আমাদের অর্থনীতি ও অর্থনীতিতে নোবেল
ক্ষমতার পালাবদলের পর দেশে একটা অনিশ্চয়তার পরিবেশ বিরাজ করছে। আইন-পুলিশ-প্রশাসন সবখানে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এর প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে এক ধরনের অচলাবস্থা বিরাজ করছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের আগে থেকেই চলা এই স্থবিরতা এখন আরও দীর্ঘায়িত হয়েছে। একদিকে বন্ধ হচ্ছে একের পর এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অন্যদিকে বাড়ছে মন্দ ঋণের পরিমাণ। খুচরা পণ্যের মূল্যসূচকের নিরিখে মূল্যস্ফীতির হার এখনো যথেষ্ট চড়া, বিশেষত খাদ্যপণ্যে মূল্য বৃদ্ধির হার রীতিমতো উদ্বেগজনক। মুদ্রা নীতি নিয়েও সমালোচনা রয়েছে। শিল্পক্ষেত্রে যে দীর্ঘমেয়াদি শ্লথতা চলছে, তা কতখানি চড়া সুদের কারণজনিত বিনিয়োগ-অনিচ্ছার ফল, আর কতখানি বাজারের সার্বিক চাহিদা কম থাকার কারণে? গত কয়েক বছর ধরেই প্রমাণ মিলেছে যে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যথেষ্ট না-বাড়ার কারণে বাজারে চাহিদাও সেভাবে বাড়েনি। এবং চাহিদা না থাকলে জোগান বাড়ানোরও প্রশ্ন ওঠে না। ফলে, বিনিয়োগও শ্লথ হয়েছে। এই শ্লথ বিনিয়োগ আবার সরাসরি প্রভাব ফেলেছে কর্মসংস্থানের ওপর। তার ফলে জনসংখ্যার একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশের ক্রয়ক্ষমতা আরও সংকুচিত হয়েছে, এবং তা ফের প্রভাবিত করেছে সার্বিক চাহিদাকে।
এদিকে আগের সরকারের সুবিধাভোগী অনেক ব্যবসায়িক পৃষ্ঠপোষক এরই মধ্যে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন, যার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের সার্বিক পরিস্থিতি স্থবির অবস্থায় রয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের আড়াই মাস পরেও প্রশাসনের ওপর কর্তৃত্ব বা নিয়ন্ত্রণের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। আগামী দিনগুলোতে দেশ কী হয়, এটা নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের সংশয় ও উদ্বেগ বিরাজ করছে। এই পরিস্থিতি দেশের অর্থনীতির জন্য মোটেও ইতিবাচক নয়।
ভারতের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর মতে, ‘সামাজিক বিশ্বাস, এবং একটা সেন্স অব বিলঙ্গিং- এই বোধ, যে সমাজটায় আমি আছি, আমিও তার অংশ- অর্থনীতির স্বাস্থ্যের পক্ষে এই দুটি জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ। মুশকিল হলো, বিশ্বাসকে তো মাপা যায় না। রাজকোষ ঘাটতি বা টাকার জোগানের সঙ্গে আর্থিক বৃদ্ধির হারের সম্পর্ক অর্থনীতির তত্ত্ব ও যুক্তি দিয়ে দেখিয়ে দেয়া যায়; কিন্তু বৃদ্ধির হারের ওপর সামাজিক বিশ্বাসের কী প্রভাব পড়ছে, সেটা পরিসংখ্যান দিয়ে সরাসরি ধরা যাবে না; কিন্তু সেই সম্পর্ক ধরা যায়। ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা গোটা পৃথিবীর একটা বিপুল পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, যে সমাজে পারস্পরিক বিশ্বাস বেশি, সেখানে আর্থিক বৃদ্ধির হারও তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেশি।’
আমাদের দেশে বর্তমানে পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস, নিরাপত্তা ইত্যাদি সামাজিক বিষয়গুলোর সূচক খুবই নিম্নমুখী। ফলে অর্থনীতির অবস্থাও যথেষ্ট সংকটাপন্ন। অর্থনৈতিক টানাপড়েন নিয়ে যখন আমরা ধুঁকছি, তখন উন্নতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের মধ্যে বৈষম্যের বিষয়টি তুলে ধরে অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন ড্যারেন অ্যাসামোগলু, সিমোন জনসন এবং জেমস রবিনসন।
এই তিনজন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা নিরূপণে অনেক গবেষণা করেছেন। তারা ‘একটি দেশ কেন ধনী এবং আরেকটি দেশ কেন দরিদ্র’, এর কারণ বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তাদের মূল কথা হলো, একটি দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান সে দেশের সাফল্য বা ব্যর্থতার প্রধান নির্ধারক।
এবারের নোবেলজয়ী অর্থশাস্ত্রীদের গবেষণার বিপুল তাৎপর্য রয়েছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কাছে। অ্যাসিমগ্লু, জনসন ও রবিনসনের গবেষণা যে প্রশ্নটির উত্তর সন্ধান করে, তার একটি অভিমুখ যেমন ঔপনিবেশিক অতীতে, অন্যটি তেমনই বর্তমানেও বটে- তাদের গবেষণার সূত্র ধরেই তৈরি হয় প্রশ্ন। ঔপনিবেশিক নীতি দেশে যে প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষতি করেছিল, উপনিবেশ-উত্তর সময়েও তার সংশোধন সম্ভব হয় না কেন? যে উপনিবেশে গঠনমূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিল ঔপনিবেশিক শাসন, সেগুলো সমৃদ্ধির যে পথে অগ্রসর হতে পেরেছে, লুণ্ঠনমূলক প্রতিষ্ঠানের দ্বারা শাসিত হওয়া জনপদগুলো উপনিবেশ-উত্তর সময়ে কেন সেই পথ অনুসরণ করতে পারে না? উন্নয়নের কক্ষপথ পরিবর্তন এত দুষ্কর কেন?
উত্তরটি চমকে দেয়ার মতো নয়, বরং অনুমানযোগ্য- যে দেশে ঔপনিবেশিক আমলে লুণ্ঠনমূলক প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছিল, উপনিবেশ-উত্তর সময়েও সেই দেশে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার হয় না, কারণ সেই ঔপনিবেশিক লুণ্ঠনমূলক প্রতিষ্ঠানের লাভ এই পর্বে পুঞ্জীভূত হয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দেশীয় নেতার হাতে। লুণ্ঠনমূলক প্রতিষ্ঠান শাসকের রং দেখে কাজ করে না; সেই প্রতিষ্ঠানের ধর্ম সম্পদের অসম বণ্টন- ক্ষমতায় যিনিই থাকুন, প্রতিষ্ঠান তার জন্যই কাজ করে। ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানে দেশের শাসনক্ষমতা যদি এমন কারও হাতে যায়, যিনি মানসিক গঠনে অগণতান্ত্রিক, একাধিপত্যবাদী, তবে ঔপনিবেশিক লুণ্ঠনমূলক প্রতিষ্ঠান তার কায়েমি স্বার্থের যন্ত্র হয়ে ওঠে। সেই ক্ষমতা ত্যাগ করার কোনো ‘যুক্তিযুক্ত’ কারণ তার কাছে নেই। সেই শাসকের প্রতি সাধারণ মানুষের অবিশ্বাসও ক্রমেই তীব্রতর হতে থাকে। এই পরিস্থিতিটি পাল্টাতে পারে গণতন্ত্র- এমন ব্যবস্থা, যেখানে শাসনের প্রতিষ্ঠানের চরিত্র বিষয়ে সাধারণ মানুষের মতামত গ্রাহ্য হবে। সেই কারণেই গণতন্ত্র বস্তুটি একাধিপত্যকামী শাসকের চোখের বালি। একনায়কের স্বৈরশাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথটি দুরূহ, বন্ধুর; কিন্তু নোবেলজয়ী অর্থশাস্ত্রীদের মতে, সেপথে যাত্রা সুকঠিন হলেও অসম্ভব নয়। তারা বলেছেন, স্বৈরশাসকের হাতে অনেক কিছু থাকলেও মানুষের হাতে এমন একটি অস্ত্র রয়েছে, যা শাসকের নেই- তা হলো মানুষের সংখ্যা। বিপুল পরিমাণ মানুষ যদি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, তবে এক দিন না এক দিন হীরক রাজার মূর্তি মাটিতে গড়াগড়ি খাবেই।
উপনিবেশ-উত্তর পৃথিবীতে অবশ্য এমন ব্যতিক্রমী দেশও ছিল, যেখানে গণতন্ত্রের সাধনাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামোকেই স্বাধীন দেশেও বজায় রাখার সিদ্ধান্তকে উত্তর-আধুনিক ইতিহাসবিদদের একাংশ যতই ‘প্যাসিভ রেভলিউশন’ আখ্যা দিন, এ কথা অনস্বীকার্য যে, বহুলাংশে নিরক্ষর একটি দেশে সর্বজনীন ভোটাধিকার স্বীকার করে দেশজোড়া সাধারণ নির্বাচনের আয়োজনই ঔপনিবেশিক শাসনের লুণ্ঠনের প্রবণতাকে মুছে ফেলতে চাওয়ার অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ। অবশ্য যে নেতা এ পথে হাঁটতে মনস্থ করেছিলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার ১০ বছর আগে তিনি নিজেই সংবাদপত্রে ছদ্মনামে প্রবন্ধ লিখে নিজের স্বৈরাচারী আচরণের সম্ভাবনা বিষয়ে দেশবাসীকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন! তবে কথাটি হলো, এমন এক নেতার উত্তরাধিকারও দেশকে লুণ্ঠনমূলক প্রতিষ্ঠানের হাত থেকে চিরনিষ্কৃতির নিশ্চয়তা দিতে পারে না। বরং গণতন্ত্রের অপব্যবহার করে উত্থান ঘটেই থাকে এমন সব নেতার, যারা প্রথম সুযোগেই গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করে একাধিপত্যকামী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চান- কখনো কখনো নির্বাচনি গণতন্ত্রের প্রহসনটি বজায় রেখে এবং গণতন্ত্রের মৃত্যুর অনিবার্য ফল বর্তমান প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্রমে লুণ্ঠনমূলক হয়ে ওঠা। তার পরের আখ্যানটি একাধিপত্যকামী শাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের দীর্ঘ ও সুকঠিন লড়াই। অবএব, গণতন্ত্র হারানোর আগে সাবধান হওয়া, কিংবা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনপ্রতিষ্ঠার জন্য অতন্দ্র থাকতে পারা- অতি জরুরি।
টেকসই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অবদান নিয়ে তেমন বিতর্ক নেই। এ ধারণা বাংলাদেশের জন্যও প্রযোজ্য। বাংলাদেশেও একশ্রেণির মানুষের জন্যই সমাজের সব সুযোগ- সুবিধা তৈরি হয়। আর সেই শ্রেণি হলো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের লোকজন। যেমনটি নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ রবিনসন বলেন, উন্নতির জন্য দরকার অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা বণ্টন। সেটি বাংলাদেশে হয়নি। এখানে ক্ষমতার একচেটিয়াকরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশেও টেকসই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হওয়া দরকার।
তবে সাধারণ মানুষ এসব তত্ত্ব বড় বেশি বোঝে না। বুঝতে চায়ও না। সে চায় চাল-ডাল-তেল-লবণ-মরিচের দাম নাগালের মধ্যে থাকুক। যে কাঁচামরিচ গরিবের খুবই প্রয়োজনীয় একটি উপাদান, সেই মরিচ দাম কেন ৩০০-৪০০ টাকা কেজি দরে বিকোবে? এর দাম অবশ্যই সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে, থাকতে হবে। তবেই না ‘অর্থনৈতিক তত্ত্ব’ সার্থক হবে!
চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে