Views Bangladesh Logo

কারখানা শ্রমিকদের বেতন-বোনাস সংকট নিরসনে স্থায়ী সমাধান জরুরি

প্রতি বছর ঈদের আগে কারখানা শ্রমিকরা তাদের পাওনা বেতন-ভাতা নিয়ে আন্দোলনে নামে। গাজীপুর, আশুলিয়া, সাভার এলাকায় অনেক প্রতিষ্ঠানে ঈদের আগে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-বোনাস প্রদান করা হয় না। ফলে তারা রাস্তায় নেমে আসে। প্রতি বছরই এই চিত্র কোনো না কোনোভাবে আমরা প্রত্যক্ষ করছি। কোনো বছর হয়তো একটু বেশি কোনো বছর হয়তো কিছুটা কম; কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখবেন সারা বছরই শ্রমিকদের পাওনা আদায়ের জন্য আন্দোলন করতে হয় অথবা অপেক্ষা করতে হয়। ঈদের সময় বিষয়টি বেশি দৃশ্যমান হয়। বেতন-বোনাসের যৌক্তিক দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে অনেকে কারাবন্দি হয়েছেন। এখনো ৩৫ জন শ্রমিক কাশিমপুর কারাগারে বন্দি আছেন। ঈদের আনন্দ তাদের ঘরে পৌঁছায়নি। সেই সব শ্রমিকদের পরিবারের অবস্থা কেমন একবার ভেবে দেখুন।

মনে করা হয় ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তাদের মধ্যে এলসি খোলা, শিপমেন্ট করা, অর্থপ্রাপ্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকতে পারে বলে আর্থিক সংকটে থাকেন তারা; কিন্তু আসলে গার্মেন্টসের ব্যবসায়ীরা প্রায় পুরোটাই ঋণ নিয়ে এসব করেন। তাদের ফান্ডও চলমান থাকে। অনেক ব্যবসায়ীর আবার একাধিক ব্যবসা থাকে গার্মেন্টসের বাইরে। হয়তো দেখা যায় পণ্য রপ্তানি বা বিপণন করে যে অর্থ উপার্জিত হচ্ছে মালিক পক্ষ তা দ্রুত অন্য কোনো প্রকল্পে বিনিয়োগ করে ফেলছেন; কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধের সময়। এই অবস্থায় তারা শ্রমিকদের মজুরি প্রদান বিলম্বিত করেন। অথবা সরকারের কাছ থেকে সহায়তা কামনা করেন। উদ্যোক্তাগণ সব সময়ই দেখাতে চান যে, শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধের মতো অর্থ তাদের হাতে থাকে না।

প্রতি বছর ঈদের আগে কারখানা শ্রমিকদের বেতন-ভাতা এবং বোনাস দেয়া নিয়ে যে সমস্যা হচ্ছে এখানে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় আছে। শ্রমিক-কর্মচারীরা বেতন-ভাতার জন্য যখন আন্দোলন করে তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি ধারণা সৃষ্টি হয় যে ব্যবসা করছেন মালিক; কিন্তু শ্রমিকরা কেন সরকারের কাছে মজুরি চায়? এটা মিডিয়ার তৈরি করা একটি ধারণা। শ্রমিকরা আসলে সরকারের কাছে টাকা চাচ্ছে না। তারা সরকারের কাছে সমস্যাটি তুলে ধরে প্রতিকার কামনা করছে মাত্র। এবার দেখা গেল সরকার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মালিকদের বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে। সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেছে তারা ভালো কিছু করছেন; কিন্তু এটা অর্থহীন। কারণ এ ধরনের উদ্যোগ শ্রমিক-কর্মচারীদের সমস্যা সমাধানে কোনো ফল দিচ্ছে না।

এমন মালিক আছেন যারা প্রবাসে থাকেন, স্থানীয়ভাবে কারখানা পরিচালনার জন্য ব্যবস্থাপনা কমিটি করে দিয়েছেন তারাই কারখানা পরিচালনা করে। এক সময় লভ্যাংশটি নিয়ে যান। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের সময় এলে অজুহাত দেখানো হয় যে মালিক তো বিদেশে অবস্থান করছেন বেতন-ভাতা কীভাবে পরিশোধ করব? কারখানা মালিকদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি এক ধরনের ধোঁকাবাজি। কারণ এসব মালিক সব সময়ই বিদেশেই অবস্থান করেন। কাজেই কারখানা মালিক বিদেশে পালিয়ে যাওয়া না যাওয়ার উপর শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন পাওয়া না পাওয়া নির্ভর করে না। যেসব কারখানা মালিকদের বিরুদ্ধে বেতন-ভাতা নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধ না করার ব্যাপারে কোর্টে মামলা আছে তাদের বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেয়া যেতে পারে।

সরকার গণমাধ্যমে প্রচার করেছে কারখানা মালিকের গাড়ি বিক্রি করে পাওনা বেতন পরিশোধের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সারা দেশের মানুষকে জানানো হয়েছে, কারখানা শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হয়েছে। আসল ঘটনা সামনে আসেনি। কোন শ্রমিককে হয় ৫ হাজার টাকা বা ৯ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে; কিন্তু তার পাওনার পরিমাণ হয়তো ৫০ হাজার বা ৭০ হাজার টাকা। এটা এক ধরনের প্রতারণার কৌশল। ঢালাওভাবে কারখানা মালিকের সম্পত্তি অধিগ্রহণ করা কোনো স্থায়ী সমাধান হবে না। শ্রমিক-কর্মচারীরা কখনোই চায় না তাদের কারখানা মালিককে গ্রেপ্তার করা হোক এবং তৎপ্রেক্ষিতে কারখানা বন্ধ হয়ে যাক। তারা সব সময়ই চায় কারখানা ভালোভাবেই পরিচালিত হোক এবং তাদের বেতন-ভাতাও নিয়মিত পরিশোধ করা হোক।

একটি রেগুলেশনের মাধ্যমে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা নির্ধারিত সময়ে পরিশোধের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। কারখানা শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে গেলো। আগামীতে যে রাজনৈতিক সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করবে তাদেরও সমস্যায় পড়তে হবে। গণআন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তিত হলে সাধারণ মানুষ সেই পরিবর্তিত সরকারের ওপর আস্থা রাখতে চায়; কিন্তু সরকার যদি এ ধরনের কাজ করেন তাহলে সরকারের ওপর সাধারণ মানুষের কোনো আস্থা থাকবে না। সরকার যদি পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তাহলে অরাজকতা আরও বেড়ে যেতে পারে। শ্রমিক-কর্মচারীরা আরও বেশি সংখ্যায় রাস্তায় নেমে আসতে পারে। শ্রমিকদের রাস্তায় নেমে আসা বন্ধ করতে চাইলে সরকারকে স্থায়ী সমাধানের দিকে যেতে হবে।

শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদান নিয়ে যে সমস্যা হয় তার স্থায়ী সমাধানের কিছু পথ আছে। প্রথমেই লক্ষ্যণীয়, এবার ঈদের আগে কতগুলো প্রতিষ্ঠান তাদের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-বোনাস প্রদান করেনি তার পরিসংখ্যান ঠিক, মতো পাওয়া যায় নি। যদি না জানা যায় কারা বেতন পায়নি তাহলে সমাধান কি করে হবে? আন্দোলন এবং বেতন-ভাতা পরিশোধ নিয়ে শিল্পাঞ্চল পুলিশ এবং বিজেএমইর তথ্যের মধ্যে গরমিল লক্ষ্য করা যায়। দুই কর্তৃপক্ষ দুধরনের তথ্য দিয়ে যাচ্ছে এটা আসলে বিভ্রান্তিকর। এসব ক্ষেত্রে সঠিক তথ্য জাতিকে জানানোর জন্য সরকারের একটি সেল থাকা প্রয়োজন।

সরকার গঠিত সেল তিন মাসে আগে নিশ্চিত করবে মালিক পক্ষ ঈদের আগে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-বোনাস দিতে পারছে কিনা। ঈদ একটি বড় আনন্দ উৎসব। ঈদের সময় সবাই পরিবার পরিজনের সঙ্গে মিলে আনন্দ করতে চায়। তাই এই সময় তাদের পাওনা অর্থ প্রদান থেকে বঞ্চিত করা কোনোভাবেই উচিত নয়। এটা অমানবিক কাজ। ঈদের সঙ্গে বছরের অন্য সময়ের পার্থক্য রয়েছে। আর ঈদের আগে টাকার চাহিদাও বেড়ে যায়। সরকারি উদ্যোগে ঈদের অন্তত তিন মাস আগে থেকে নজরদারি করতে হবে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে কিনা। একই সঙ্গে তারা শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-বোনাস দেবার মতো সামর্থ্য রাখে কি না। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি আর্থিক সমস্যার কারণে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-বোনাস পরিশোধ করার মতো অবস্থানে না থাকে তাহলে সরকার সেই কারখানার জন্য ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন।

দ্বিতীয় একটি উপায়ে স্থায়ী সমাধান করা যায়। যেমন, বিজেএমইএ একটি ফান্ড গঠন করতে পারে। এই ফান্ড থেকে সমস্যাগ্রস্থ কারখানা মালিকরা জরুরি মুহূর্তে বিনা সুদে অথবা তুলনামূলক স্বল্প সুদে ঋণ নিতে পারে। যেসব কারখানা উৎপাদনরত আছে তাদের কাছ থেকে এই ফান্ডের জন্য প্রতি মাসে কিছু কিছু অর্থ সংগ্রহ করা যেতে পারে। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি গৃহীত ঋণের অর্থ সঠিক সময়ে পরিশোধ না করে তাহলে বিজিএমইএ তাদের বিরুদ্ধে এলসি বন্ধকরণসহ বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। এ ধরনের ফান্ড গঠনের আগে কারখানা এবং শ্রমিকদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য থাকতে হবে। কারণ ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কোনো সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। আরেকটি উপায় হলো,ব্যবসায়ীরা ঋণ নেবার সময় তাদেরকে সারা বছরের বেতনের একটি অংশ (দুই/তিন মাসের) যদি ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট রেখে দেয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়, তাহলেও এই টাকা অনিশ্চয়তার সময় বেতন পরিশোধে ব্যবহার করা যেতে পারে।

শ্রমিক-কর্মচারীরা বেতন-বোনাসের দাবিতে রাস্তায় নামার আগেই যেন তাদের সমস্যা সমাধান করা যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা এমন সংস্কারমূলক ব্যবস্থা নেবেন যা শ্রমিক বান্ধব এবং একই সঙ্গে ফ্যাক্টরির জন্য টেকসই সমাধান। সব সময় শ্রমিকের নিয়মিত বেতন প্রাপ্তির প্রসঙ্গ এলেই বলা হয়, ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দিতে হবে। এটা কোনো সমাধান বয়ে আনে না। দুই পক্ষের সুবিধা-অসুবিধা বুঝেই এই স্থায়ী সমাধান করতে হবে।

ড. মোশাহিদা সুলতানা: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, সহযোগী অধ্যাপক, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

অনু লিখন: এম এ খালেক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ