আমাদের মিশন কৃষকের সম্পদ বৃদ্ধি করা
ড. এফ এইচ আনসারী স্বনামধন্য কৃষি উন্নয়ন ব্যক্তিত্ব। তিনি দেশে-বিদেশে কৃষি উন্নয়ন, গবেষণা, বিক্রয়, বিপণন ও বহুজাতিকীকরণে নিরলস কাজ করছেন। তাছাড়া তিনি কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের পরিচালক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য। এগ্রি বিজনেসের নেতৃস্থানীয় এই ব্যক্তিত্ব ৩৬ বছর ধরে এ পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বীজ, সার, ক্রপ কেয়ার, ফার্ম মেকানাইজেশন, এনিমেল হেলথ এবং সমন্বিত পোলট্রিসহ এগ্রি বিজনেসের বিভিন্ন সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছেন। গত ২৩ বছর ধরে এসিআই গ্রুপের শীর্ষস্থানীয় পদে দায়িত্ব পালন করছেন ড. এফ এইচ আনসারী। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থা ও কৃষি আধুনিকায়ন প্রেক্ষাপট নিয়ে ‘ভিউজ বাংলাদেশ’-এর মুখোমুখি হয়েছেন। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ প্রকাশিত হলো শেষ পর্ব:
তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক এম এ খালেক ও ভিউজ বাংলাদেশের সহযোগী সম্পাদক গিরীশ গৈরিক।
ভিউজ বাংলাদেশ: আমাদের মাংসের চাহিদা এখন অনেকটা পূরণ করে পোলট্রি ফার্ম; কিন্তু অভিযোগ আছে পোলট্রি ফার্মের ফিডিং তত মানসম্মত নয়। এটা উন্নত করতে হলে আমাদের কী করতে হবে?
এফ এইচ আনসারী: আমাদের দেশের পোলট্রি ফার্মগুলোতে দূষিত খাবার আসে এরকমটা আমরা চার-পাঁচ বছর আগে শুনেছিলাম। একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে, পোলট্রি ফার্মে আমরা যে মাংস উৎপাদন করি, পঁয়ত্রিশ দিনে এটা প্রায় এক থেকে দেড় কেজি হয়ে যায়। এই গ্রোথটা হয় কেন? কারণ প্রোটিন-সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানো হয়। এই খাবারে যে উপাদানগুলো থাকে সেগুলো বিষাক্ত না। এগুলোতে ভালো প্রোটিন থাকে। যার কারণে এগুলো দ্রুত গ্রোথ হচ্ছে। এক কেজি পোলট্রি করতে প্রায় ওয়ান পয়েন্ট থ্রি, ওয়ান পয়েন্ট ফোর কেজি প্রোটিন খাওয়াতে হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে দুই কেজি প্রোটিন খাওয়ালে এক কেজি পোলট্রি পাওয়া যায়। এখন এক কেজি আর সোয়া কেজির মধ্যে অনেক পার্থক্য। যারা খাবারে দূষিত কিছু দিবে তারা কত আর দিবে? খুব বেশি সস্তায় তারা দিতে পারবে না। যার ফলে যে রিউমারটা আমরা শুনি এটা খুব বেশি ভেলিড না। কারণ এক কেজির একটা মুরগি পেতে এক কেজি প্রোটিন দিতেই হবে। যারা ফার্মে মুরগি পালে তারা তো নিজেরা খাওয়ার জন্য পালে না, বাজারে বিক্রি করার জন্যই পালে। এখন তারা যদি দেখে এক কেজি, সোয়া কেজি খাবার খাইয়ে পঁয়ত্রিশ দিনে এক কেজি মুরগি পাচ্ছি, আর দুই কেজি খাবার খাইয়ে একই সময়ে এক কেজি মুরগি পাচ্ছি তাহলে তারা তো ওটা কোনোদিন কিনবে না।
প্রথমদিকে অনেকেই হয়তো চেয়েছিল, পরে দেখে যে ভালো কোনো ফল বয়ে আনছে না, যার ফলে এটা বাদ দিয়েছে। আমার মনে হয় না তারা এ নিয়ে পরবর্তীতে চিন্তা করছে। বাজারে মাত্র পাঁচ-ছয়টা কোম্পানির খাবার প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হয়। আমরাই বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৪ লাখ ৬০-৭০ হাজার টন প্রাণী খাদ্য বিক্রি করি। এরকম সাতটা-আটটা কোম্পানি আছে, যারা আরও বেশি প্রাণী খাদ্য উৎপাদন করে ও বিক্রি করে। এটা কী করে সম্ভব হয়েছে? কারণ, আমরা যে সব খাবার দিয়েছি, যে কোয়ালিটি দিয়েছি এগুলোর বেনিফিট খামারিরা বুঝতে পেরেছে। লাভবান হচ্ছে বলেই কিন্তু তারা এগুলো ব্যবহার করছে। আমি নিশ্চিত করি যে, কোনোরকম দূষিত খাবার ব্যবহার করে মুরগি চাষ করা সম্ভব নয়। এটা একেবারেই অবান্তর। এটা একটা রিউমার।
ভিউজ বাংলাদেশ: গরুর মাংসের প্রতি আমাদের দেশের মানুষের এক ধরনের ফ্যাসিনেশন আছে; কিন্তু যে পরিমাণ গরু উৎপাদিত হয় তা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। ফলে গরু মোটাতাজা করার জন্য খামারিরা অনেকরকম কেমিক্যাল ব্যবহার করে বলে শুনতে পাই। যার কারণে গরু ফুলে যায়, তার মাংস বেড়ে যায়; কিন্তু এতে তো স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে। এই ঝুঁকি রোধ করতে হলে আমাদের করণীয় কী?
এফ এইচ আনসারী: কোনোভাবেই এ ধরনের প্রোডাক্ট ব্যবহার করা একেবারেই ঠিক না। সবচেয়ে ইম্পর্টেন্ট হলো গরু পালার সময় আমাকে স্বাস্থ্যকর খাবার দিতে হবে। ভ্যাকসিন লাগলে ভ্যাকসিন দিতে হবে। হাইজেনিক মেইনটেনেন্স নিশ্চিত করতে হবে। এটা ইম্পর্টেন্ট একটা সায়েন্স। আমাদের দেশীয় জাতের গরুগুলোকে ১২ কেজি খাওয়ালে ১ কেজি মাংস পাওয়া যায়। আমাদের দেশে একটা ভালো জাত আছে, ব্রাহমা, এটাকে ৭ কেজি খাওয়ালে ১ কেজি মাংস পাওয়া যায়। পার্থক্য কিছুই নাই, দুটো জাত শুধু। আমাদের দেশের সরকার যদি একটা পলিসি করতো, এগুলো পালতে-পুষতে-উৎপাদন করতে সাপোর্ট দিত, তাহলে যেসব দেশি গরুর গ্রোথ কম সেগুলো আর আমাদের দেশের খামারিরা পালতো না। দেখা যেত যে একটা ভালো জাত থেকে সাড়ে চারশ, পাঁচশ টাকা খরচ করে এক কেজি মাংস উৎপাদন সম্ভব হতো। অনেক কম দামে মাংস বেচা সম্ভব হতো। এটা সরকারের একটা পলিসির ব্যাপার। আমি মনে করি এই পলিসিটাকে সাপোর্ট দেয়া উচিত। গরুর মাংস আমাদের দেশে খুবই প্রিয়, এর চাহিদাও বেশি। এটা হলে মাংসের চাহিদা অনেকখানি ভালোভাবে পূরণ হতো। এতে মাংসের দামও কমতো। যারা ভাবে যে হরমোন বা অন্যান্য ট্রিটমেন্ট করে মাংসের উৎপাদন বাড়াতে হবে তাহলে তারাও এটা করত না। আমি মনে করি সরকারের এমন একটা পলিসি করা উচিত যাতে ব্রাহমা জাতটাতে খুব দ্রুত পরিচিত করে তোলা যায়।
ভিউজ বাংলাদেশ: বাংলাদেশে এখনো অনেকটা ট্রেডিশনাল পদ্ধতিতে চাষাবাদ হয়। আধুনিক পদ্ধতি কিছুটা পরিচিতি পেলেও খুব একটা পায়নি বলা যায়। বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে আধুনিক কৃষিব্যবস্থায় আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছি। এ ক্ষেত্রে প্রাইভেট কোম্পানিগুলো কী করতে পারে?
এফ এইচ আনসারী: ধান উৎপাদনে আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার অনেকটাই শুরু হয়েছে। একদম ইরোগেশন থেকে ধান তোলা, ধান মাড়াই সবই এখন আধুনিক যন্ত্রে করা যায় আমাদের দেশে। অন্যান্য ফসলে আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। পোলট্রি ফার্মে আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার হচ্ছে। আমাদের দেশে পোলট্রি ফার্মে যেসব যন্ত্র ব্যবহৃত হয় তা উন্নত দেশগুলোর মতোই আধুনিক। এসিআই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। ট্রাক্টরে আমাদের মার্কেট শেয়ার ফিফটি পার্সেন্ট। কমবাইন্ড হারভেস্টে আমাদের মার্কেট শেয়ার ফোরটি থ্রি পার্সেন্ট। রাইস ট্রান্সপ্লান্টারে আমাদের মার্কেট শেয়ার সেভেনটি পার্সেন্ট। মিল্কিংয়ের ক্ষেত্রে আমরা এখন অনেক আধুনিক যন্ত্র দিচ্ছি। তার মানে ওভারঅল আমরা যেমন যন্ত্র সরবরহা করছি, পাশাপাশি আমরা খামারিদের যন্ত্র মেরামতের সেবাও দিচ্ছি। কোনো খামারি যদি আমাদের কোনো যন্ত্র ব্যবহার করে এবং সেটা যদি কোনো কারণে ডিস্টার্ব দেয় তাহলে ছয় ঘণ্টার মধ্যে আমাদের লোক গিয়ে সেটা ঠিক করে দিয়ে আসে।
ভিউজ বাংলাদেশ: একটি সুইস বহুজাগতিক কোম্পানিতে বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে আপনার কর্মজীন শুরু ১৯৮১ সালে। বর্তমানে বাংলাদেশে কৃষি সেক্টরে আপনি আইকন হিসেবে পরিচিত। এই যে আপনার যাত্রা, এই যাত্রার গল্প আমরা একটু জানতে চাই।
এফ এইচ আনসারী: ১৯৮১ সালে আমি যখন কর্মজীবন শুরু করলাম তখন ভাবলাম আমাকে অনেক এগোতে হবে। এই আগাতে গিয়ে আমি কৃষির কথা ভাবলাম। আমি চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে পারতাম। আমার রেজাল্ট অনেক ভালো ছিল; কিন্তু ভাবলাম কৃষিতে অনেক কিছু করার আছে। মনে হলো কষ্ট করলে এটা অনেক ভিজিবল করা যাবে। এক্সটলি তাই হলো। তিন বছরের মধ্যে আমি মোটামুটি একটা ভালো অবস্থায় চলে গেলাম। প্রথম দিকে সেলসে ছিলাম, পরে স্ট্রাটিজিকে চলে গেলাম। স্ট্রাটিজিকে যাওয়ার সুবিধা হলো এই, ওভারঅল কোম্পানিতে একটা ডিরিকশন দিতে পারলাম। কমিউনেশক এবিলিটি ইম্পোর্ভ করতে পারলাম। কমিউনিকেশন টুল বানাতে পারলাম। আমরা যেসব আইডিয়া দিতে চেয়েছিলাম তা খুব দ্রুত দিতে পারলাম। লাভ হলো কোম্পানিগুলোর। ব্যবসা বড় হলো। আমাকে আরও বেশি আইডেন্টিফাই করতে পারল। তারা ভাবলো যে আমার লিডারশিপ কাজ করছে। অ্যাট দ্য সেম টাইম আমাদের দেশের খামারিরাও অনেক বেশি প্রফিটেবল হতে শুরু করল।
অতি অল্প সময়ের মধ্যে আমি এই কোম্পানির মার্কেটিংয়ের হেড হয়ে গেলাম। পরবর্তীতে আমি একটা দেশীয় কোম্পানিতে জয়েন করলাম। সেখানেও কৃষি বিভাগে। ওই কৃষি বিভাগে দুই বছর কাজ করলাম। ওই কোম্পানির ব্যবসা খুব বড় ছিল না। ছোট ব্যবসা। ওই ব্যবসাকে অনেক বড় করলাম। পরে দেখলাম আমাদের একটা দেশি কোম্পানি এসিআই, এর ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল ব্রিটিশ- আইসিআই, এই কোম্পানি চিন্তা করছে কৃষিতে কাজ করবে, আমি ভাবলাম কৃষিতে আরও ভালো করতে হলে এই সংস্থা দরকার। এসিআইয়ের যথেষ্ট রিসোর্স আছে, এসিআইয়ের চেয়ারম্যানের ভিশন অনেক বড়, তিনি সোসাইটিকে পারফেক্ট হিসেবে নিয়েছেন, মিশনটা অনেক বড়, আমি ভাবলাম এখানে আসলে অতি অল্প সময়ে এই পেনিটেশনটাকে বাড়াতে পারব। অনেক বেশি খামারি উপকৃত হবেন। তার সঙ্গে আমিও অনেক উপরে উঠতে পারব।
এভাবে গত ৩০ বছর কাজ করার কারণে এসিআই বাংলাদেশে এক নম্বর কোম্পানি হয়ে গেছে। আমাদের মিশন অনেক পাওয়াফুল। আমাদের মিশন কৃষকের সম্পদ বৃদ্ধি করা। এ দেশে যেহেতু ৪০ ভাগ কৃষক, এ দেশের ৭০ ভাগ লোক গ্রামে আছেন। কৃষি কাজের মাধ্যমে আমরা যদি গ্রামের মানুষের জীবনমান বৃদ্ধি করতে পারি তাহলে কী হবে? বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতি বৃদ্ধি পাবে। দেশ উপকৃত হবে। খামারিরাও ভালো থাকবে। কৃষি উন্নতি হবে। মিডিয়ার লোকজন আমাদের যথেষ্ট সাপোর্ট দেয়, তাতেও আমরা অনেক উপকৃত হয়েছি।
আরো পড়ুন
প্রথম পর্ব:উৎপাদন বাড়াতে হলে কৃষিব্যবস্থা আরও উন্নত করা জরুরি
দ্বিতীয় পর্ব:নদীর ও চাষের মাছের মধ্যে পার্থক্য করা আজকাল খুবই কঠিন
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে