পাকিস্তানে নিরূপিত ফলাফলের নির্বাচন
পাকিস্তানের জামায়াত-ই-ইসলামি দলের হাফিজ নাঈম উর রহমান করাচি শহরের প্রাদেশিক বিধানসভার একটি আসনের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েও তার আসন ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তার হিসাব অনুযায়ী ইমরান খানের পিটিআই সমর্থিত প্রার্থী তার চেয়ে অনেক বেশি ভোট পেয়েছেন। তিনি পেয়েছেন ২৬ হাজার ভোট, আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী সাইফ বারি পেয়েছেন ৩১ হাজারের ভোট। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন বলছে, সাইফ বারি মাত্র এগারো হাজারের মতো ভোট পেয়েছেন। পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। হাফিজ নাঈম উর রহমানের বক্তব্য সারা বিশ্বকে বিস্মিত করেছে, কারণ একজন নির্বাচিত সাংসদের এভাবে আসন ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা নজিরবিহীন।
অন্যদিকে এই স্বীকারোক্তির মাধ্যমে নির্বাচনে ব্যাপক ভোট জালিয়াতি এবং অবৈধ হস্তক্ষেপের অভিযোগটি প্রমাণিত হয়ে যায়। নির্বাচনের কারচুপি নিয়ে আরেকটি বিরল ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে রাওয়ালপিন্ডিতে। ভোট জালিয়াতির সঙ্গে নিজের জড়িত থাকার স্বীকারোক্তি দিয়ে পদত্যাগ করেছেন রাওয়ালপিন্ডি বিভাগের কমিশনার লিয়াকত আলি চাতা। তিনি সংবাদ সম্মেলন করে ভোট কারচুপির তথ্য দিতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, পিন্ডিতে ৫০ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত প্রার্থীকেও জোর করে জয়ী ঘোষণা করা হয়েছে, এমন জয়ী প্রার্থীর সংখ্যা ১৩। এমন অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার গ্লানি তাকে পীড়িত করায় অনুতপ্ত হয়ে নিজের বিচার চেয়েছেন। ইমরান খানের রাজনৈতিক দল তেহরিক-ই-ইনসাফ বা পিটিআই ফলাফল ঘোষণা হঠাৎ বন্ধ করে দেয়ার পর থেকেই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির কথা বলে আসছে। জামায়াত-ই-ইসলামি দলের হাফিজ নাঈম উর রহমান এবং কমিশনার লিয়াকত আলি চাতার স্বীকারোক্তি নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে নতুন বিতর্কের সূত্রপাত করেছে। রাতের অন্ধকারে ভোটারের ম্যান্ডেট চুরি করার অভিযোগ তুলে জনতা রাস্তায় জড় হয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এ সব প্রতিবাদ সভায় পাকিস্তানের ছোট ছোট রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেছে, পাকিস্তান পিপলস পার্টি উত্থাপিত অভিযোগের তদন্ত করার দাবি জানাচ্ছে। ফল ঘোষণায় অস্বাভাবিক বিলম্ব সবার মনে সন্দেহ জাগিয়ে তুলেছে। ইমরান খানের পিটিআই যখন অধিকাংশ আসনে এগিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই ফল ঘোষণা বন্ধ হয়ে যায়।
তা ছাড়া ফল ঘোষণায় নির্বাচন কমিশনের বিলম্বের অজুহাত ছিল খারাপ আবহাওয়া এবং দূরবর্তী দুর্গম এলাকা। ৮৫টি আসনের ফল উল্টে দেয়ার অভিযোগ তুলেছে পিটিআই। নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ইমরান খানের সমর্থক স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পরাজিত করা। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের মোট ৩৩৬টি আসনের মধ্যে ২৬৬টি আসনে সরাসরি ভোট হয়, ৭০টি আসন নারী এবং সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষিত। এবার নির্বাচনে ১টি আসনের ভোট স্থগিত থাকায় ২৬৫টি আসনে ভোট হয়েছে; ১টি আসনের ফল স্থগিত থাকায় ২৬৪টি আসনের ফল ঘোষণা করা হয়েছে। সরকার গঠনে প্রয়োজন ১৩৪টি আসন; কিন্তু কোন দল সরকার গঠনের জন্য অপরিহার্য আসনে জিততে পারেনি। বিজয়ী ১০১ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে ৯৩ জন ইমরান খানের পিটিআই সমর্থিত প্রার্থি। নওয়াজ শরিফের মুসলিম লীগ পিএমএল-এন পেয়েছে ৭৫টি আসন, পিপলস পার্টি বা পিপিপি পেয়েছে ৫৪টি আসন, মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট পাকিস্তান বা এমকিউএম ১৭টি এবং অন্যান্য দল পেয়েছে ১৭টি আসন। ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখে নির্বাচন হয়েছে, নির্বাচন হওয়ার পর আজ বুধবার ২১ তারিখ, নওয়াজ শরিফের পিএমএল-এন এবং বিলাওয়াল ভুট্টোর পিপিপির মধ্যে সরকার গঠন নিয়ে সমঝোতা হয়েছে। নির্বাচন শেষ হওয়ার পর নওয়াজ শরিফের পিএমএল-এন এবং বিলাওয়াল ভুট্টোর পিপিপির দৌড়ঝাঁপ দেখেই মনে হয়েছিল তারা জোটবদ্ধ হয়ে সরকার গঠন করবে; কিন্তু এই দুই দলের আসনসংখ্যা মাত্র ১২৯, সরকার গঠনে লাগবে আরও ৫টি আসন। ইতোমধ্যে ইমরান খানের পিটিআই সমর্থিত একজন স্বতন্ত্র সাংসদ নওয়াজ শরিফের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, বাকি আরও ৪ জন। এই ৪ জন সাংসদকে যোগাড় করা কঠিন হওয়ার কথা নয়, ক্ষমতা বা সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন থাকলে স্বতন্ত্র সাংসদদের ফ্লোর ক্রসিংয়ে আইনগত কোনো বাধাও নেই। পিএমএল-এন এবং পিপিপির মধ্যকার সমঝোতা অনুযায়ী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন পিএমএল-এন-এর শাহবাজ শরিফ, আর রাষ্ট্রপতি হবেন পিপিপির আসিফ আলী জারদারি, বিলাওয়াল ভুট্টোর বাবা। সমঝোতার পূর্বে অনেক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে; পিপিপি প্রধান বিলাওয়াল ভুট্টো ঘোষণা দেন, তার দল সরকারে যোগ না দিয়ে বিরোধী দল হিসেবে সংসদে যাবে।
জাতীয় পরিষদে বিরোধী দল হিসেবে অবস্থান নিতে ইমরান খানও তার দল পিটিআইকে নির্দেশ দেন। একই খেলা খেলছে নওয়াজ শরিফের পিএমএল-এন, সরকার গঠনে তাদের অনেক নেতার আপত্তি আছে। জোটের দুর্বল সরকারের মাথায় সব সময় অনাস্থা প্রস্তাবের হুমকি ঘুরপাক খেতে থাকবে, এমন অনিশ্চয়তায় সরকারের দায়িত্ব নিয়ে কোন দল নিজেদের ইমেজ নষ্ট করতে চাচ্ছিল না, কারণ পাকিস্তানের ভঙ্গুর অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন সম্ভব না হলে সরকারি দলের মলিন ভাবমূর্তি দীর্ঘদিনের জন্য স্থায়ী হয়ে যাবে। গঠিত জোটের বন্ধন বেশিদিন স্থায়ী হবে বলে মনে হয় না। কারণ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও পাকিস্তানে কোন দলের প্রধানমন্ত্রী তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। শুধু তাই নয় ১৯৪৭ সনে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে আজ পর্যন্ত পাকিস্তানে কোন প্রধানমন্ত্রীর পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার ইতিহাস নেই। কয়েকজন প্রধানমন্ত্রী খুন হয়েছেন, কয়েকজনকে মেয়াদ পূর্তির আগেই গভর্নর জেনারেল বা প্রেসিডেন্ট সরিয়ে দিয়েছেন, কয়েকজন সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন, দু-একজনকে আদালত দুর্নীতির অভিযোগে অযোগ্য ঘোষণা করেছে। সাতজনকে ডিঙিয়ে যাকে জুলফিকার আলী ভুট্টো সেনাপ্রধান করেছিলেন সেই লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউল হক ১৯৭৭ সালে ক্ষমতা দখল করেই ‘বেজন্মা’ ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারার ঘোষণা দেন। তার এই হুমকি বিচারের মাধ্যমে ১৯৭৯ সনে কার্যকর করা হয়। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে ১৯৫১ সনে গুলি করে হত্যা করা হয়, বেনজির ভুট্টো আত্মঘাতী সন্ত্রাসীর বোমার বিস্ফোরণে নিহত হন। গুলি করা হয়েছিল ইমরান খানকেও, সৌভাগ্যক্রমে রক্ষা পেয়েছেন। পাকিস্তানে অধিকাংশ প্রধানমন্ত্রী জেল খেটেছেন; ইমরান খানের মতো যে সব প্রধানমন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল তাদের মধ্য আছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জুলফিকার আলী ভুট্টো, বেনজির ভুট্টো, নওয়াজ শরিফ ও শাহবাজ শরিফ।
পাকিস্তানই একমাত্র দেশ, যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়; কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের সব নির্বাচন ছিল পক্ষপাতদুষ্ট এবং অগণতান্ত্রিক। এবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করে পূর্ব নির্ধারিত ফলাফলের একটি নিরূপিত নির্বাচন করেছে। নির্বাচনের পূর্বে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল যাতে ইমরান খানের পিটিআই দলের পক্ষে নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। নির্বাচনের সময় ইমরান খান ছিলেন জেলখানায়, আদালত থেকে তাকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়, নির্বাচন কমিশন তাদের নির্বাচনের দলীয় প্রতীক ‘ক্রিকেট ব্যাট’ বাতিল করে দেয়, তাদের দলকে কোথাও সমাবেশ করা এবং নির্বাচনি কার্যালয় খোলার অনুমতি দেয়নি তত্ত্বাবধায়ক সরকার; এই অবস্থায় তাদের প্রচারণার প্রধান হাতিয়ার ছিল মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেট, কিন্তু সেই ইন্টারনেটও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভোটের দিন বন্ধ করে দেয়। দলীয় প্রতীক না থাকায় দলের প্রার্থীরা ভিন্ন ভিন্ন প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়তে বাধ্য হয়েছেন। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল প্রভৃতি দেশের নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের গুরুত্ব অপরিসীম, পিটিআই যদি দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার সুযোগ পেতো তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সকল কারসাজি গণজোয়ারে মার খেত। নির্বাচনের মাঠ অসম না হয়ে সুষম হলে পিটিআইর পক্ষে ভোট বিপ্লব ঘটার সম্ভাবনা ছিল।
পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আচরণ নিয়ে আরেকটি ভিন্ন কলাম লেখার ইচ্ছে আছে। পাকিস্তানের প্রভাবশালী পত্রিকা ডনের মতে নির্বাচনের পবিত্রতা হরণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র সমানভাবে দায়ী। বাংলাদেশের দলীয় সরকারের মতো পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারও নির্বাচন বিতর্ক এড়িয়ে যেতে পারেনি। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, দলীয় সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে নিগৃহীত বিরোধী দল যখন ক্ষমতায় যায়, তখন তারাও তাদের বিরোধী দলের প্রতি একই আচরণ করে।
লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, টাকশাল।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে