শিল্পেই আমাদের ভবিষ্যৎ
রপ্তানি আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্তম্ভ। আমাদের অর্থনীতি এখন যে রূপ নিয়েছে, তা আসলে ভারতের উন্নয়নের যে ধারা সেটি নয়। আমাদের উন্নয়নের ধারাটি হচ্ছে কার্যত সনাতনি। ম্যানুফ্যাকচারিং খাত নির্ভর ধারা। যেসব দেশ উন্নত হয়েছে, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন তারা মূলত ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের ওপর ভর করেই উন্নত হয়েছে। পূর্ব এশীয় দেশগুলো যেমন সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এগুলোকে ইস্ট এশিয়ান মিরাকল বলা হয়। এসব দেশও ম্যানুফ্যাকচারিং খাতকে গুরুত্ব দিয়ে রপ্তানি নির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশও ম্যানুফ্যাকচারিং খাতকে গুরুত্ব দিয়ে উন্নয়ন কৌশল রচনা করে চলেছে।
গত ১২-১৪ বছরে বাংলাদেশের জিডিপিতে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অবদান ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জিডিপিতে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অবদান ২২ শতাংশ থেকে এখন প্রায় ৩৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। তার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ ক্রমেই ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। একটি লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আনুষ্ঠানিক শ্রম বাজারে নারীর অংশ গ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। আগে নারীরা আনুষ্ঠানিক শ্রম বাজারে খুব একটা প্রবেশের সুযোগ পেতেন না। এখন তারা ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে যুক্ত হচ্ছেন। আনুষ্ঠানিক শ্রম বাজারে নারীর অংশ গ্রহণ এখন প্রায় ৪২ শতাংশের মতো। এখন অসংখ্য নারী উদ্যোক্তা গ্রামে এবং শহরে তাদের উদ্ভাবনী মেধা খাটিয়ে আরও অনেক নারীকে কাজের সুযোগ করে দিচ্ছেন। উদাহরণ হিসেবে জামালপুরের নকশি কাঁথা শিল্পের কথা বলা যায়। এই শিল্পের শত শত উদ্যোক্তা নারী। তারা মিলে হাজার হাজার নারীকে কাজের সুযোগ করে দিয়েছেন। এভাবেই গ্রামীণ ও ‘মেজো’ (মধ্যম পর্যায়ের) অর্থনীতির আধুনিক ধারায় রূপান্তর ঘটছে।
আনুষ্ঠানিক শ্রম বাজারে নারীর বর্ধিত হারে অংশ গ্রহণের কারণে নিঃসন্দেহে নারীর আর্থিক ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সঙ্গে সামাজিক মর্যাদাও আগের তুলনায় অনেকটাই বেড়েছে। সমাজের সর্বস্তরে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। গ্রাম থেকে নারীরা শহরে এসে রাপ্তানিমুখী বিভিন্ন কারখানায় কাজ করছে। তারা উন্নত জীবন ধারণের সুযোগ পাচ্ছে। তারা যখন গ্রামে যাচ্ছে তখন আবার শহরের সুযোগ-সুবিধাগুলো গ্রামে নিয়ে যাচ্ছেন। ফলে গ্রামে শহরায়নের কালচার সৃষ্টি হচ্ছে। সার্বিকভাবে আমরা উন্নত শিল্পায়নের ধারায় এগোচ্ছি। গ্রাম ও শহরের এই সংযোগ অর্থনীতির জন্য খুবই ইতিবাচক। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে। দারিদ্র্যও কমছে।
রপ্তানি খাত আমাদের জন্য নানা কারণেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রপ্তানি খাতের মাধ্যমে যে শুধু মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে তা নয় একই সঙ্গে রপ্তানি খাত আমাদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছে। গ্রামীণ উন্নয়নের ধারায় শহুরে সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটাচ্ছে। এক সময় গ্রামে শহরের যে সব সুযোগ-সুবিধার কথা চিন্তা করা যেতো না এখন তা গ্রামে বসেই পাওয়া যাচ্ছে। শহরের মতো গ্রামীণ অর্থনীতিও এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে। রপ্তানি খাত আমাদের জন্য নতুন শিল্পোদ্যোক্তা তৈরি করছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এমন ব্যক্তিও শিল্পোদ্যোক্তা হচ্ছেন এ ক্ষেত্রে যার কোনো ঐতিহ্য ছিল না। অর্থাৎ অনেকেই পৈতৃক পেশা ছেড়ে শিল্পোদ্যোক্তা হচ্ছেন। তারা বেশ ভালো করছেন। তারা প্রথমে হয়তো ছোট ছোট উদ্যোগ গ্রহণ করছেন এবং পরবর্তীতে অর্জিত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বৃহৎ শিল্প স্থাপন করছেন। তারা এ ক্ষেত্রে সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলতে পারছেন। নতুন যারা উদ্যোক্তা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন তারা অত্যন্ত আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর এবং বিজ্ঞান মনস্ক। এদের অনেকেই তাদের পণ্য রপ্তানি করছেন।
আন্তর্জাতিক বাজারে বিশ্বের অন্যান্য দেশের পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকছেন। বাংলাদেশ থেকে এমন পণ্যও রপ্তানি হচ্ছে যা আগে কল্পনাও করা যেত না। বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা নতুন নতুন পণ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করছেন। সরকারও ধারাবাহিকভাবে এই নতুন উদ্যোক্তাদের সহায়তা করে চলেছেন। তাদের ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধা দেয়া হচ্ছে। সরকার আর্থিক প্রণোদনা ছাড়াও নানা ধরনের নীতি সহায়তা দিয়ে চলেছেন। ব্যাংকগুলোও নতুন উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়ে চলেছে। ফলে নতুন উদ্যোক্তারা নিজেদের বিকশিত করার সুযোগ পাচ্ছেন। আমরা চাইছি শিল্পায়নের এই নতুন ধারা অব্যাহত থাকুক এবং আগামীতে তা আরও বেগবান হোক। পাশাপাশি ইপিজেড, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের আশেপাশের গ্রামেও সম্পূরক শিল্প গড়ে উঠছে। সেখানেও প্রচুর নারী কর্মীর কাজ মিলছে। গ্রামীণ পরিবেশে শিল্পের এই বিকাশ আসলেই দেখার মতো।
এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে, এই রপ্তানি খাতকে আমরা যদি আরও বেগবান করতে চাই তাহলে কি করতে হবে? বাংলাদেশে শুধু বস্ত্র শিল্পের বিকাশ ঘটুক এটা আমরা চাই না। আমরা চাই বস্ত্র শিল্পের পাশাপাশি সম্ভাবনাময় অন্যান্য শিল্পও যেন সমানতালে বিকশিত হতে পারে। বিশেষ করে স্থানীয় কাঁচামাল নির্ভর শ্রমঘন শিল্পের বিকাশ খুবই প্রয়োজন। পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির পাশাপাশি আমাদের জনশক্তি রপ্তানির ওপর আরও জোর দিতে হবে। জনশক্তি রপ্তানি খাত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। জনশক্তি রপ্তানি খাত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে পণ্য রপ্তানি খাতের পরই জনশক্তি খাতের অবস্থান। জনশক্তি রপ্তানি করা হচ্ছে বলেই আমরা রেমিট্যান্স পাচ্ছি। জনশক্তি রপ্তানি খাত এক অর্থে তৈরি পোশাক রপ্তানি খাতের চেয়েও সম্ভাবনাময়।
তৈরি পোশাক রপ্তানি খাতে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয় তার একটি বড় অংশই কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানিতে বিদেশে চলে যায়; কিন্তু জনশক্তি রপ্তানি খাত থেকে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয় তার প্রায় শতভাগই জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করে। একই সঙ্গে প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশি কর্মসংস্থান উপলক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। এরা যদি দেশেই অবস্থান করতেন তাহলে বেকার সমস্যা কোন পর্যায়ে চলে যেত তা ভাবলেও গা শিউরে ওঠে। এদের যদি আরেকটু প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে পাঠাতে পারতাম তাহলে তাদের পাঠানো প্রবাস আয়ের পরিমাণ নিশ্চয় আরও বাড়ানো সম্ভব।
বর্তমানে প্রতি বছর যে রেমিট্যান্স দেশে আসছে তার পরিমাণ কি আরও বৃদ্ধি করা সম্ভব কি না, তা নিয়ে অনেকই প্রশ্ন উত্থাপন করে থাকেন। রেমিট্যান্স বাড়ানোর জন্য কিছু পলিসিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপার আছে। বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর রেমিট্যান্স বৈধপথে দেশে আসবে কি আসবে না, তা অনেকটাই নির্ভর করে। বিনিময় হারের অসামঞ্জস্যতার কারণে অনানুষ্ঠানিক খাতের যে চাহিদা তৈরি হয়েছে, সেটা কতটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করছে রেমিট্যান্স বৈধপথে দেশে আসবে কি না। ব্যাংকিং চ্যানেলের বিনিময় হারের সঙ্গে কার্ব মার্কেটের বিনিময় হারের পার্থক্য যদি অনেক বেশি হয়, তাহলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স দেশে প্রেরণের ক্ষেত্রে আগ্রহী হতেই পারেন। বাস্তবেও তাই হচ্ছে। বিনিময় হারকে তাই বাজারের হারের সঙ্গে যৌক্তিক করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও এ সমস্যাটি বোঝে; কিন্তু এর মোকাবিলা করতে মনে হয় খানিকটা দ্বিধান্বিত। সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে দ্রুত বাস্তবানুগ সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো বিকল্প যে নেই সেটিও তাদের বুঝতে হবে। দেরি করলেই পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। এর পাশাপাশি দেশের ভেতরে বসে অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিং উদ্যোক্তাদের যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং পেমেন্ট সুবিধা আরও সহজ করা গেলে বৈধভাবেই বিদেশ থেকে প্রচুর বিদেশি মুদ্রায় আয়-রোজগারের সুযোগ নিশ্চয় তৈরি করা সম্ভব।
আমাদের বাণিজ্যনির্ভর যে অর্থায়ন, তা কতটা স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যবহার করতে পারছি তার ওপর রপ্তানি বৃদ্ধির বিষয়টি নির্ভর করে। রেমিট্যান্স আনুষ্ঠানিক পথে দেশে আনার ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের কিছুটা ঘাটতি আছে বলেই হয়তো যে পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে আসা উচিত তা আসছে না। বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকগুলোর এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো অবাস্তব বিনিময় হারে ডলার পাঠানোর প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে; কিন্তু বাস্তব কারণেই প্রবাসীদের এই হারে প্রবাস আয় পাঠানোর জন্য উৎসাহী করা মুশকিল হচ্ছে। আনুষ্ঠানিক খাতে রেমিট্যান্স পুরোটা আসছে না তার অর্থ এই নয় যে দেশে রেমিট্যান্স আসছে না। রেমিট্যান্স আসছে অনানুষ্ঠানিক খাতের মাধ্যমে। এই রেমিট্যান্সের বেশির ভাগই গ্রামে যাচ্ছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে নানাভাবে তা ব্যবহৃত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে গ্রামীণ অর্থনীতি বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এক ধরনের ইতিবাচক রূপান্তর ঘটছে। এই রূপান্তরের পেছনে রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ থেকে যারা কর্মসংস্থান উপলক্ষে বিদেশে গমন করেন তাদের অধিকাংশই গ্রাম থেকে আগত। তারা বিদেশ থেকে যে রেমিট্যান্স প্রেরণ করেন তা সরাসরি গ্রামে অবস্থানকারী সুবিধাভোগীদের কাছে চলে যায়। যেহেতু রেমিট্যান্সের মূল গন্তব্য গ্রাম তাই গ্রামে টাকার প্রবাহ বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর প্রভাব আমরা প্রত্যক্ষ করি গ্রামীণ মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে। আগে সাধারণত শহরে মূল্যস্ফীতির হার বেশি থাকত। এখন মূল্যস্ফীতির হার বেশির ভাগ সময় গ্রামীণ অর্থনীতিতে বেশি থাকে। তার অর্থ হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে অর্থের প্রবাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভোগ ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে গ্রামীণ অর্থনীতি ও শহুরে অর্থনীতির মধ্যে খুব একটা ফারাক খুঁজে পাওয়া যায় না। গ্রাম এবং শহরের অর্থনীতির মধ্যে এক ধরনের সমন্বয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। উভয় অর্থনীতির মধ্যে কানেকশন অনেকে বেড়ে গেছে। এই সংলগ্নতা অর্থনীতির সার্বিক বিকাশের জন্য বেশ ভালো।
প্রশ্ন উঠতে পারে, পণ্য রপ্তানি কীভাবে বাড়ানো যায়? এ ক্ষেত্রে আমার বক্তব্য হচ্ছে, প্রচলিত পণ্য রপ্তানি বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি নতুন নতুন পণ্য রপ্তানি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বিশেষ করে যেসব পণ্য স্থানীয় কাঁচামাল নির্ভর সেসব পণ্য রপ্তানি ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে। নতুন নতুন এবং বৈচিত্র্যময় পণ্য রপ্তানি বাড়াতে হবে। আমাদের পণ্য রপ্তানি ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্যাকেজিং ও ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে আরও কাজ আমাদের করতে হবে। এগুলো দূর করার চেষ্টা করতে হবে। যেমন বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য সীমিতসংখ্যক পণ্য এবং সামান্য কিছু দেশ ও অঞ্চলকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। তৈরি পোশাক রপ্তানি পণ্য তালিকার শীর্ষে রয়েছে; কিন্তু তৈরি পোশাক শিল্প শতভাগ স্থানীয় কাঁচামাল নির্ভর নয় বলে জাতীয় অর্থনীতিতে এই খাতের মূল্য সংযোজনের হার তুলনামূলকভাবে কম। সে বিবেচনায় পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, চা, হিমায়িত খাদ্য ইত্যাদি খাত জাতীয় অর্থনীতিতে তুলনামূলকভাবে বেশি মূল্য সংযোজনে সক্ষম। এসব পণ্য রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।
এ ছাড়া নতুন নতুন এবং সম্ভাবনাময় পণ্য খুঁজে বের করে তা রপ্তানির উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। নতুন নতুন পণ্য রপ্তানি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা গেলে রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ সম্ভব হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এদিকটায় নজর দিতে শুরু করেছে। এটি ভালো লক্ষণ। বাংলাদেশে এমন অনেক পণ্য আছে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে খুব সহজেই স্থান করে নিতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রাপ্তানি বাড়ানোর জন্য আমাদের রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আমাদের রপ্তানি বাড়ানোর জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আগামীতে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশকে পণ্য রাপ্তানির ক্ষেত্রে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে। বিশেষ করে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ যখন উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হবে তারপর থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা রহিত হয়ে যাবে। সেই অবস্থায় আমাদের আন্তর্জাতিক বাজারে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে। সেই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য আমাদের এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। সেজন্যে সরকার বেশ কিছু প্রস্তুতিমূলক কাজ করছে।
উন্নয়নশীল দেশে উন্নত হবার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে। সেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা কি করা সম্ভব তারও পথনকশা তৈরি করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর এই কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে। একাধিক বিশেষজ্ঞ কমিটি এ নিয়ে কাজ করছে। একই সঙ্গে আমাদের পরিবেশবান্ধব পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির ওপর বেশি জোর দিতে হবে। কারণ আগামীতে আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকতে হলে পরিবেশের জন্য অনুকূল এমন পণ্য রপ্তানি করা ব্যতীত কোনো গত্যন্তর নেই। এক্ষেত্রে পাট ও পাটজাত পণ্য আমাদের জন্য সহায়ক হতে পারে। পাটপণ্যের বহুমুখী ব্যবহার উদ্ভাবন করতে হবে। আগামীতে প্যাকেজিং শিল্পে পাটের মতো পরিবেশবান্ধব পণ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। এই সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য আমাদের তৎপর হতে হবে।সম্প্রতি একজন গবেষক পাট থেকে প্লাস্টিক পণ্য উৎপদনের জন্য কিছু কাজ করেছেন। আর একজন গবেষক পাট এবং তুলার মিশ্রণ ঘটিয়ে সুতা তৈরির চেষ্টা করে বেশ কিছুটা সফল হয়েছেন। এসব উদ্যোগকে উৎসাহিত এবং সহযোগিতা করতে হবে। এ জন্য আরঅ্যান্ডডি খাতে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো এর সঙ্গে যুক্ত করা গেলে খুব ভালো হয়।
লেখক: অর্থনীতিবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।
অনুলিখন: এম এ খালেক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে