চা শ্রমিকদের শ্রমের মূল্য যথাসময়ে পরিশোধ করুন
কবি লিখেছিলেন, ‘চা-পাতায় লেগে আছে শ্রমিকের রক্তের দাগ, তাই গরম পানিতে ভেজালে সে লাল হয়ে যায়।’ চা-বাগানের শ্রমিকদের দুর্দশার কথা আমরা জানি। সারা দিন কাজ করে তাদের যা আয় হয়, তা দিয়ে ঠিকমতো সংসার চলে না। প্রয়োজনের তুলনায় তাদের মজুরি অত্যন্ত কম। তারপরও অনেক শ্রমিক নিয়মিত বেতন পান না। তাই এক মাস ধরেই ন্যাশনাল টি কোম্পানির (এনটিসি) চা-শ্রমিকরা বকেয়া বেতন আদায়ের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন।
মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ১ মাস ১২ দিন কর্মবিরতি পালনের পর বকেয়া মজুরি পাওয়ার শর্তে কাজে যোগ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন রাষ্ট্র মালিকানাধীন ন্যাশনাল টি কোম্পানির (এনটিসি) চা-শ্রমিকরা। সেইসঙ্গে কর্মবিরতি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন তারা। গত ২১ অক্টোবর থেকে দেশের এনটিসির ১৬টি চা-বাগানের শ্রমিকরা কাজে যোগ না দিয়ে কর্মবিরতি শুরু করেছিলেন।
সিলেট বিভাগীয় শ্রম অধিদপ্তরের উদ্যোগে ত্রিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে দীর্ঘদিনের এই আন্দোলনের সমাধান হয়েছে রোববার (১ ডিসেম্বর)। এদিন দুপুর ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আলোচনা সভা শেষে বকেয়া পরিশোধের পর ৫ ডিসেম্বর থেকে কাজে যোগ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন শ্রমিকরা। পরে আলোচনা সভায় নেয়া সিদ্ধান্তগুলো পড়ে শোনান বিভাগীয় শ্রম অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ নাহিদুল ইসলাম।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, বাগানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তিন মাসের বকেয়া পাওনা থেকে এক মাসের বকেয়া বেতন ডিসেম্বরের ২০ তারিখের মধ্যে দেয়া হবে। এ ছাড়া শ্রমিকদের চলমান ছয় সপ্তাহের বেতনের দাবি উঠালে তা চা-বোর্ড কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার আশ্বাস দেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহমুদুল হাসান।
প্রশ্ন হচ্ছে, প্রায় দিনে এনে দিন খায় যে শ্রমিকরা, তাদের বেতন কেন বকেয়া রাখা হয়? কারণ হিসেবে ন্যাশনাল টি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘করোনার পর থেকে আমাদের সংকট তৈরি হয়েছে। চায়ের যে উৎপাদন খরচ বাড়ছে, তুলনামূলক বাজারে দাম পাওয়া যায়নি। ফলে কোম্পানি কিছুটা লোকসানের মধ্যে পড়েছে। এর মধ্যে সরকার পরিবর্তন হওয়ায় আরও বেশি সংকটে পড়েছি। ব্যাংক থেকে কোনো লোন পাওয়া যায়নি বিধায় মজুরি দিতে হিমশিম খাচ্ছি। আমরা চেষ্টা করছি, শিগগিরই সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য।’
উৎপাদন খরচ বাড়ছে- এই অজুহাতে কেবল চা-বাগান কোম্পানি নয়, অনেক কোম্পানিই শ্রমিকদের নিয়মিত বেতন দেন না। এমন অভিযোগ পোশাক-কারখানার বিরুদ্ধেও অনেক ওঠে; কিন্তু মালিকপক্ষকে তো কখনো গরিব মনে হয় না। তারা তো তাদের বিলাসীজীবন ঠিকই অতিবাহিত করেন। তাহলে শ্রমিকদের বেতন দেয়াতে কেন তাদের এত কার্পণ্য? বিশেষ করে যে শ্রমিকরা দিনে এনে দিনে খায়? সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই আমাদের দেশের চা-বাগানের শ্রমিকরা অবহেলা, বঞ্চনার শিকার।
আমরা আশা করব, বাংলাদেশের চা-বাগানের শ্রমিকদের প্রাপ্য সম্মানী যেন যথাসময়ে দেয়া হয়। যেই চা আমরা প্রতিদিন পান করি, তার সঙ্গে যখন লেগে থাকে শ্রমিকদের রক্ত, অশ্রু ও ঘাম- যখন জানতে পারি সেই শ্রমিকই মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন তখন কবির ভাষায়, ‘অবহেলিত চা-বাগানের শ্রমিকের কথা মনে পড়লে মনে হয় চা নয়, পান করছি শ্রমিকের রক্ত।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে