লোকসভা নির্বাচন-২০২৪
বিরোধী দলগুলোর দুর্বলতা আছে; কিন্তু তাদের শক্তি সমন্বয়বাদ
পৃথিবীর বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ বলে কথিত ভারতের লোকসভা নির্বাচন শুরু হয়ে গেছে। গরম এখন সারা দেশে ভয়ংকর চেহারা নিয়েছে। জায়গায় জায়গায় দাবদাহে ইতিমধ্যেই মানুষের মৃত্যু অবধি ঘটেছে। তারমধ্যেও প্রথম দফায় যে ১০২টি আসন ভোট হয়েছে, সেখানে এখনো যা হিসাব, তাতে ভোট পড়েছে গড়ে পয়ষট্টি শতাংশ। তার চেয়ে একটু বেশিই হতে পারে। এক-আধটা রাজ্য বাদ দিলে সর্বত্রই হিট ওয়েভের মধ্যে সাধারণ লোক গরম উপেক্ষা করে যেভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে নিজে নিজের মতপ্রকাশ করেছেন, তাতে দেশের গণতন্ত্র যে আছে, তা নিয়ে কোনো তর্ক নেই। যদিও বিরোধী দলগুলো দীর্ঘ সময় ধরে দাবি করে আসছেন যে, নরেন্দ্র মোদির শাসনকালে দেশের, শুধু গণতন্ত্র নয়, বিপন্ন দেশের মানবাধিকার, বাক-স্বাধীনতা, জোট ও ধর্ম নিরপেক্ষতা।
এবারের নির্বাচন সম্ভবত ১৯৪৭ সাল-পরবর্তী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। এবার রাজনৈতিক ইস্যু অন্যান্য বছরের মতো নিছক ক্ষমতা দখলের প্রশ্নে নয়। এবার একাধিক বিষয় ভোটে নিষ্পত্তি হতে চলেছে। বহুত্ববাদী না একমাত্রিক? ফেডারেল কাঠামো না পুরোপুরি কেন্দ্রনির্ভর? ধর্ম নিরপেক্ষতা না হিন্দু রাষ্ট্র! আম্বেদকর রচিত সংবিধান নাকি- তা বদলে দিয়ে নতুন কনস্টিটিউশন, এরকম একাধিক অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মীমাংসা হতে চলেছে লোকসভা নির্বাচনে।
আপাতভাবে দেশের মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার দৌলতে ধরেই নেওয়া হয়েছে যে, গত দুবারের ইলেকশনের মতো এবারও নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফের দিল্লির কুর্সিতে বসতে চলেছে। এটা ঠিকই যে মোদি ধারে ভারে বিরোধী নেতাদের থেকে অনেক এগিয়ে। তার ক্যারিশম্যাটিক ভাবমূর্তি বিজেপির তুরুপের তাস। তবুও মনে রাখতে হবে, নরেন্দ্র মোদির সর্বাত্মক চেষ্টা সত্ত্বেও গতবার পশ্চিমবঙ্গে শেষ হাসি হেসে ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃনমূল কংগ্রেস। কেরল, কর্নাটক, তামিলনাড়ু তেলেঙ্গানায় বিজেপিকে পর্যুদস্ত করে বিরোধী দল জিতেছে বিধানসভা নির্বাচনে। সেসব রাজ্যে বিজেপি জিতেছে, অনেক জায়গাতেই ভোটের মার্জিন খুব কম ছিল। এমনকি কোনো কোনো আসনে মাত্র কয়েক হাজার ভোটেও জয়-পরাজয়ের নিস্পত্তি হয়েছে।
বিজেপি অনেক ক্ষেত্রেই অর্থের বিনিময়ে বিরোধী দলের এমপি কিনে নিয়ে সরকার গঠন করেছে এমন দৃষ্টান্ত প্রচুর। ভারতের গণতন্ত্রের এই আয় রাম গয়া রাম নীতি আগে থাকলেও তাকে স্বাভাবিক কৌশল করে তোলার কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে মোদি সরকারের। আসলে গোটা সিস্টেম ক্রমেই করপোরেটের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। ফলে শাসকদের দিকে করপোরেট পুঁজির আনুগত্য বেশি থাকবে তা বলাই বাহুল্য। তাই এমন উদাহরণ কম নেই বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি বিরোধী দল জিতলেও লোকসভায় ছবিটা পুরো বদলে গেছে। তবুও অনেক সীমাবদ্ধতা থাকলেও এদেশে বিরোধী দল পুরোপুরি অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে এমনটা ভাবা ঠিক নয়। শুধু ভোটের অঙ্কে নয়, জনসমর্থনের নিরিখেও আজও কংগ্রেসের প্রতি বিশালসংখ্যক মানুষের সমর্থন যথেষ্ট পরিমাণে রয়ে গেছে। ঘটনাচক্রে তাদের মধ্যে অধিকাংশই আবার গ্রামীণ সর্বহারা। দলিত, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। অনেকেই বলেন কংগ্রেসের অবস্থা পুরোনো সামন্ত প্রভুদের মতো। নিজেকে সময়ের সঙ্গে পাল্টাতে না পারার জন্যই তাদের ওপর থেকে শহরের এলিট, মধ্যবিত্তদের আস্থা চলে গেছে। নতুন প্রজন্মের কাছে তো কংগ্রেসের কোনো আকর্ষণ নেই।
ভারত দেশটাই এত বড় যে, একসঙ্গে জনগণের সব শ্রেণিকে খুশি করা কঠিন। ফলে মোদির ভোট ব্যাংক মূলত এলিট, উচ্চ, মধ্যবিত্ত। যাদের বড়সংখ্যক শহরের বাসিন্দা। সমস্যা হচ্ছে এই ছোট অংশই দেশের নীতি নির্ণায়কের অগ্রণী ভূমিকা নেয়। জাতপাতে বহুধাবিভক্ত ভারতের এলিট, মিডিল ক্লাস অংশের অধিকাংশই আবার উচ্চ বর্গের। তারাই দেশের গণতন্ত্রের সবকটি স্তম্ভের নিয়ন্ত্রক। ফলে মোদি সরকারের ইমেজ নির্মাণে শহরের মধ্যবিত্ত, এলিটদের বিরাট ভূমিকা আছে। তারাই মিডিয়ার সহায়তায় জনমনকে প্রভাবিত করেন নিয়ত; কিন্তু ভারতের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী পি সাইনাথের লেখা পড়লে বুঝবেন গ্রামীণ ক্ষেত্রে বিরোধী বিভিন্ন দলের ক্ষমতা এখনো কম নেই।
গত কয়েক বছরে নিঃসন্দেহে বিরোধী কণ্ঠ স্তব্ধ করার নতুন নতুন ফন্দিফিকির বেড়েছে। তার চেয়েও দুর্ভাগ্যজনকভাবে বেড়েছে ধর্মীয় বিদ্বেষ। কেন্দ্র ছুতোয়নাতায় গোয়েন্দা এজেন্সিকে বিরোধী দলকে চাপে রাখতে কাজে লাগিয়েছে এটা যেমন সত্যি। তেমনি দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘুদের ওপর নানাভাবে হেনস্তা করার ঘটনা ঘটছে এও সত্যি। সাধারণভাবে বিজেপি সরকার সম্পর্কে ধারণা করা হয় এরা হিন্দুত্ববাদী। কথাটা আদৌ ঠিক নয়। বলা যায়, এই সরকার ব্র্যাহ্মণ্যবাদী সরকার। হিন্দু জাত কাঠামোয় সব থেকে পেছনে থাকা দলিতরাও এই রেজিমে ভালো নেই তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বিজেপি যে নাগরিক আইন সংশোধনের কথা বলে, তা বাস্তবে হলে বিপদে পড়বে নিম্নবর্গের হিন্দু জনগোষ্ঠীর লোকেরাই। এই কঠিন, আতঙ্কের পরিবেশেও বিরোধী শক্তি মিলেমিশে যে ‘ইন্ডিয়া’ জোট গড়ে তুলেছে তা কতটা মোদি সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে তা এখনই বলা না গেলেও বিনা যুদ্ধে তারা সারেন্ডার করবে এটা ভাবা মূর্খামি।
আগে অনেক সময় দেখা গেছে, বিরোধী ভোট ভাগাভাগির জন্য সুবিধা হয়েছে শাসকদের। তারা কম মার্জিনে জিতে বাজিমাত করেছেন। এবার অধিকাংশ আসনে একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী যে ইতিমধ্যেই বিজেপি শিবিরে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে, তা নিয়ে সংশয় নেই। দক্ষিণ ভারতে লড়াইটা হচ্ছে বিজেপির ব্র্যাহ্মণ্যবাদী রাজনীতির সঙ্গে সাব অলটার্ন দর্শনের। রাজস্থান, পশ্চিম উত্তর প্রদেশ ও বিহার ঝাড়খন্ডের বিস্তৃত এলাকায় বিজেপি এবার বিরোধীদের সম্মিলিত আক্রমণে কিঞ্চিৎ কোণঠাসা তা শাসক নেতাদের শরীরের ভাষা দেখলেই স্পষ্ট। দীর্ঘ কৃষি আন্দোলনের প্রভাব গো বলয় এবং পাঞ্জাব হরিয়ানার বিরাট অঞ্চলে বিজেপিকে উদ্বেগের মধ্যে রেখেছে। এ ছাড়া বিজেপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল অনেক রাজ্যে যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, তা দলের পক্ষে অশনিসংকেত। বিজেপি দলের চিরাচরিত ভোট ব্যাংক জাঠ, ক্ষত্রিয়, রাজপুতদের ভারী অংশ এবার নানা কারণে দলের ওপর ক্ষুব্ধ। তারা এর মধ্যেই বিভিন্ন জায়গায় রাস্তায় নেমে দলের ওপর নিজেদের ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন। ভোটের সময় তার প্রতিফলন ভোটের বাক্সে পড়লে অবাক হব না।
বিরোধী দল সম্পর্কে সরকার পক্ষের বড় অভিযোগ যে তাদের কোনো গ্রহণযোগ্য নেতা নেই। ফলে জনতার কাছে নরেন্দ্র মোদির বিকল্প নেই। আসলে এর মধ্যেই দেশের রাজনীতির পরস্পর বিরোধী দুই ধারা স্পষ্ট। বিজেপি পুরোপুরি মোদি নির্ভর। গণতন্ত্রের পক্ষে এমন অতি ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা অশুভ। বিরোধী দলের কালেকটিভ নেতৃত্ব ফেডারেল কাঠামোর পক্ষে শুভ। তাছাড়া রাহুল গান্ধী আগের চেয়ে অনেক পরিণত। বিহারের তেজস্বী যাদব বা দিল্লির অরবিন্দ কেজরিওয়াল, তামিলনাড়ুর স্ট্যালিন নিজের রাজ্যে খুবই প্রভাবশালী। সুতরাং মেইন স্ট্রিম মিডিয়ার চোখ দিয়ে শুধু বিরোধী দলগুলোর দুর্বলতা আছে, এটা বলা যাবে নিশ্চিত; কিন্তু সে নির্বাচনি লড়াই এ সংসদীয় রাস্তায় সহজে পিছু হটবে, তা মনে হয় না।
ভারতীয় গণতন্ত্রের শিকড় খুব গভীরে। এখানে জনমনে বহুত্ববাদের প্রতি আকর্ষণ আজও দুর্নিবার। সমন্বয়বাদী দেশে একমাত্রিক ভাবনা চিরস্থায়ী হতে পারা কঠিন। বিরোধী দলের তুরুপের তাস ওই বহুত্ববাদী দর্শন। নরেন্দ্র মোদির দল যত ধর্মীয় উন্মাদনায় সাধারণ মানুষকে বুঁদ করতে চাইবে তত বিরোধীরা দেশের মন্দা অর্থনীতির কথা সামনে আনবেন। বেসরকারি এক গবেষণা সংস্থার সমীক্ষায় জানা গেছে যে, এদেশের নাগরিকদের ৮০ শতাংশ মনে করেন এই দেশ কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের নয়। সব ধর্মের, জাতের, ভাষার জনপদ এই ভারত। বিরোধী দলের ট্র্যাম্প কার্ড এই ৮০ শতাংশ বহুত্ববাদী সমর্থক। বিরোধী দলগুলোর অনেক দুর্বলতা আছে; কিন্তু তাদের আসল শক্তি সমন্বয়বাদ। যাকে বিনাশ করা কঠিন, বড্ড কঠিন।
সৌমিত্র দস্তিদার: ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে