৪২ লাখ মামলার জটে জর্জরিত বিচারালয়
মামলার ভারে জর্জরিত দেশের সব আদালতে প্রতিদিনই জমা হচ্ছে নতুন নতুন মামলা। যে কারণে কিছুতেই কমছে না মামলার জট। সুপ্রিম কোর্ট ও বিভিন্ন বিচারিক আদালতে বর্তমানে ৪২ লাখেরও বেশি মামলা বিচারাধীন। মামলার দীর্ঘসূত্রতা, অযাচিত মামলা, করোনা মহামারি চলাকালে দুই বছর বিচারকাজ বাধাগ্রস্ত, অনেক ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীদের কালক্ষেপণের মতো কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন আইনজ্ঞরা।
২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের আদালতগুলো ৪২ লাখ ৮ হাজার ২০৬টি মামলা বিচারাধীন ছিল। এ সময়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ২৬ হাজার ৪৫৩টি মামলা এবং হাইকোর্ট বিভাগে ৫ লাখ ১৫ হাজার ৫০৮টি মামলা। বাকি মামলা বিচারাধীন ছিল দেশের জেলা জজ, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটসহ বিভিন্ন বিচারিক আদালতে। গত এক যুগে নতুন করে দায়ের ও পুনর্জীবিত হয়েছে এক কোটি ৬৯ লাখ ৮৬ হাজার ৬১টি মামলা। নিষ্পত্তির তুলনায় মামলা দায়েরের সংখ্যা গত ১২ বছরে ২৭ লাখেরও বেশি। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। আইনজীবীদের মতে, মামলার দীর্ঘসূত্রতা মামলা জটের অন্যতম প্রধান কারণ। বিচারিক আদালতে ও হাইকোর্টে বছরের পর বছর শুনানির অপেক্ষায় পরে থাকার কারণে মামলাজট দীর্ঘ হচ্ছে। ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তি হতে অনেক ক্ষেত্রে ২০ থেকে ৩০ বছরেরও বেশি সময় লেগে যায়। রিটের নিষ্পত্তি কিছুটা দ্রুত হলেও চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হতে কিছু ক্ষেত্রে ৫ থেকে ৭ বছর লাগে যায়।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, এক দশক ধরে মামলা দায়েরের চেয়ে মামলা নিষ্পত্তির হার ছিল নিম্নমুখী। এতেই অনিষ্পন্ন মামলা বেড়েছে নজিরবিহীনভাবে। জট নিরসনে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েও কাজের কাজ হয়নি। করোনার সময়ে অপরাধ, গ্রেপ্তার, মামলাও হয়েছে। তবে সে হারে মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। হাইকোর্টেও এর প্রভাব পড়েছিল। বর্তমানে উচ্চ আদালতসহ সারা দেশের আদালতগুলোতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় ৪২ লাখ। এসব মামলার নিষ্পত্তি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে বিচার বিভাগ। মামলাজট কমাতে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। বিচারক ও এজলাসের সংখ্যা বাড়ানো, আদালতের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, জনবল বৃদ্ধি, আইনের পুনর্বিবেচনা, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা, মামলা ব্যবস্থাপনা ও বিচার প্রশাসনে তদারকি বাড়িয়েও জট কমানো যাচ্ছে না। দিন দিন আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। নানা চেষ্টার পরও কোনোভাবেই বিচারে দীর্ঘসূত্রতা কমানো যাচ্ছে না। মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে সীমাহীন খরচে হাবুডুবু খাওয়ার পাশাপাশি পারিবারিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে হচ্ছে বিচারপ্রার্থীদের। অনেক সংসারই ধ্বংস হয়ে যায় মামলায় জড়িয়ে। ভিটে-মাটি ও ঘরের গহনা বিক্রি করে মামলা চালানোর ঘটনাও ঘটে। এ ছাড়া ভূমি-সংক্রান্ত মামলার পেছনে যুগের পর যুগও পার করেছেন দেশের লাখ লাখ মানুষ।
মূলত মামলাজট শুরু হয় নিম্ন আদালত থেকে। সেখান থেকে মামলা জটের ধাক্কা লাগে হাইকোর্টে ও পরে আপিল বিভাগে। কিন্তু এ জট কমাতে আগে থেকেই সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই।
খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার সাচিবুনিয়া গ্রামের নসর উদ্দিনের (৬৪) একটি দেওয়ানি মামলা হাইকোর্টে আছে শুনানির অপেক্ষায়। ১২ শতাংশ জামির মালিকানা নিয়ে করা এই মামলার আইনজীবী ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল জানান, ১৯৯৪ সালে মামলাটি করা হয়েছিল খুলনার একটি আদালতে। সেখানে নসর উদ্দিনের পক্ষে রায় আছে। এরপর মামলার বিবাদী আক্কাস কাজী বিচারিক আদালতের রায় চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে আপিল করেন।
২০১৮ সালে মামলাটি শুনানির জন্য লিস্টে আসে। এরপর বেশ কয়েকবার শুনানিও হয়; কিন্তু এখন পর্যন্ত এই মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। অর্থাৎ গত ৩০ বছরেও এই মামলাটি বিচারাধীনই আছে। ১৯৮৯ সালের ১ জানুয়ারি মাগুরায় আঝার আলী হত্যার ঘটনায় করা মামলায় আসামি হন মো. ফারুক হোসেন। এই মামলায় ফারুকে গ্রেপ্তার করা হয় ১৯৯০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে ফারুকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় ১৯৯৬ সালে। এর পর থেকে মামলাটি পড়ে আছে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। যদিও মানবাধিকার সংগঠন লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট টু হেল্পলেস প্রিজনার্স অ্যান্ড পারসন্স (এলএএইচপি)-এর সহযোগিতায় দীর্ঘ ২৯ বছর পর ২০১৯ সালে জামিনে কারামুক্ত হন ফারুক হোসেন। কারাগারের রীতি অনুযায়ী তার কারাবাস ছিল ২২ বছর ৬ মাস। কোনো তদবিরকারক নেই বলে তাকে এই দীর্ঘ সময় কারাগারে থাকতে হয়। মামলাটি এখনও বিচারাধীন আছে হাইকোর্টে। অর্থাৎ ঘটনার পর থেকে ৩৪ বছরেও মামলাটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন ভিউজ বাংলাদেশকে এ ব্যাপারে বলেন, ‘পরিকল্পনা নিয়ে নিম্ন আদালতের কর্মঘণ্টা বাড়ানো, হাইকোর্টের সব বেঞ্চে রিট আবেদন, ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার শুনানির এখতিয়ার, বার্ষিক অবকাশ কমানো গেলে কিছুটা হলেও জট কমানো সম্ভব হবে।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকার নেত্রী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ ভিউজ বাংলাদেশকে এ ব্যাপারে বলেন, ‘বিনাবিচারে দীর্ঘ সময় কারাবাস ও দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণে একদিকে যেমন ন্যায় বিচার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি বাড়ছে মামলা জট। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাই সচেতন ও উদ্যোগী না হলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে না।’
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘মামলা জট এখন ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গেছে। এক্ষেত্রে মামলা দীর্ঘসূত্রতা কমাতে রাষ্ট্রপক্ষকে উদ্যোগ নিতে হবে। বিচারকের সংকটও আছে। তা পূরণ করতে হবে। আইনজীবীদের বারবার সময় নিয়ে কালক্ষেপণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অপর্যাপ্ত এজলাস ও বিচারক সংকটের কারণে নিম্ন আদালতে মামলা জট থেকে মুক্তি মিলছে না। অনেক মামলায় এক বছর পরেও তারিখ পরে। এত আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা পড়ছেন চরম ভোগান্তিতে। এসব সমস্যা দ্রুত সমাধান দরকার।’
এ ব্যাপারে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘আদালতে এখন মামলা জট কিছুটা হলেও কমে এসেছে। অনেক মামলার শুনানি হচ্ছে। বিশেষ করে বিচারিক আদালতে মামলা দায়ের থেকে নিষ্পত্তি বেশি হচ্ছে। হাইকোর্টে ২০২২ সালে ৩০টিরও বেশি ফাঁসির মামলার শুনানি হয়েছে। যেটি এর আগে কখনো হয়নি। এখন হাইকোর্টে মামলা নিষ্পত্তির হার আগের তুলনায় বেশি। রাষ্ট্রপক্ষ মামলা জট কমাতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রধান বিচারপতিও মামলা জট কমাতে নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রতি মাসে জেলা পর্যায়ে মামলার বিবরণী নেয়া হচ্ছে। পুরোনো মামলা শেষ করার পাশাপাশি নতুন মামলা দ্রুত শেষ করতে হবে। মামলা দীর্ঘসূত্রতা মানুষের কষ্টের কারণ হয়।’
এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘মামলা জট কমানো একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এটা হুট করে হয় না। নতুন মন্ত্রিসভায় আমি আবারও আইনমন্ত্রী হওয়ার পরই মামলা জট কমানোর জন্য নতুন করে উদ্যোগ নিয়েছি। এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে আলোচনা করে একটি একটি গাইড লাইন প্রস্তুত করা হবে। যাতে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করা যায়।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে