ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে বিনিয়োগবান্ধব অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করুন
কোটা সংস্কারের আন্দোলনের লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘটনা। ১ জুলাই শিক্ষার্থীরা যখন কোটা সংস্কারের লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করে, তখন তা ছিল শান্তিপূর্ণ এবং অহিংস আন্দোলন; কিন্তু পরবর্তীতে আন্দোলন আর অহিংস থাকেনি। বিশেষ করে মধ্য জুলাইতে এসে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সহিংস রূপ ধারণ করে। এক পর্যায়ে বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন, মেট্রোরেল, সড়ক ভবনসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার হামলা চালিয়ে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় কারা হামলা চালিয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কারণ শিক্ষার্থীরা দাবি করেছেন, তারা কোনো রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় হামলার সঙ্গে জড়িত নয়। তাই বিষয়টি নিয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না।
আন্দোলন সহিংসরূপ ধারণ করলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা তা কঠোর হস্তে দমনের চেষ্টা করে। এতে অনেক তাজা প্রাণ অকালে ঝরে যায়। কারও কারও মতে, মৃতের সংখ্যা তিন শতাধিক। এদের মধ্যে শিক্ষার্থীদের সংখ্যাই বেশি। বেশ কিছু শিশু-কিশোর নিহত হয়েছে। আন্দোলনকালে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ নিহত হবার ঘটনা সত্যিও দুঃখজনক। কোনোভাবেই এটি মেনে নেয়া যায় না। আর মৃতের কোনো আর্থিক মূল্যায়ন করা যায় না। যার সন্তান বা ভাই হারিয়েছে একমাত্র তিনিই বোঝেন এই ক্ষতি কতটা ভয়াবহ এবং অপূরণীয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কোনো শিক্ষার্থী আন্দোলনে এত বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটেনি। এবারের শিক্ষার্থী আন্দোলন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকেও ছিল ব্যতিক্রম। সরকারি চাকরিতে কোটা সুবিধা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত তা এক দফা দাবিতে পরিণত হয়। সেই দাবি ছিল প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সব মন্ত্রীর পদত্যাগ।
শিক্ষার্থী আন্দোলনের কারণে দেশের অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বেশ কয়েকদিন দেশের সব কলকারখানা এবং উৎপাদন যন্ত্র কার্যত বন্ধ ছিল। পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয়, একমাত্র কৃষি খাত বাদ দিয়ে অন্যান্য সব খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারও কারও মতে, আন্দোলনের কারণে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তার পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকা থেকে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এটা ক্ষতির চূড়ান্ত হিসাব নয়। কারণ এখনো সরকারিভাবে ক্ষয়-ক্ষতির কোনো পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়নি। তবে সাধারণ দৃষ্টিতে এটা অনুধাবন করা যায় যে, আন্দোলনের কারণে অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে আমাদের অনেক দিন সময় লাগবে। এমনিতেই দেশের অর্থনীতি বর্তমানে নানা জটিল সমস্যার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করছে। তার ওপর আন্দোলনকালিন আর্থিক ক্ষতি দেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় ধাক্কা হিসেবে বিবেচিত হবে। আগামীতে অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে এই ক্ষতি পুষিয়ে নেবার চেষ্টা করতে হবে।
বাংলাদেশ গত প্রায় দুই বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রবণতা মোকাবিলা করে চলেছে। বিদ্যমান মূল্যস্ফীতির গড় হার সাড়ে ৯ শতাংশ। কোনোভাবেই মূল্যস্ফীতিকে কমিয়ে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা যাচ্ছে না। চলতি অর্থবছরের জন্য বাস্তবায়নাধীন বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের জন্য যে মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সেখানেও মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে; কিন্তু শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পাবে। ফলে মূল্যস্ফীতি হ্রাসের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা আবারও বিঘ্নিত হবে। জুলাই মাসের মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যান পাওয়া গেলে বুঝা যাবে তা কোন দিকে যাচ্ছে।
ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় লাল তালিকাভুক্ত করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, গত ১২ মাসের মধ্যে ৭ মাসই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিটের ওপরে ছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ, যা এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। অর্থবছরের কোনো সময়ই মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের নিচে নামেনি। করোনা-উত্তর ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। সেই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পলিসি রেট বৃদ্ধিসহ নানা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে সমর্থ হয়। বর্তমানে দেশটির মূল্যস্ফীতির হার ৩ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। এমন কি শ্রীলঙ্কার মতো সমস্যাগ্রস্ত দেশও তাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে ২০২২ সালে সৃষ্ট ৭৯ দশমিক ৮০ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৪০ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। শিক্ষার্থী আন্দোলনের কারণে অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে, তাতে আগামীতে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। তাই এই মুহূর্তে সর্বাধিক বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে মূল্যস্ফীতি কীভাবে দ্রুত কমিয়ে আনা যায় তার ব্যবস্থা করা। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় সাধারণ মানুষ বড়ই বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে।
এই মুহূর্তে অর্থনীতির আর একটি বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের স্ফীতি ক্রমেই কমে যাওয়া। কোনোভাবেই বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ প্রত্যাশিত মাত্রায় বাড়ানো যাচ্ছে না। অবস্থা এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে মারাত্মক সমস্যায় পড়তে হতে পারে। গত এক বছরে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কমেছে ১ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড (আইএমএফ) এর হিসাব পদ্ধতি মোতাবেক গত জুলাই মাস শেষে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪৮ কোটি মার্কিন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ গঠনে পণ্য রপ্তানি আয় ও জনশক্তি রপ্তানি আয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে; কিন্তু বর্তমানে এই দুটি খাতের অবস্থা খুব একটা ভালো নেই। গত জুলাই মাসে যে রপ্তানি আয় দেশে এসেছে তা আগের দুমাসের তুলনায় কম। মে, ২০২৪ মাসে ৪২৭ দশমিক ৩ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করা হয়েছিল। জুন মাসে এটা ছিল ৩৮৮ দশমিক ৬০ কোটি মার্কিন ডলার। আর জুলাই মাসে রপ্তানি বাবদ আয় হয়েছে ৩৮১ দশমিক ৯ কোটি মার্কিন ডলার। প্রবাসী আয় আসার ক্ষেত্রেও সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। আন্দোলনের কারণে রাজধানীসহ সারা দেশে কারফিউ দেয়া হয়। তিন দিন সরকারি ছুটি ছিল। ইন্টারনেট সেবা বন্ধ ছিল বেশ কয়েকদিন। সব মিলিয়ে রেমিট্যান্স প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। জুলাই মাসে যে রেমিট্যান্স দেশে এসেছে তা আগের ১০ মাসের তুলনায় কম। এদিকে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকের মাঝেই ব্যাংকিং চ্যানেলের পরিবর্তে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রেরণের প্রবণতা বাড়ছে। আন্দোলন চলাকালে একটি মহল প্রবাসী বাংলাদেশিরা যাতে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স দেশে প্রেরণ না করে সে ব্যাপারে প্রচারণা চালায়। এই অবস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণ না ঘটানো গেলে আগামীতে রেমিট্যান্স প্রবাহে সংকট সৃষ্টি হতে পারে।
আগামীতে নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতের সংস্কার এখন খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। ব্যাংকিং খাত সংস্কারের জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিশন গঠন করা যেতে পারে। একই সঙ্গে এই খাতে বিদ্যমান পর্বত প্রমাণ খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মোতাবেক দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকার মতো; কিন্তু এটা খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিসংখ্যান নয়। অবলোপনকৃত ঋণাঙ্ক, মামলাধীন প্রকল্পের নিকট দাবিকৃত ঋণাঙ্ক এবং পুনঃতপশিলীকৃত ঋণ হিসাব যোগ করা হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ পৌনে ৪ কোটি টাকা হবে বলে অনেকেই মনে করেন। বর্তমানে ব্যাংকিং সেক্টর যে তারল্য সংকট প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে তার পেছণে খেলাপি ঋণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
সার্বিকভাবে আর্থিক খাত সংস্কারের জন্য এক বা একাধিক শক্তিশালী কমিশন গঠন করা যেতে পারে। বন্ড মার্কেট, স্টক মার্কেট যাতে সঠিকভাবে তাদের ভূমিকা পালন করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে স্টক মার্কেট যদি ভালোভাবে কাজ করে তাহলে দীর্ঘমেয়াদি ঋণদানের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর পর চাপ অনেকটাই কমে যেত।
বাংলাদেশের রাজস্ব খাতের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। কোনো বছরই কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় রাজস্ব আহরণ করা যাচ্ছে না। ফলে বিভিন্ন উন্নয়ন ব্যয় মেটানের জন্য সরকারকে স্থানীয় ও বিদেশি উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়। বর্তমানে আমাদের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও ৮ শতাংশের কম। অথচ আমাদের আশপাশের দেশগুলোর ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও আমাদের তুলনায় অনেক বেশি। ট্যাক্স আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। ট্যাক্সেও পরিমাণ বৃদ্ধির পরিবের্তে ট্যাক্স নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি এবং আদায় ব্যবস্থাকে আরো স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতে হবে।
সাম্প্রতিক শিক্ষার্থী আন্দোলন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের বার্তা দিয়েছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সেই দেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হন না। একজন বিদেশি বিনিয়োগকারী কোনো দেশে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে তার পুঁজির নিরাপত্তা এবং পর্যাপ্ত মুনাফার বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ইমেজ বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা চালাতে হবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)।
অনুলিখন: এম এ খালেক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে