ডিইপিজেড চালু রাখতে পল্লী বিদ্যুতের লাইন, বিপাকে ভোক্তারা
গ্যাস না থাকায় ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ডিইপিজেড) বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ করতে পারছে না ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। এতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের কারখানাগুলো। এরকম পরিস্থিতে এগিয়ে এসেছে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১। এতে ডিইপিজেডের কারখানাগুলো পুরোদমে উৎপাদনে ফিরেছে। তবে বিপাকে পড়েছেন ডিইপিজেডের আশপাশের এলাকাগুলোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর আবাসিক ও বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীরা। দীর্ঘসময় লোডশেডিং থাকার ফলে ভোগান্তিতে পড়েছেন পোশাক শ্রমিকসহ এলাকার কয়েক লাখ গ্রাহক।
জানা যায়, ঢাকা ইপিজেডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে একমাত্র ইউনাইটেড পাওয়ার। অন্য কারও অনুমতি ছিল না। সম্প্রতি বকেয়া বিলের অভিযোগে তাদের গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয় তিতাস গ্যাস। এতে পুরো ডিইপিজেডের কারখানায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হতে থাকে। পরবর্তীতে বেপজার অনুরোধে ইপিজেডের বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১। এতে ইপিজেডের বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হলেও এর প্রভাব পড়ছে পুরা এলাকায়। সেখানে লোডশেডিং বাড়ছে দ্বিগুণ। বিকল্প সমাধান না করা হলে এই ভোগান্তি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
জানা যায়, গত সপ্তাহ থেকে ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর আওতাধীন ডিইপিজেডের আশপাশের এলাকাগুলোয় লোডশেডিং বেড়েছে। এতে বিপাকে পড়েছে ছোট-বড় বেশ কিছু কারখানাও। দিনের অধিকাংশ সময় গ্রাহকরা থাকছেন বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায়। বন্ধ হয়ে গেছে বাসাবাড়ির পানি উত্তোলনের কাজ। ফলে রান্না, গোসল ও খাবার পানি পাচ্ছে না এই এলাকার মানুষগুলো। সেই সঙ্গে দিনে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকায় বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে ডিইপিজেডের আশপাশের ছোট-বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর তথ্য অনুযায়ী, আশুলিয়ার নবীনগর জোনে বিদ্যুতের চাহিদা মোট ৪৮০ মেগাওয়াট; কিন্তু গ্রীষ্মকালে চাহিদার তুলনায় ১০০-১২০ মেগাওয়াট কম বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে পবিস-১। এতে বিদ্যুৎ সরবরাহ হয় ৩৬০-৩৮০ মেগাওয়াট। শীতকালে কিছুটা উন্নতি হলেও লোড কমে আসে ৬০-৮০ মেগাওয়াট। তখন ৪০০ থেকে ৪২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে। এ জোনের জোগান হতো কবিরপুর সাবস্টেশন থেকে। সেখান থেকে সর্বোচ্চ ৩১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এই পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর গ্রাহকদের সরবরাহ করে আসছিল; কিন্তু ডিইপিজেডের সংযোগের জন্য বাড়তি ৩০ মেগাওয়াট দিচ্ছেন তারা। পার্শ্ববর্তী ধামরাই সাবস্টেশন এই সমিতিকে খুব শিগগিরই আরও ১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির তথ্য মতে, ডিইপিজেডে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ৪০ মেগাওয়াট যার পুরোটাই সরবরাহ করত ইউনাইটেড পাওয়ার। বর্তমানে পল্লী বিদ্যুৎ সরবরাহ রেখেছে ৩৭ মেগাওয়াট। ফলে কবিরপুর সাবস্টেশন থেকে বাড়তি ২৫ ও ধামরাই সাবস্টেশন থেকে ১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আনা হয়েছে।
সরেজমিন ডিইপিজেডের আশপাশে গিয়ে দেখা যায়, সকাল ৮টায় কাইচাবাড়ি, বাইপাইল, বগাবাড়ির আংশিক এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল প্রায় দেড় ঘণ্টা। এ ছাড়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর আওতাধীন ইউনিক জোনের অধিকাংশ এলাকায় (ফিডার) বিদ্যুৎ নেই সকাল সাড়ে ৯টা থেকে। সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখা যায়, দুপুর ১২টা পর্যন্ত বিদ্যুৎবিহীন ছিল পুরো এলাকা। ইপিজেড অঞ্চলের সাতটি জোনের মধ্যে চারটিই বন্ধ ছিল সে সময়। বাসাবাড়িগুলোয় ব্যাহত হচ্ছিল গৃহস্থালি কার্যক্রম। সেই সঙ্গে অনেকটাই বাধ্য হয়ে বাড়তি খরচে বিকল্প ব্যবস্থায় উৎপাদন চালু রেখেছিল অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। কিছু ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান এ সময় কার্যক্রম বন্ধ করেও রাখে। বিদ্যুৎ না থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানে অলস সময় কাটাতে দেখা গেছে শ্রমিকদের। এতে লোকসানের মুখে ব্যবসায়ীরাও।
খাদিজাতুল কোবরা নামে এক কর্মজীবী নারী জানান, ‘আমরা শিখতে এসেছি; কিন্তু কারেন্ট না থাকায় বসে থাকতে হচ্ছে। বাসায় গিয়েও কারেন্ট পাবো না। সকালে ছিল না, এখানেও এসে পাই নাই। আবার রাত হলে তো ঘুমাতে পারবো না। কারেন্ট থাকে না। মশা জালায়, বাহিরে এসে বসে থাকতে হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত কয়েকদিন ধরে ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কারণে রাতের অন্ধকারে রান্না করা যাচ্ছে না। দিনেরবেলা কাজের খোঁজে আসতে হয়। তাই সময় হয় না দিনেরবেলা রান্না করার। এখন বাধ্য হয়ে বাহির থেকে কিনে খেতে হচ্ছে। ফ্রিজের সব জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া পানি না পাওয়ায় বাচ্চাদের ও নিজেদের গোসলের সমস্যা হচ্ছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ঘুমাতে পারছে না। ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে চার্জার ফ্যান কিনেছি; কিন্তু ঠিক মতো বিদ্যুৎ না থাকার কারণে সেই চার্জার ফ্যানও চার্জ দিতে পারছি না।’
ডিইপিজেডের নিরাপত্তা বেষ্টনী ঘেঁষে এস বি নিটিং লিমিটেড নামের একটি কারখানার মেইনটেনেন্স শাখার ইব্রাহিম হোসেন বলেন, ‘আমরা জানতে পেরে পেছি ইপিজেডে পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ দেয়া হয়েছে। এখন আমাদের লোডশেডিংয়ে পড়তে হচ্ছে। সকালে বিদ্যুৎ গেলে কখন আসে ঠিক নাই। এখন বাড়তি খরচ দিয়ে ডিজেল দিয়ে জেনারেটর চালিয়ে উৎপাদন অব্যাহত রাখা হয়েছে। এভাবে কত দিন চলবে জানি না। সরকারের উচিত এই শিল্পাঞ্চলে স্বাভাবিক বিদ্যুৎ সরবরাহ রাখা। শ্রমিকরা দিনের নির্দিষ্ট সময় কাজ করেন। ওই সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎ না থাকলে তারা অলস সময় কাটান। কাজ কম হলেও বেতনভাতা একই দিতে হয়। এতে পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়লেও দাম কিন্তু একই।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর ডিইপিজেড জোনের এক লাইন টেকনিশিয়ান বলেন, ‘আমার সাতটা ফিডার। এখানে গত কয়েকদিন ধরে ইপিজেডের ওই সমস্যার জন্য লোড বেশি হচ্ছে। আমার এরিয়াতে ১৩-১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়। সেখানে পেতাম মাত্র ৯-১২ মেগাওয়াট। গত মঙ্গলবার থেকে পাচ্ছি মাত্র ৫ মেগাওয়াট। এতে লোডশেডিং বেশি হচ্ছে।’
ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার আক্তারুজ্জামান লস্কর বলেন, ‘আগে ইপিজেডে লাইন ছিল কিন্তু তারা ব্যবহার করতো না। এতে আমার মালামাল নষ্ট হয়েছে। এখন তাদের ৪০ মেগাওয়াট চাহিদা রয়েছে। তাদের সেই লাইন দিতে আমাদের অনেক কিছু টেকনিক্যাল কাজ করতে হচ্ছে। তবে আমরা এখন প্রস্তুত। পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী কবিরপুর সাবস্টেশন ও ধামরাই সাবস্টেশন থেকে ৪৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমরা বাড়তি চেয়ে এনেছি। এতে সাধারণ গ্রাহকের ওপর চাপ পড়বে না। লোডশেডিং আগেই ছিল। আমার এখানে গরমের সময় ১০০-১২০ মেগাওয়াট ঘাটতি থাকে। এই জন্য আগেই লোডশেডিং ছিল। ইপিজেডে যা দেয়া হবে সেটা অবশ্যই ম্যানেজ করে আনা হয়েছে।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে