Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

পাকিস্তান নির্বাচন: কে কী কেন কীভাবে এবং এখান থেকে কোথায়!

Simon Mohsin

সাইমন মোহসিন

মঙ্গলবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

পাকিস্তানের ৭৭ বছরের ইতিহাসের এবারের নির্বাচন যে সবচেয়ে কম বিশ্বাসযোগ্য হবে এ রকম ধারণা অনেক বিশ্লেষকের আগে থেকেই ছিল। এর কারণ ইমরান খান ও তার সহযোগীদের ওপর সামরিক বাহিনী যে দমন-পীড়ন চালিয়েছে, তা থেকেই বোঝা যায়। এটাকে ইলেকশন না বলে ‘সিলেকশন’ বলা ভালো। মানবাধিকার পর্যবেক্ষকরাও নিন্দা করেছেন এটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়নি। ভোটাররা যখন ভোট দিতে গেছে তখনো পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর প্রভাব এং রাজনৈতিক অস্থিরতা সম্পূর্ণ ফুটে উঠেছে।

যাই হোক, পাকিস্তানের জনগণ এখন সামরিক বাহিনীর ওপর অসন্তুষ্ট। এটা সামরিক বাহিনীর কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। পাকিস্তানের ইতিহাসে এটা একটা বড় অস্থির সময়। সামরিক-ব্যবস্থাকে এটা বড় একটা ঝাঁকুনি দিবে। আনুষ্ঠানিকভাবে নিজের নামে নমিনেশন নেয়ার ব্যাপারে পিটিআই দলকে নানাভাবে বাধা দেয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও পিটিআই জোট-সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ভোট পেয়েছেন। জাতীয় পরিষদে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেনি; কিন্তু নেতৃত্ব দেয়ার মতো আসনসংখ্যা লাভ করেছে। স্বতন্ত্র-প্রার্থীরাই পিটিআইয়ের প্রতিনিধিত্ব করেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জেলে থাকা অবস্থাতেও তরুণ ভোটারদের সমর্থন পেয়েছেন।

তরুণরা বিপুলসংখ্যায় এগিয়ে আসার মাধ্যমে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। ৫৭ মিলিয়ন ভোটারদের মধ্যে তারাই ৪৪ শতাংশ। অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নারীরা দলে দলে ভোট দিতে এসেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রচারণায়ও তরুণ দল যথেষ্ট কার্যকারিতা দেখিয়েছে। বিশেষ করে প্রথাগত মিডিয়ার অফিসিয়াল নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে তাদের মোকাবিলা করতে হয়েছে। দাগ দিয়ে রাখার মতো আরেকটি বিষয় হচ্ছে পাকিস্তানের প্রান্তসীমার সঙ্গে মোকাবিলা। ভোটের মাধ্যমে জনসংখ্যাগত বিস্ফোরণটি সেটাই স্পষ্ট করে। পাকিস্তানকে খাইবার পাখতুনখাওয়া এবং বেলুচিস্তানের অসন্তুষ্ট যুবকদের মোকাবিলা করতে হবে। তাদের জাতীয় আলোচনায় নিয়ে আসতে হবে। বিতর্ক ও ভিন্নমত দমন করার জন্য জোর-জবদস্তির পরিবর্তে তাদের দাবিগুলোকে যত্ন সহকারে বিবেচনা করতে হবে।

দক্ষিণ এশিয়া কেন্দ্রের একজন অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো আম্মার হাবিব খান বলেছেন, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত দলগুলো, যেমন, নওয়াজ শরিফ এবং বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি একটা বিষয় একেবারেই অবমূল্যায়ন করেছেন, আর সেটা হলো পাকিস্তানের জনসংখ্যাগত পরিবর্তন। প্রথমবারে মতো ভোটার হওয়া তরুণদের পুরোনো দলগুলো সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত দলগুলোও এদের গুরুত্ব অনুধাবন করেনি।

কেন্দ্রে একটি দুর্বল জোট গড়ে উঠতে চলেছে। এই শাসক জোটের তেমন জনপ্রিয় বৈধতা নেই। ফলে অল্পতেই তারা নানা বিষয়ে দুর্বল ও বিভ্রান্ত হয়ে পড়বে। এটা পরবর্তী সরকারের যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ কোনো অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার সিদ্ধান্ত নিতে হলে সরকারকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। পাকিস্তানে এখন আকাশছোঁয়া মুদ্রাস্ফীতি। অর্থনীতি প্রচণ্ড অস্থিতিশীল। এটি পরিচালনা করতে হলে কঠিন সব সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পাশাপাশি শাসক জোটকেও অক্ষুণ্ন রাখতে হবে।

দেশটির নির্বাচনে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ করে, দীর্ঘদিন ধরে এমন অভিযোগ চলমান। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে কারচুপির অভিযোগও আছে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা লাভ করার পর এ পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন ২৪ জন। দুর্ভাগ্যবশত তাদের কেউই পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। হয় তাদের হত্যা করে সরানো হয়েছে, না হয় সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। ইসলামাবাদ ভিত্তিক পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অফ পিস স্টাডিজ থিঙ্ক-ট্যাঙ্কের পরিচালক আমির রানা বলেছেন, সামরিক বাহিনী সব সময়ই দেশটিকে পেছন থেকে টানছে। এর অর্থ ভোটাররা দাবি করলেও দেশটির খুব বেশি পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই।

পাকিস্তান-ইরান সীমান্ত আন্তঃসীমান্ত জঙ্গিবাদের জন্য একটি হটস্পট হয়ে উঠেছে। সীমান্ত অঞ্চলে সক্রিয় জঙ্গিগোষ্ঠীর আক্রমণে উভয় দেশই ভুগছে। এই হুমকি মোকাবিলায় পাকিস্তান ও ইরান যে সহযোগিতা ও যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তা পাকিস্তান সরকারের কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা নীতির দ্বারা প্রভাবিত। জঙ্গি-তৎপরতা আরও কার্যকর নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রশাসন দরকার, যাতে নিরাপত্তা সহযোগিতা আরও বাড়ানো যায়।

দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানের কৌশলগত অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে আঞ্চলিক নিরাপত্তা রক্ষায়। ভারত, আফগানিস্তান এবং চীনের সঙ্গে দেশটির জটিল সম্পর্ক। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতেও পাকিস্তানের একটা প্রভাব আছে। সব মিলিয়ে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শান্তির জন্য পাকিস্তানের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নীতিমালা প্রয়োজন।

ইরানেরও সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কদ্বারা প্রভাবিত হয়। বিশেষ করে সৌদী আরবের সঙ্গে, এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এর সম্পর্কের কারণে। নতুন পাকিস্তান সরকারকে উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্র এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। যাদের সঙ্গে আবার ইরানের সম্পর্ক ভালো নয়। পাকিস্তানকে তেহরানের সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো রাখতে হবে। পাকিস্তানের বৃহত্তর পররাষ্ট্র নীতি এবং আঞ্চলিক কূটনীতির জন্য এই ভারসাম্যমূলক কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

চীন-পাকিস্তানের অর্থনৈতিক কড়িডোর (সিপিইসি) এবং চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে বৃহত্তর কৌশলগত অংশীদারিত্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিবেশের ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল। আঞ্চলিক সংযোগ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় উন্নয়ন প্রকল্পের গতি ও সুযোগ কাজে লাগাতে সিপিইসি সম্পর্কে আসন্ন সরকারের অবস্থান সহায়ক হবে। চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে কৌশলগত সম্পর্কের গভীরতা নির্বাচনি ফলাফল দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। এটা প্রভাব ফেলবে নিরাপত্তা সহযোগিতায়, প্রযুক্তি হস্তান্তরে এবং বিনিয়োগে। তা ছাড়া ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্কের ইস্যু তো রয়েছেই।

পাকিস্তানের নির্বাচিত সরকারের চরিত্র দুঃশ্চিন্তা যেমন বাড়াতে পারে, তেমনি সংলাপ ও শান্তি চুক্তির মাধ্যমে নতুন দরজাও খুলে দিতে পারে। এটা নির্ভর করে ভারতের প্রতি এর অবস্থান ও কূটনৈতিক সুসম্পর্ক বজায় রাখার ইচ্ছার ওপর। যদিও জনপ্রিয়তা বজায় রাখার জন্য মোদির বিজেপি সরকার মুসলিমবিরোধী বক্তব্য দিয়ে চলেছে, জ্বালানি হিসেবে তারা ব্যবহার করছে পাকিস্তান বিরোধিতাও, এই ক্ষেত্রে পাকিস্তানের নতুন সরকারকে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হলে সবচেয়ে বেশি সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। আপাতত এটা মনে হচ্ছে যে, নওয়াজ শরিফকে নেতৃত্বে রেখে সামরিক বাহিনী এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। কারণ তিনি কিছুটা নরমপন্থি। আরও কিছুটা স্থিতিশীল মানসিকতা নিয়ে পা বাড়াবেন। যাই হোক, নওয়াজ শরিফ ক্ষমতায় আসবেন কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন। যদি তিনি আসেনও, এরকম শক্তিশালী এক জোট সরকারের সঙ্গে থাকবেন কি না সেটাও আরেক প্রশ্ন। প্রতিবেশীদের সঙ্গে পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গি কীরকম হবে এইসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের ওপর নির্ভর করে।

মধ্যস্থতাকারী হিসেবে পাকিস্তানের ভূমিকা এবং আফগান তালেবানের প্রতি তার নীতি এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করবে। আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য ইসলামাবাদের সরকার কাজ করতে পারে। আফগানিস্তানের মাটি যেন পাকিস্তানবিরোধী কার্যকলাপের জন্য ব্যবহার না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। নিরাপত্তাজনিত কারণে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সম্পর্ক ক্রমেই উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলা ঠেকাতে তালেবান নেতৃত্বাধীন সরকার যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছে, পাকিস্তান এরকম অভিযোগ তুলেছে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে। এই অভিযোগের আওতায় আছে দুদেশের ছিদ্রসীমায় অবস্থিত ইসলামিক স্টেট ইন খোরাসান প্রদেশ (আইএসকেপি বা আইএসআইএস-কে) এবং তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)। পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়ে আছে প্রায় পনেরো লাখ আফগান শরনার্থী ও অভিবাসী, তাদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্তও কাবুলের সঙ্গে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। আফগান সরকার এই বহিষ্কারাদেশকে ‘একতরফা’ ও ‘অপমানজনক’ বলে সমালোচনা করেছে। এটা মানবিক উদ্বেগকে বড় করে তুলছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। আফগানিস্তানের চলমান অস্থিতিশীলতার সঙ্গে, পাকিস্তানের সীমান্ত রক্ষা, এর সঙ্গে শরণার্থী পরিস্থিতি সামলানোর জন্য পাকিস্তান কী পদক্ষেপ নেয় তার ওপর আঞ্চলিক নিরাপত্তা যেমন অনেক মানবিক উদ্বেগও জড়িত।

বাইডেন প্রশাসন পাকিস্তানের প্রতি দ্বিমুখী পন্থা গ্রহণ করেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবিভাগ, পরারাষ্ট্র দপ্তর, চলমান সামরিক এবং প্রতিরক্ষা সম্পর্কগুলোর গভীর সম্পৃক্ততা রয়েছে; কিন্তু, যা উল্লেখযোগ্য তা হলো হোয়াইট হাউসের সঙ্গে কিছুটা দূরত্বও বিদ্যমান। আগে পাকিস্তানের নেতাদের হোয়াইট হাউসের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল। এই সম্পর্কটা এখন আর নেই। পাকিস্তান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এখন একটি জটিল সন্ধিক্ষণে রয়েছে। সাম্প্রতিক ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং উভয় পক্ষের অগ্রাধিকারের বিকাশ ঐতিহাসিক পারস্পরিক সম্পর্কের জটিল বন্ধনকে প্রতিফলিত করে।

ভোটের ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ শাসনের জন্যই নয়, বরং এর আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অবস্থানের কারণে। দেশটি যখন গর্তের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে, তখন নির্বাচনের প্রভাব এর ভবিষ্যতের ওপরও পড়বে। বিশেষ করে এর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং সামরিক-বেসামরিক ভারসাম্য কী অবস্থায় দাঁড়ায় সেটাই এখন দেখার বিষয়।

লেখক: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ