এই মৌসুমে কক্সবাজার উপকূলে ডিম পাড়তে এসে শতাধিক কচ্ছপের মৃত্যু
কক্সবাজারের সাবরাং থেকে নাজিরারটেক উপকূলে প্রজননে এসে মারা পড়ছে অলিভ রিডলি। গত চার দিনের অনুসন্ধানে ৮৬ কচ্ছপের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বোরি) একদল গবেষক। প্রজনন মৌসুমে সৈকতে ডিম পাড়তে এসে মারা পড়ছে অলিভ রিডলি বা জলপাই রঙা সামুদ্রিক এই কচ্ছপ।
এছাড়াও কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলের সেন্টমার্টিন, সোনাদিয়া ও কুতুবদিয়াসহ বিভিন্ন উপকূলে আরও ৪০টির মতো মৃত কচ্ছপ ভেসে এসেছে বলে জানান স্থানীয়রা।
গত কয়েকদিন ধরে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলের টেকনাফের সাবরাং থেকে নাজিরারটেক পর্যন্ত প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকায় বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের একদল বিজ্ঞানী সরেজমিন পরিদর্শন করে ৮৬টি কচ্ছপের মৃতদেহ দেখতে পেয়েছেন।
গত বছর প্রজনন মৌসুমেও একই সময় কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে মৃত মা কচ্ছপ ভেসে এসেছিল। এসব কচ্ছপের বেশিরভাগ ছিল অলিভ রিডলি প্রজাতির। অধিকাংশ কচ্ছপের পেটে ডিম ছিল। গত বছরের তুলনায় এ বছর কচ্ছপ মারা পড়ার হার অস্বাভাবিক বলে জানিয়েছেন এই গবেষক দল।
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বোরি) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শিমুল ভূঁইয়া বলেন, গত কয়েকদিনে ভেসে এসেছে ৮৬টি মৃত কচ্ছপ। উদ্ধার হওয়া কচ্ছপ সবকটিই অলিভ রিডলি বা জলপাই রঙা কচ্ছপ জানিয়ে বোরির এই বৈজ্ঞানিক কমকর্তা বলেন, মৃত কচ্ছপের মধ্যে পুরুষ ও স্ত্রী কচ্ছপ রয়েছে। এসব কচ্ছপ এক থেকে দুই দিন বা তারও আগে মারা পড়েছে। কিছু কচ্ছপের মৃত্যু এক সপ্তাহ বা ১০-১২ দিন আগে মারা গেছে।
মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে মৃত কচ্ছপের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানান এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। মোহাম্মদ শিমুল ভূঁইয়া বলেন, ‘নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজনন মৌসুম। এ সময় সমুদ্র উপকূলের বালিয়াড়িতে ডিম দিতে আসে মা কচ্ছপ। কচ্ছপগুলো জেলেদের জালে আটকা পড়ে, সমুদ্রে বড় নৌযানের ধাক্কা বা অন্যকোনো আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মারা পড়ছে।
অলিভ রিডলি বা জলপাই রঙের সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজননক্ষেত্র কক্সবাজারের সোনাদিয়া থেকে সেন্টমার্টিন সমুদ্র উপকূলের সৈকতের বালিয়াড়ি। প্রজনন মৌসুমে (নভেম্বর থেকে মার্চ) এ প্রজাতির কচ্ছপ দল বেঁধে হাজারো মাইল পাড়ি দিয়ে বালিয়াড়িতে ডিম পাড়তে আসে। কিন্তু দুই দশক ধরে এদের প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস হওয়া এবং আসার পথে নানা বাধায় প্রতি বছর মারা পড়ছে স্ত্রী কচ্ছপ।
কক্সবাজারে কচ্ছপের প্রজনন ও সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করছে নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (নেকম)। এই সংস্থার ২০০৩ সালে এক জরিপে দেখা গেছে, কক্সবাজার উপকূলের ৫২ পয়েন্টে সামুদ্রিক মা কচ্ছপ ডিম দিতে আসত। ওই সময় এসব পয়েন্ট মা কচ্ছপের কাছে অত্যন্ত নিরাপদ পয়েন্ট ছিল। তবে এখন এই সংখ্যা ৩০ থেকে ৩২ ঠেকেছে।
নেকমের উপপ্রকল্প পরিচালক ড. শফিকুর রহমান জানান, মা কচ্ছপের ডিম দেয়ার সময় সাধারণত নভেম্বর থেকে শুরু হলেও এখন এপ্রিল-মে পর্যন্ত চলে। রাতের বেলায় নির্জন উপকূলে এসে গর্ত তৈরি করে ডিম দেয়। এরপর মা কচ্ছপ ফিরে যায় সাগরে।
৬০ থেকে ৬৫ দিনের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে ডিম থেকে বাচ্চা জন্ম নেয়। এরপর বাচ্চাগুলো গর্ত থেকে বের হয়ে সাগরে ফিরে যায়।
কচ্ছপের ডিম পাড়ার স্থানগুলো কুকুর-শিয়াল বা অন্য কোনো প্রাণী যাতে নষ্ট করতে না পারে তার জন্য নেকমের মাধ্যমে পাহারা ও ঘেরবেড়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
শফিকুর রহমান বলেন, কক্সবাজারের সোনাদিয়া থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপ পর্যন্ত সৈকতের নির্জন এলাকায় কচ্ছপ দল বেঁধে ডিম দিত। অপরিকল্পিত পর্যটন, অবকাঠামো নির্মাণ, সৈকতে আলোকায়ন, সমুদ্রে পরিত্যক্ত জাল ফেলে দেয়াসহ নানা কারণে কচ্ছপ প্রজনন মৌসুমে বাধা পাচ্ছে।
সাম্প্রতিক কক্সবাজার সৈকতে প্রজননে এসে সামুদ্রিক কচ্ছপ মারা পড়ার ঘটনা উদ্বেগজনক বলে মনে করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর।
তিনি বলেন, ‘অপরিকল্পিত পর্যটন ও স্থাপনা, বনায়ন, কুকুর-শিয়ালের আক্রমণ, বেলাভূমি ধ্বংস, সমুদ্রতীরে বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবহারসহ মানুষের নানা অসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের কারণে সামুদ্রিক কচ্ছপ ডিম পাড়তে এসে মারা পড়ছে। পাশাপাশি তাদের ডিম পাড়ার স্থান বিনষ্ট ও হুমকির মুখোমুখি হয়েছে। তা ছাড়া সাগরে জেলেদের ফেলানো বিভিন্ন ধরনের জাল এবং ঘোস্ট নেট বা পরিত্যক্ত জালের কারণে প্রজননক্ষেত্র অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। অলিভ রিডলিকে প্রাকৃতিক কারণেই নিজ জন্মভূমিতে ডিম পাড়তে আসতে হয় বলেই সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে এই উপকূলে এসে ডিম পাড়ে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই দশক ধরে প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস হওয়া এবং আসার পথে নানা বাধায় প্রতি বছর মারা পড়ছে স্ত্রী কচ্ছপ। গত বছর থেকে মৃত্যুর এই হার অস্বাভাবিক। চলতি মৌসুমে এরই মধ্যে শতাধিক কচ্ছপ মারা পড়েছে।
এভাবে কচ্ছপ মারা পড়লে সমুদ্রের ইকো সিস্টেম নষ্ট হয়ে যাবে বলে জানান গবেষক শিমুল ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ‘অলিভ রিডলি কাছিম সমুদ্রের হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দেয়ার সময় বার্নাকল, ক্রাস্টেসিয়ান এবং অন্যান্য ছোট প্রাণীরা তাদের গায়ে আশ্রয় নেয় এবং শিকারির হাত থেকে রক্ষা পায়। এরা সী গ্রাস ও শেওলা খেয়ে সমুদ্রের পরিবেশ পরিষ্কার রাখে। এরা অমেরুদণ্ডী প্রাণী যেমন জেলিফিশ, পোকামাকড় খেয়ে সমুদ্রের পরিবেশ ঠিক রাখে।
সমুদ্রে জেলিফিশের পরিমাণ বাড়লে জেলেরা সমুদ্রে মাছ কম পায় এবং কচ্ছপের কারণে সমুদ্রে মাছের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
মা কাছিম যখন বিচে এসে ডিম পাড়ে তখন তারা বালি ও গাছপালার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি সরবরাহ করে। ডিমের খোসা সার হিসেবে কাজ করে এবং উপকূলের বালির স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করে ভাঙন রোধে সহায়তা করে।
সমুদ্রের ইকো সিস্টেম ব্যালেন্স করার জন্য অলিভ রিডলি বা জলপাই রঙা কচ্ছপ রক্ষার বিকল্প নেই। তাই এই কচ্ছপের প্রজনন স্থান রক্ষা এবং জেলেদের সচেতনতা বাড়াতে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে