পেট্রোবাংলায় আমলানির্ভরতা কমান
দেশে ক্রমাগত জ্বালানি সংকট বাড়ছে। গ্যাসের অভাবে অনেক কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাসা-বাড়িতেও রান্না-বান্নার সমস্যা হচ্ছে। জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ খাতেও তার মারাত্মক প্রভাব পড়ছে; কিন্তু তীব্র জ্বালানি সংকটের মধ্যেও বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) তেমন গতিশীলতা চোখে পড়ছে না। বরং দিন দিন প্রতিষ্ঠানটির গতি কমে আসছে। এর কারণ প্রতিষ্ঠানটির আমলানির্ভরতা।
গতকাল শনিবার (২৩ নভেম্বর) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, আমলানির্ভর পেট্রোবাংলা চলছে শম্বুকগতিতে। লোক দেখানো পরিকল্পনা আর দফায় দফায় বৈঠক করেই সময় পার করছে সংস্থাটি। ২০১৫ সালে যেখানে দেশীয় উৎস থেকে গ্যাসের জোগান ছিল দিনে ২৭০ কোটি ঘনফুট; গত ৯ বছরে তা কমে হয়েছে ২২২ কোটি ঘনফুট।
দেশের গ্যাস অনুসন্ধানে ধীরগতি ও এলএনজি আমদানিতে ঝোঁক জ্বালানি খাতে বড় সংকট তৈরি করেছে। চাহিদা অনুসারে গ্যাস না পাওয়ায় শিল্প, বাণিজ্য ও বিদ্যুৎ উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পিছিয়ে পড়ছে অর্থনীতি। অনুসন্ধানে স্থবিরতার পাশাপাশি গ্যাস সরবরাহ এবং রাজস্ব আদায়েও ব্যর্থ পেট্রোবাংলা। সিস্টেম লসের নামে শিল্প-কারখানায় অব্যাহত গ্যাস চুরির ঘটনা ঘটছে। কিছু অভিযান চালানো হলেও গ্যাসের অপব্যবহার বন্ধ হচ্ছে না। দেশে গ্যাসের চাহিদা দিনে ৪২০ কোটি ঘনফুট।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, পেট্রোবাংলার পরিচালনা পর্ষদের ৯ সদস্যের ছয়জনই আমলা। এর মধ্যে চেয়ারম্যান হন একজন অতিরিক্ত সচিব। আর পরিচালক প্রশাসন ও অর্থ পদে দুজন যুগ্ম সচিব নিয়োগ পান। এ ছাড়া পর্ষদে অর্থ, জ্বালানি ও পরিকল্পনা বিভাগ থেকে একজন করে যুগ্ম সচিব থাকেন। পেট্রোবাংলার নিজস্ব জনবল থেকে পরিচালক হন মাত্র তিনজন।
সূত্র জানায়, গত কয়েক বছরে নানা ধরনের পরিকল্পনা নিয়েছে পেট্রোবাংলা। তার মধ্যে ১০০ কূপ খননের উদ্যোগ ও সমুদ্রে গ্যাস ব্লক ইজারা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে এসব পরিকল্পনার খুব কমই বাস্তবায়ন হয়েছে। ভোলা ও সিলেটে কয়েকটি নতুন ও পুরোনো কূপে মিলেছে গ্যাস, যা চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। ২০১৪ সালের পর থেকে সমুদ্রে গ্যাসের অনুসন্ধানে সিরিজ বৈঠক, টেন্ডার ও পরিকল্পনাতেই আটকে আছে। ফলে দেশের জ্বালানি খাত দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে পেট্রোবাংলা চলছে আমলা দিয়ে। তারা জনস্বার্থ না দেখে গত আওয়ামী সরকারের দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের হয়ে কাজ করেছেন। সরকারের পতনের পরও এই খাতে তেমন পরিবর্তন আসেনি; একই ধারায় চলছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, এভাবে চলতে থাকলে পেট্রোবাংলা যে পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে তাতে আগামী ৪ থেকে ৫ বছরের মধ্যে তেমন কোনো সফলতা আসবে না।
দেশের চাহিদা মেটাতে আমদানিনির্ভর এলএনজিই হবে একমাত্র ভরসা। তবে দেশের আর্থিক খাতে যে সংকট তাতে এলএনজি আমদানি করে চাহিদা আদৌ মেটাতে সরকার সক্ষম হবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, পেট্রোবাংলাকে গতিশীল করতে হলে আমলানির্ভরতা কমাতে হবে। কারণ খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনে প্রয়োজন দক্ষ ভূতত্ত্ববিদ ও প্রকৌশলী।
কিন্তু এখানে অতিরিক্ত সচিবকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারা সচিব হওয়ার আশায় থাকেন। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বা সংস্থার উন্নয়নে তাদের ভাবনা কম থাকে। তারা সবসময় সরকারের তুষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকেন। আমরা চাই পেট্রোবাংলার আমলানির্ভরতা কমানো হোক। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষ বিশেষজ্ঞ ও কর্মীদের নিয়োগ দেয়া হোক। দেশ-জাতির কথা ভেবে যারা মনেপ্রাণে কাজ করবেন।
সময়োযোগী উদ্যোগ গ্রহণের মধ্য দিয়ে জ্বালানি বাড়ানো না গেলে দেশ গভীর সংকটে পড়বে। যত দ্রুত সম্ভব অন্তত ১০টি কূপ খনন করা হোক। ১০০ কূপ খননের আশ্বাস দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত না করা হোক। আগামী ১০ বছরে ১০টি কূপ খননই যেখানে প্রায় অসম্ভব, সেখানে ১০০ কূপ খননকের আশ্বাস আকাশ-কুসুম কল্পনা। বাস্তবানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে দেশের গ্যাসসহ জ্বালানি-সংকট শিগগিরই পেট্রোবাংলা দূর করবে- এমনটাই আমরা চাই।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে