। কানাডায় বিদেশ থেকে পাচার হয়ে আসা অর্থ বিনিয়োগের চমৎকার সুযোগ রয়েছে। বছর দুই আগে তুরস্ক সেকেন্ড হোম প্রকল্প চালু করেছে।
সেখানে প্রাথমিক পর্যায়ে যারা আবেদন করেছেন, তাদের মধ্যে অন্তত ২০০ বাংলাদেশি রয়েছেন। যে দেশ থেকে অর্থ পাচার হয় এবং যে দেশে পাচার হয়ে যায়, উভয় দেশ যদি আন্তরিক না হয়, তাহলে অর্থ পাচার কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে পাচারকৃত অর্থের গন্তব্য যে দেশ, তারা যদি এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে তাহলেই শুধু অর্থ পাচার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। অর্থ পাচারের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হচ্ছে, অর্থ নিজ দেশের উন্নয়নে কাজে লাগানো যেত সেই অর্থ অন্য দেশের উন্নয়নে ব্যয় হচ্ছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য বাংলাদেশের উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ যেমন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিস্ময়কর উন্নতি সাধন করে চলেছে তেমনি আর্থিক দুর্বৃত্তায়ন ঘটলে নজীরবিহীনভাবে। শুধু একজন বেনজীর আহমেদই নজীরবিহীন দুর্নীতির রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন, তা নয় এমন হাজার হাজার বেনজীর দেশের আনাচে কানাচে প্রত্যক্ষ করা যাবে। দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ যেহেতু দেশের অভ্যন্তরে প্রশ্নাতীতভাবে ব্যবহারের সুযোগ নেই, তাই তারা এই অর্থ বিদেশে পাচার করে দিচ্ছেন। প্রস্তাবিত বাজেটে ১৫ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগদানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। একজন সংসদ সদস্য এই ট্যাক্সের হার আরও কমানোর দাবি করেছেন। সত্যি বিচিত্র আমাদের এই দেশ। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যাদের অবস্থান গ্রহণের কথা, তারাই দুর্নীতিবাজদের অনুকূলে কথা বলছেন।
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিলেও কোনো লাভ হবে না। কারণ যারা দুর্নীতির মাধ্যমে কালো টাকা অর্জন করছেন, তারা খুবই শক্তিশালী এবং সব সময়ই রাজনৈতিক ক্ষমতা বলয়ের মধ্যে থাকেন। তাই চাইলেও তাদের কিছু করা যাবে না। দুর্নীতি রোধ করা না গেলে কালো টাকার উপস্থিতি থাকবেই। আর কালো টাকা থাকলে তা বৈধ করার চেষ্টাও অব্যাহত থাকবে। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ যে এবারই প্রথম দেয়া হচ্ছে, তা নয় অতীতে অনেকবারই এমন সুযোগ দেয়া হয়েছে; কিন্তু কালো টাকা সাদা করা হয়েছে খুব সামান্যই। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক প্রথমবার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয় ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে। সেই সময় ৭৮ কোটি টাকা সাদা করা হয়েছিল। এরপর ১৯৮৯-৯০ অর্থবছরে কালো টাকা সাদা করা হয় ৮৫০ কোটি টাকা।
২০০০-০১ অর্থবছরে কালো টাকা সাদা করা হয় ১ হাজার কোটি টাকা। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে কালো টাকা সাদা করা হয় ৪ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ৯ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা সাদা করা হয়। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১ হাজার ২১৩ কোটি টাকা সাদা করা হয়। এ যাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কালো টাকা সাদা করা হয় ২০২০-২১ অর্থবছরে, যার পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এর মাঝেও আরও অনেকবার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে; কিন্তু খুব কমসংখ্যক কালো টাকার মালিকই এই সুযোগ গ্রহণ করেছেন।
বৈধ অর্থের মালিকদের প্রদেয় ট্যাক্সের তুলনায় কম ট্যাক্স দিয়ে কালো টাকার মালিকদের অর্থ সাদা করার সুযোগদান কোনোভাবেই নৈতিক বিচারে গ্রহণযোগ্য নয়। এ ধরনের আচরণ বৈধ অর্থের মালিকদের প্রতি বৈরিতা প্রদর্শনের শামিল। শুধু তাই নয়, বৈধ অর্থের মালিকদের কালো টাকা সৃষ্টিতে উৎসাহিত করা নামান্তর মাত্র। তাই কালো টাকা সাদা করার যে প্রস্তাবনা উপস্থাপন করা হয়েছে, বাজেটে তা প্রত্যাহার করা যেতে পারে। একই সঙ্গে কালো টাকার মালিকদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান শুরু করতে হবে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়িত্ব প্রাপ্ত সংস্থাগুলোকে আরও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সঙ্গে দায়িত্ব পালনে বাধ্য করতে হবে। কালো টাকার মালিকরা দেশ ও জাতির শত্রু। তাদের কোনো ছাড় দেয়া চলবে না। কালো টাকা সৃষ্টিকে ক্রিমিনাল অফেন্স হিসেবে ঘোষণা দিয়ে এদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এম এ খালেক: অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে