সড়ক দুর্ঘটনা
দুই সন্তান হারিয়ে শোকে স্তব্ধ বাবা-মা
‘পোলাডার জানডা আমার কোলের মইধ্যে গেছে। সিএনজির মইধ্যে চাপা পইড়া মাইয়াডার পা আলগা হইয়া গেছে। বাসডা চাপ দেওনের লগে লগেই সব শেষ। আমি অহন কী লইয়া বাঁইচ্চাম। আমার তো সব শেষ হইয়া গেল।’
সড়ক দুর্ঘটনায় চোখের সামনেই দুই সন্তানকে হারিয়ে এভাবেই বিলাপ করছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। বুক চাপড়িয়ে আহাজারি করছিলেন তার স্ত্রী আর নিহত ছেলে-মেয়ের মা শেফালি বেগমও। ওই দম্পতির আহাজারিতে ভারী হয়ে আসছিল বাতাস। মাসখানেক ধরে সন্তানদের জন্য কাঁদতে কাঁদতে তাদের চোখের পানিও যেন শুকিয়ে গেছে।
জাহাঙ্গীর আলম কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার উপজেলার জাফরগঞ্জ ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামের মান্তু মেম্বার বাড়ির বাসিন্দা। ৭ নভেম্বর রাতে কুমিল্লা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের একই ইউনিয়নের ছগুরা এলাকায় বাসচাপায় নিহত হয় তার ছেলে জুনায়েদ হোসেন (১২) ও মেয়ে ফাহিমা আক্তার (১০)। বাবার অটোরিকশায় চড়ে নানাবাড়ি পাশের অলুয়া গ্রামে যাচ্ছিল তারা। এ যেন বাবার গাড়িতে চড়ে দুই সন্তানের শেষযাত্রা।
নিহত জুনায়েদ জাফরগঞ্জের শ্রীপুর হাফেজিয়া মাদ্রাসার হিফজ বিভাগের শিক্ষার্থী আর ফাহিমা হোসেনপুর নূরানি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ছিল। একই দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন তাদের বাবাও। শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত পাওয়া ৩২ বছরের জাহাঙ্গীর আলম এখনও পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি।
অটোরিকশাচালক জাহাঙ্গীর আলমের বাড়িতে গেলে দেখা গেছে হৃদয়বিদারক দৃশ্য। টিনের ঘরটি থেকে কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে আসেন নিহত জুনায়েদ ও ফাহিমার মা শেফালি বেগম। সন্তানদের জন্য বিলাপ করতে করতে এখন কাঁদবার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছেন ৩০ বছর বয়সী এই গৃহবধূ।
কথাও বলতে পারছিলেন না শেফালি। নিজেকে সামলে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলেন, ‘আমার বুকের মানিকটিরে ফিরাইয়া দেন, আর কিচ্ছু চাই না। আমার কইলজা ভাইঙ্গা দিসে গো পাষাণ বাস ড্রাইভারে। আমি অহন কী লইয়া থাইক্যাম।’
দুর্ঘটনার পর শিশুদের মরদেহ বাড়ির আঙিনায় যেখানে রাখা হয়েছিল, সেই স্থানটি দেখিয়েও কাঁদতে কাঁদতে মাটিতেই লুটে পড়েন দুই সন্তান হারানো শেফালি। তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছিলেন বাড়ির অন্য নারীরা। তবে কোনো সান্ত্বনাতেই আহাজারি থামছিল না তার।
স্থানীয়রা জানান, জাহাঙ্গীর ও শেফালি দম্পতির বিয়ে হয়েছিল ২০১২ সালে। বিয়ের প্রথম বছরই তাদের প্রথম সন্তান জুনায়েদ হোসেনের জন্ম হয়। এর দুই বছরের মাথায় আসে দ্বিতীয় সন্তান ফাহিমা আক্তার। দুটি সন্তানকেই মানুষের মতো মানুষ করতে চেয়েছিলেন স্বল্প আয়ের মানুষ জাহাঙ্গীর আলম। এ জন্য স্ত্রীর সঙ্গে পরিকল্পনা করেই আর কোনো সন্তান নেননি; কিন্তু জাহাঙ্গীর-শেফালির সেই আদরের দুই ধনই এখন কবরে।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জাহাঙ্গীর জানান, সন্তানদের মাদ্রাসা থেকে নিয়ে তিনি অলুয়া গ্রামে তার শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছিলেন। মহাসড়কের ছগুরায় একটি রিকশা-ভ্যানকে অতিক্রম করে বাঁপাশেই ছিলেন। এ সময় বিপরীত দিক থেকে আসা একটি বাস পেছনের অংশ দিয়ে তার সিএনজিচালিত অটোরিকশাটিকে চাপা দেয়। এতে পেছনের অংশ দুমড়ে-মুচড়ে গিয়ে অটোরিকশাটি সড়কের পাশে উল্টে পড়ে।
জাহাঙ্গীর বলেন, ‘ওই বাসচালকের বেপরোয়া গতির কারণেই এ ঘটনা ঘটেছে। আমি বাসচালকের কঠোর শাস্তির দাবি জানাই। সিএনজিচালিত অটোরিকশাটি আড়াই লাখ টাকা কিস্তি নিয়ে কিনেছিলাম। একমাস না হতেই আমার সব শেষ হয়ে গেল।’
নাতি-নাতনির জন্য বিলাপ করছিলেন নিহত দুই শিশুর দাদি বৃদ্ধা রানু বেগমও। তিনি বলেন, ‘আমরার মানিক দুইডাইরে এইভাবে মারল ঘাতক বাসচালক। আমরার সব আনন্দ শেষ হইয়া গেছে। গরিব হইলেও আমার পোলাডার সাজানো সংসার আছিল, শান্তি আছিল। এহন আমার পোলাডা কেমনে বাঁচব। আমরা কেমনে বাঁচতাম।’
শিশুদের দাদা মোহাম্মদ সহিদ বলেন, ‘৮ নভেম্বর শুক্রবার জুমার নামাজের পর পারিবারিক কবরস্থানে তাদের মরদেহ দাফন করা হয়। ঘটনার পর সবাই ভেবেছেন, চাপা দেয়া বাসটি সুগন্ধা পরিবহনের। পরে এক যাত্রীর মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, বাসটি ছিল ফারজানা পরিবহনের। ঘটনার পর বাসের মালিক চালকসহ বাসটিকে ঢাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন বলে শুনেছি। আমরা টাকা চাই না, বিচার চাই।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে