বন্ধুদের দাবি
ফোনে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয় জাবির শামীমকে
ছাত্রলীগ নেতা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯তম ব্যাচের ছাত্র শামীম মোল্লাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই ফোন করে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে দাবি করেছেন তার একাধিক বন্ধু ও ঘনিষ্ঠজন। শামীমের একাধিক সহপাঠী ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে সখ্য বজায় রেখে চলতেন শামীম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাড়ার সময় তার সখ্য ছিল ছাত্রদল, বাম রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীর সঙ্গেও। বন্ধুরা ধারণা করছেন, সেই সখ্যই কাল হলো শামীমের। তাদের অভিযোগ, পুরোনো সেই সখ্যর সূত্র ধরেই কয়েকজন শামীমকে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলার জন্য গত ১৮ সেপ্টেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ডাকেন। অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, শামীমকে প্রথমে পেটানোর সময়ই ঘটনাস্থল থেকে তার মোবাইল ফোনটি সরিয়ে ফেলা হয়।
শামীমের এক সহপাঠীর অভিযোগ, ফোনের কললিস্ট যাতে প্রকাশ না পায়, সেজন্য আগেই তার ফোনটি সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। এ অভিযোগের ব্যাপারে সত্যতা মেলে আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিকের সঙ্গে কথা বলে। তিনি ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা যখন শামীমকে আমাদের হেফাজতে নেই তখনই তাকে তল্লাশী করি। তার কাছে কোনো মোবাইল ফোন পাইনি। এ বিষয়ে ক্যাম্পাসে উপস্থিত কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করলে তারাও বলেন, শামীমকে ক্যাম্পাসের ভেতরে আনার সময় তাকে সার্চ করে তার কাছে মোবাইল ফোন পাওয়া যায়নি।’ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আবু বকর সিদ্দিকী বলেন, ‘নিহত শামীমের মোবাইল পাওয়া না গেলেও তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে আমরা তার সর্বশেষ কল রেকর্ড বের করার চেষ্টা করবো। তাতে অনেক সত্যই জানা যাবে। গ্রেফতার আসামিদেরও থানায় ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। একটু সময় দেন। কাল (সোমবার) আসামিদের কোর্টে চালান দেওয়ার পর তদন্ত পুরোদমে শুরু হবে।’
শামীমের বেশ কয়েকজন সহপাঠী ও বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, গত বুধবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জয়বাংলা গেটে একটি চায়ের দোকানে পরিচিত কারও জন্য অপেক্ষা করছিলেন শামীম। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শামীমের পূর্বপরিচিত কেউ বা কারা তাকে নিরাপত্তা দেয়ার আশ্বাসে জরুরি প্রয়োজনে ক্যাম্পাসে ডাকে। পূর্বপরিচিত এবং সুসম্পর্ক থাকায় শামীম তাদের সঙ্গে দেখা করতে ক্যাম্পাসে আসার সিদ্ধান্ত নেয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের জয়বাংলা গেটে তাদের জন্য অপেক্ষা করে।
এ সময় আগে থেকেই তথ্য পাওয়া তিন-চারজন শিক্ষার্থী সেখানে উপস্থিত হয় এবং শামীমকে মারধর শুরু করে। এরপর তারা শামীমকে টেনেহিঁচড়ে ক্যাম্পাসের ভেতরে নিয়ে যায়। সেখানে আরও কয়েকজন এসে লাঠিসোটা দিয়ে তাকে মারধর করে। সন্ধ্যা ৬টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টোরিয়াল টিম এবং নিরাপত্তা শাখার কর্মকর্তারা শামীমকে উদ্ধার করে প্রক্টর অফিসে নিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের কয়েকজন প্রক্টর অফিসে এসে কলাপসিবল গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে সেখানে করিডোরে পড়ে থাকা আহত শামীমকে আবার বেধড়ক মারধর করে। এরপর রাত সাড়ে ৮টার দিকে প্রক্টোরিয়াল টিম গুরুতর আহত শামীমকে আশুলিয়া থানা পুলিশের হাতে সোপর্দ করে। এর পর রাত ৯টার দিকে সাভার গণস্বাস্থ্য মেডিকেলে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেন আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার (ওসি) মো. আবু বকর সিদ্দিক।
কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, শামীমকে পেটানোর সময় ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি সাইদ ভূঁইয়া উপস্থিত ছিলেন। সাইদ ভূঁইয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী, যিনি অনেক আগেই পাস করে বের হয়ে গেছেন। তার এ সময় ক্যাম্পাসে থাকার কথা নয়। যদিও পরে গত ১৯ আগস্ট এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ছাত্রদলের বর্তমান সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব এবং সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দীন এ ঘটনাকে অপপ্রচার দাবি করে জানান, বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের কোনো কমিটি নেই। এ ছাড়াও ছাত্রদল বা অঙ্গসংগঠনের কোনো নেতাকর্মী ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল না।
শামীম হত্যার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার বিভাগের ৪৯তম ব্যাচের আহসান লাবিব, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের রাজু আহাম্মদ, ইংরেজি বিভাগের ৫০তম ব্যাচের মাহমুদুল হাসান রায়হান, ইতিহাস বিভাগের ৪৪তম ব্যাচের জুবায়ের আহমেদ, ইংরেজি বিভাগের ৪৯তম ব্যাচের হামিদুল্লাহ সালমান, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের ৪৯তম ব্যাচের মো. আতিকুজ্জামান, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের সোহাগ মিয়া, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ রাজন মিয়ার নাম উল্লেখ করে মামলা হয়েছে।
অভিযুক্ত আহসান লাবিব ও মো. আতিকুজ্জামান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সমন্বয়ক। বাকি শিক্ষার্থীরা শাখা ছাত্রদলের সদস্য। শামীম হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ায় ওই আট শিক্ষার্থীকে বৃহস্পতিবার সাময়িক বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। যদিও বহিষ্কৃত আট শিক্ষার্থীর মধ্যে তিনজন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থী না। সাবেক শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারাদেশ দেয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশাসনের কর্মদক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে প্রতিবাদ জানায়। শামীম হত্যার প্রতিবাদে ১৮ সেপ্টেম্বর রাতেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ জানিয়ে মিছিল বের করে।
এ ঘটনাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং পূর্বপরিকল্পিত দাবি করলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই ঘটনাকে ‘গণপিটুনি’ উল্লেখ করে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক স্বাধীন সেনকে সভাপতি করে ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটিকে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। ঘটনাটিকে কেন গণপিটুনি উল্লেখ করা হয়েছে, তদন্ত কমিটিকে কেন ৩০ কার্যদিবসের দীর্ঘ একটি সময়ের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে এবং প্রক্টর অফিসে এসে কলাপসিবল গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে কীভাবে শামীমকে পেটানো হয়েছে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তদন্ত চলাকালে কোনো মন্তব্য করা যাবে না বলে জানান।
এদিকে শামীম হত্যাকাণ্ডের জেরে ক্যাম্পাসের সার্বিক নিরাপত্তা, পড়ালেখার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতকরণ এবং এই হত্যার সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে শনিবার দুপুর ২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এবং বর্তমান শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনারে মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করেন। মানববন্ধন কর্মসূচি শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি পেশ করা হয়। নিহত শামীম ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি আশুলিয়া ইউনিয়নের কাঠগড়া এলাকার ইয়াজ উদ্দিন মোল্লার ছেলে। ইয়াজ উদ্দিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মচারী ছিলেন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে