হায়দার আকবর খান রনো
আমাদের মতাদর্শ ভিন্ন হলেও শত্রু ছিল পাকিস্তানি সেনা
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) উপদেষ্টা হায়দার আকবর খান রনো মারা গেছেন। মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক হায়দার আকবর খান রনো পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও নেতা। ১৯৭১ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলার সমন্বয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন দেশের বর্ষীয়ান বাম রাজনীতিক হায়দার আকবর খান রনো। রণাঙ্গনে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাহাত মিনহাজকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ, চীনাপন্থি বামরাজনীতিকদের ভূমিকা, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া, অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষাসহ নানা বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। এ সাক্ষাৎকারটি এতদিন অপ্রকাশিত ছিল, আজ প্রকাশ করা হলো।
রাহাত মিনহাজ: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ আপনাদের কী কর্মসূচি ছিল। আপনারা কী করেছিলেন?
হায়দার আকবর খান রনো: ২৫ মার্চ পল্টন ময়দানে আমাদের একটা সমাবেশ ছিল। ওই সমাবেশে দুই লাখের বেশি মানুষ অংশ নিয়েছিলেন। এই সমাবেশের আয়োজক ছিল কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলার সমন্বয় কমিটি। এটি ছিল কমিটির প্রথম সমাবেশ। সাংগাঠনিক ক্ষমতার ভিত্তিতে আমাদের পক্ষে এত বড় সমাবেশ আয়োজন করা সম্ভব ছিল না। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় উত্তাল ওই সময়ে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন, যা আমাদের অভীভূত করে। সমাবেশে কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আনোয়ার খান জুনো ও আমি বক্তৃতা দেই।
রাহাত মিনহাজ: ২৫ মার্চের সন্ধ্যার পর আপনি কী করছিলেন। ক্র্যাকডাউনের খবর আপনারা কীভাবে পেলেন। ওই রাতটা আপনি কীভাবে কাটালেন?
হায়দার আকবর খান রনো: সমাবেশ শেষে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে চলে আসি। মধু দা ডিম খাওয়ালেন। সঙ্গে ছিলেন মেনন। ওখানে বসে খাওয়া-দাওয়ার সঙ্গে এসে আমি খোঁজ করছিলাম টঙ্গী থেকে যেসব শ্রমিক ট্রাক-বাসে করে সমাবেশে এসেছিল, তারা পৌঁছেছে কি না? বাসায় এসে কয়েক জায়গা থেকে খোঁজ পেলাম তারা ঠিকমতো পৌঁছেছে। বলে রাখা ভালো ঐদিনই ছিল মধু দার সঙ্গে আমাদের শেষ সাক্ষাৎ। ২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউনের রাতেই নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিয় মুখ মধু দা। মধু দার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরে বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর পাচ্ছিলাম শহরে মিলিটারি নামছে। বাসায় আসার পর কয়েকটা ফোন পেলাম। কেউ বললেন মিলিটারি নেমেছে। কেউ বললেন এইমাত্র মিলিটারি এই রাস্তা পার হলো। অন্যদিকে একটা ফোনের কথা আমার বিশেষ করে মনে আছে। একজন ফোন করে বললেন, মিলিটারি নেমেছে। যুদ্ধ তো শুরু হলো। আমার বাসায় যে দুটি বন্দুক আছে। সেগুলো আমি তোমাদের দিতে চাই। এগুলো হয়তো তোমাদের কাজে লাগবে। খুব ভালো লাগলো। এরপর আমি বাসা থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
রাহাত মিনহাজ: ওই রাতে এমন পরিস্থিতিতে বের হলেন? কী উদ্দেশ্য?
হায়দার আকবর খান রনো: ভেবেছিলাম লালবাগে মেননের কাছে যাব। ওখানে বসে আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করব। একসঙ্গে থাকব। ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডে প্রথমে গেলাম মাহফুজ ভূঁইয়ার বাসায়। আমার ছোট ভাই জুনো গাড়ি ড্রাইভ করছে। মাহফুজ ভাইকে বললাম চলেন লালবাগে মেননের বাসায় যাই। এদিকে টেলিফোন লাইন এরই মধ্যে ডেড। মাহফুজ বললেন, অসম্ভব। পিলখানায় গোলাগুলি চলছে। ওদিক দিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এরপর মাহফুজ অন্য এক বাসায় গেলেন। আমি আর জুনো গেলাম খালার বাসায়। খালার বাসা থেকেই আমরা প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ শুনলাম। আর ট্রেসার বুলেট। পুরো আকাশ লাল হয়ে যেত। এক ভীতিকর অবস্থা। চারদিকে শুধু গুলি আর গুলি।
রাহাত মিনহাজ: এরপর কী ঘটল। আপনারা কী করলেন?
হায়দার আকবর খান রনো: ২৬ মার্চ সারা দিন কার্ফ্যু। বের হওয়ার সুযোগ নেই। বদ্ধ ঘরে থেকে শুধুই গুলির আওয়াজ শুনলাম। ২৭ মার্চ কার্ফ্যু উঠে গেল। আমি আর জুনো বাসায় ফিরলাম। সকালে একটা গাড়ি নিয়ে রুমী এলো। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ছেলে শাফী ইমাম রুমী। রুমী সে সময় বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী ছিল। ওর গাড়িতে করে আমি নিউমার্কেট ও ঢাকার বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখলাম। রাস্তায় পড়ে আছে লাশের পর লাশ। বস্তি পুড়ে ছারখার। মানুষ ঢাকা ছেড়ে পালাচ্ছে। রাস্তায় মানুষের সারি। শুনালাম জগন্নাথ হল ও অন্যান্য হলে শিক্ষক-ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছে। ওই গাড়িতেই মেনন ভাইয়ের বাসায় গেলাম। এরপর গেলাম কাজী জাফরের বাসায়। সে সময় জুনোও আমাদের সঙ্গে ছিল। ওখানে আসেন জহির রায়হান। জহির তখন কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির ইউনিটভুক্ত সদস্য ছিলেন। জহির ভাই বললেন ‘আমার গাড়িটি তোদের কাছে থাকুক। যদি যুদ্ধে কোনো কাজে লাগে।’ সঙ্গে সাতশ টাকা ও কিছু সিগারেট দিয়ে জহির রায়হান চলে গেলেন।
রাহাত মিনহাজ: এরপর আপনারা কী করলেন। আপনারা তো শিবপুর গিয়েছিলেন?
হায়দার আকবর খান রনো: আমরা জহির রায়হানের গাড়িতে করেই শিবপুর গেলাম। গাড়িতে লাগানো পাকিস্তানের পতাকা। ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের আগে ঢাকা শহরে সব বাড়ির কার্নিশ আর গাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ছিল। ২৫ মার্চের পর পতাকা পরিবর্তন হলো। সবাই জীবন বাঁচাতে পাকিস্তানি পতাকা লাগিয়ে চলাচল শুরু করে। বাড়িতে বাড়িতে ওঠে পাকিস্তানি পাতাকা। আসলে সে সময় কিচ্ছু করার ছিল না। নিরাপত্তার জন্যই সবাই এই কাজ করেছিল। তবে ভৈরবে ফেরি পার হয়ে ভিন্ন চিত্র দেখি। ওখনে দোকান-পাটে আবার বাংলাদেশি পাতাকা। রিকশা-ভ্যানে গর্বের সঙ্গে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা।
রাহাত মিনহাজ: শিবপুর পৌঁছে আপনারা কী করলেন?
হায়দার আকবর খান রনো: শিপপুরে পৌঁছে জানতে পারলাম মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ও কৃষক সমিতির কর্মীদের সামরিক ট্রেইনিং চলছে। থানার সব রাইফেল নিয়ে নেয়া হয়েছে। চলছে অস্ত্র সংগ্রহের কাজ। ২৭ মার্চ রাতেই আমাদের দলের কমিটির মিটিং হলো। সিদ্ধান্ত হলো শিবপুর থেকেই আমরা যুদ্ধ পরিচালনা করব। আমাদের ঘাঁটি হবে এই শিবপুরই। আমাদের মিটিং এর সিদ্ধান্তের কথা বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়েছিল।
রাহাত মিনহাজ: যুদ্ধের ৯ মাস আপনাদের অধীনে কত হাজার যোদ্ধা ছিল?
হায়দার আকবর খান রনো: শিবপুর হেডকোয়ার্টারের অধীনে আমাদের আরও ১৪টি ঘাঁটি ছিল। আর এসব ঘাঁটির অধীনে যোদ্ধা ছিল অন্তত ১৪ হাজার। আর আমাদের সহযোগী বা আমাদের যুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল যারা প্রত্যক্ষভাবে আমাদের সহযোগিতা করেছেন তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ লাখ। যাদের কাছে আমরা আশ্রয় নিয়েছি, যারা আমাদের খাইয়েছেন।
রাহাত মিনহাজ: কিন্তু যুদ্ধ করতে তো অস্ত্র দরকার। আপনারা অস্ত্র কোথা থেকে পেতেন?
হায়দার আকবর খান রনো: প্রথম দিকে আমরা থানা থেকে অস্ত্র নিয়েছি। যার বাড়িতে যা ছিল সেই অস্ত্র ব্যবহার করেছি। আর যুদ্ধ যখন পুরোপুরি শুরু হলো অর্থাৎ সেক্টর কমান্ডাররা কাজ শুরু করলেন তখন তাদের কাছ থেকে আমরা অস্ত্র পেয়েছি। সেই অস্ত্রগুলো সেক্টর কমান্ডাররা আমাদের লুকিয়ে লুকিয়ে দিতেন। খালেদ মোশাররফ দিতেন, জিয়া দিতেন। আরও কয়েকজন সেক্টর কমান্ডার আমাদের সহযোগিতা করেছেন। সে সময় আমরা প্রতিষ্ঠিত চীনাপন্থি বাম শক্তি হিসেবে যুদ্ধ করেছি। ভারত সরকারের কাছ থেকে আমাদের সরাসরি আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র পাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না; কিন্তু সেক্টর কমান্ডাররা আমাদের সহযোগিতা করেন। আমাদের মতাদর্শ ভিন্ন ছিল; কিন্তু শত্রু ছিল এক পাকিস্তানি সেনা।
রাহাত মিনহাজ: ৭১ সালে আপনারা চীনপন্থি রাজনীতি করেছেন। আবার বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে চীনা সিন্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। আসলে রাজনৈতিক সমীকরণটা কী ছিল?
হায়দার আকবর খান রনো: বামপন্থি রাজনীতিকে কট্টর বিভাজনটা শুরু হয় গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে। পূর্ব পাকিস্তানে এই বিভাজন কার্যকর হয় ১৯৬৬ সালে। কমরেড মণি সিংয়ের নেতৃত্বে মস্কোপন্থিরা আলাদা লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হয়। চীনাপন্থিদেরও ছিল আলাদা তৎপরতা। তবে যাদের মধ্যে সে সময় চারটি ভাগ ছিল। যারা আলাদা আলাদা দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্লেষণ করেছে।
পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি নামের এক অংশের নেতৃত্বে ছিলেন সুখেন্দু-দস্তিদার-তোয়াহা-হক, একই নামে অপর অংশের নেতৃত্বে ছিলেন দেবেন শিকদার-আবুল বাশার, কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কিমিটির নেতৃত্বে ছিলেন কাজী জাফর-মেনন-রনো-মান্নান ভূঁইয়া আর পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন যা সর্বহারা নামে পরিচিত হয় সেই অংশের নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজ শিকদার। আমি কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কিমিটির সক্রিয় কর্মী ছিলাম। আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছি। সে সময় মুক্তিযুদ্ধে চীনা ভূমিকার আমরা প্রকাশ্য সমালোচনা করেছি। যার কারণে চীনা কর্তৃপক্ষ বা ক্ষমতাসীনরা আমাদের ওপর রুষ্ট ছিল। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের চীনা অ্যাম্বাসি আমাদের কোনো অনুষ্ঠানে দাওয়াত করেনি। যদিও ওই সময় (৮০ এর দশক) আমি ওয়ার্কার্স পার্টি করি।
রাহাত মিনহাজ: আপনারা শিবপুরে কতগুলো যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন? আপনাদের শহীদের সংখ্যা কতজন ছিলেন?
হায়দার আকবর খান রনো: শিবপুরে আমরা প্রচুর যুদ্ধ করেছি। আমাদের মতো কেউ এতো যুদ্ধ করেছি। এ যুদ্ধের ধরন ছিল গেরিলা আক্রমণ। এ যুদ্ধ পরিচালনা করতে গিয়ে আমাদের শতাধিক যোদ্ধা নিহত হন। প্রথম যুদ্ধটা আমরা করেছিলাম একটা ব্রিজ উড়াতে গিয়ে। ওই সময় নরসিংদীতে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি ছিল। সেখান থেকে ওরা শিবপুরে আসত। নরসিংদী-শিবপুর রাস্তার ওপর পুঁটিয়া বাজারের কাছে একটা ব্রিজ ছিল। আমরা ওই ব্রিজটা উড়িয়ে দিই। তারপরই পাকিস্তানি বাহিনী ওই এলাকায় আসে। তাদের সঙ্গে আমাদের সরাসরি যুদ্ধ হয়। ওই যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হয়। আমরা হারাই আমাদের যোদ্ধা ফজলুকে। ফজলুই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে শিবপুরের প্রথম শহীদ।
রাহাত মিনহাজ: ১৬ ডিসেম্বর আপনি কোথায় ছিলেন?
হায়দার আকবর খান রনো: বিজয়ের দিন আমি ছিলাম কলকাতায়। পুরো কলকাতা শহর ছিল উত্তাল। বিকেলে সারেন্ডার ঘোষণা হওয়ার পর ইন্দিরা গান্ধীর নামে জয়ধ্বনি শুরু হলো। ওই দিন আমার সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সঙ্গে। আমরা একসঙ্গে অনেক গল্প করি। বিজয়ের মুহূর্ত একসঙ্গে উপভোগ করি। তবে একটা বিষয় আমাকে কষ্ট দিয়েছিল। কেন যেন ওই দিন কলকাতায় যারা বিজয় করছিল (বিশেষত কংগ্রেস নেতাকর্মী) তারা কেন যেন হঠাৎ করেই সিপিএমের কার্যালয় ভাঙা শুরু করেছিলেন। এক অদ্ভূত কাণ্ড। এত বড় একটা ঐতিহাসিক বিজয়ের উদযাপন হলো অনেক বাজেভাবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে