কবি শার্ল বোদলেয়ারের ফটোগ্রাফি-ভাবনা
ফরাসি কবি ও শিল্প-সাহিত্য সমালোচক শার্ল বোদলেয়ার (১৮২১-১৮৬৭) সম্পর্কে বলতে গিয়ে বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, ‘শুধু কবিতাই নয়, চিত্রকলাও তার বাণে বিদ্ধ হয়েছে; তার কবিতাকে ছবির ভাষায় সৃষ্টি করে নিয়েছেন রদাঁ, রুয়ো ও মাতিসের মতো শিল্পীরা; এবং রদাঁ, তার নিঃসঙ্গ ও অবজ্ঞাত যৌবনে, যে-দুই কবিকে ভেদ করে ধীরে ধীরে আপন পথটি দেখতে পান, তারা দান্তে ও বোদলেয়ার।’
বোদলেয়ার নিজের কাব্য-প্রতিভা দিয়ে শুধু শিল্পকলাকে প্রভাবিতই করেননি- শিল্পকলার ময়নাতদন্ত করে তার ভেতরটা দেখতে চেয়েছিলেন। তার আগে শিল্পকলাকে এতো গভীরভাবে খুব বেশি সমালোচক দেখেননি। হয়তো এজন্যই তাকে আধুনিক শিল্পসমালোচনার জনক বলা হয়। যদিও মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি আধুনিকতাবিষয়ক অন্তর্দ্বন্দ্বের সমাধান খুঁজে পাননি।
তার কাছে প্রকৃত শিল্পী তিনি- যিনি নিজের সমকালের আত্মাকে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম। শিল্পী গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সাধারণ-অসাধারণ সবখান থেকেই সৌন্দর্যকে খুঁজে নিতে জানেন। তার মতে, একজন শিল্পী শুধু শিল্পী নয়- দার্শনিকও।
নিজের কবিতায় তো বটেই- শিল্পসমালোচক হিসেবেও তিনি রোমান্টিসিজম ও রিয়ালিজমের মিলন ঘটাতেন। আবার কখনোবা ‘ক্লাসিক ও রোমান্টিকের চিরাচরিত দ্বৈতককে তিনি লুপ্ত করে দেন।’ তার প্রথাবিরোধী কবি ও শিল্পসমালোচক হয়ে ওঠার পেছনে কাজ করেছে গভীর জীবনবোধ। তিনি পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে গিয়ে জীবনকে বুঝার চেষ্টা করেছেন এবং যা বুঝছেন তাই লিখেছেন অকপটে।
আধুনিকতাকে তিনি একদিকে দুহাত প্রসারিত করে গ্রহণ করেছেন অন্যদিকে আধুনিকতার নামে মানুষের যন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়া নিয়েও ছিলেন উদ্বিগ্ন। তার সেই উদ্বেগের ছায়াই পড়েছে ১৮৫৯ সালে লেখা ‘দ্য মডার্ন পাবলিক অ্যান্ড ফটোগ্রাফি’ প্রবন্ধে। তার সমালোচনা সাহিত্যকর্মগুলোর মধ্যে এই প্রবন্ধটি ভীষণ ব্যতিক্রমধর্মী ও গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রবন্ধে তিনি যে প্রশ্নগুলো তুলেছিলেন, সেগুলো আজো প্রাসঙ্গিক এবং চিন্তার খোরাক জোগায়।
আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে ড্যাগুয়্যারোটাইপ ক্যামেরা আবিষ্কারের মাত্র দুই দশকের মাথায়। তখনো ক্যামেরা তার অপরিসীম ক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগ পায়নি, তৈরি হয়নি কোনো আলোকচিত্রশিল্পী। ক্যামেরা তখনো তার সীমাবদ্ধতা নিয়ে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে যাচ্ছিল। অন্তত বিংশ শতাব্দীর আগে ক্যামেরা ছিল বাস্তবের হুবহু নকল করার এক বিস্ময়কর যন্ত্র।
এমন এক সময় বোদলেয়ার দেখলেন, মানুষ ‘শিল্প’ বলতে বাস্তবতার হুবহু নকলকেই গ্রহণ করছে। তিনি তার এই প্রবন্ধের মাধ্যমে মূলত নিজের হতাশার কথা ব্যক্ত করেছেন। ক্যামেরার সাহায্যে চোখে দেখা দৃশ্যের নকল করতে প্রায় সবাই উঠেপড়ে লেগে গেছে; কিন্তু বোদলেয়ারের কাছে বাস্তবতার অনুলিপি শিল্প নয়। শিল্প বাস্তব জগৎ থেকে নয়- উঠে আসে মনের জগৎ থেকে। আর মনের জগতেই তো আছে কল্পনার স্বাধীনতা। কবির কাছে কল্পনা হলো: ‘the queen of the faculties.’।
তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, মানুষকে তার মনের জগৎ থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে ফটোগ্রাফি। কল্পনার রং দিয়ে সৃষ্টি করা না গেলে কোনো কর্মই শিল্পোত্তীর্ণ হয় না। তিনি শুধু তার এই প্রবন্ধেই নয়- কবিতাতেও এ ধরনের ইঙ্গিত দিয়েছেন,
‘আমার নিশার স্বপ্নে এই কালো আলেখ্য সঞ্চরে,
ধ্যানের দৃষ্টিতে আমি নিজেকেই দেখি অবিকল’
‘That is the black picture that in a dream one night
I saw unfold before my penetrating eyes.’
কিংবা,
‘কেউ কেউ হৃদয়ের প্রতিমাকে না-জেনে, অস্থির,
দুর্ভাগা ভাস্কর যেন, চিহ্নিত শাপের অপমানে,
আপন ললাটে বক্ষে হাতুড়ির অত্যাচার হানে’
‘There are some who have never known their Idol
And those sculptors, damned and branded with shame,
Who are always hammering their brows and their breasts’
তার মানে এ নয় বোদলেয়ার ফটোগ্রাফিকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তার মতে, ফটোগ্রাফিকে স্মৃতির আয়না হিসেবে দেখা যায়- শিল্পের আয়না বলে ধরে নেয়া যায় না। তিনি বলছেন, মানুষ নার্সিসাসের মতো নিজের চেহারা ক্যামেরার প্লেটে দেখে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে (Our loathsome society rushed, like Narcissus, to contemplate its trivial image on a metallic plate)। যদিও সেই ছবি শিল্পকর্ম নয়। শিল্পের জায়গা ফটোগ্রাফি নিতে পারে না। ফটোগ্রাফি বিজ্ঞানী, পর্যটক বা গবেষকের কাজে আসতে পারে; কিন্তু তাকে যদি আমরা শিল্পের জায়গায় বসাই তাহলে তা শিল্পকে বিনষ্ট করবে,
‘Let it (photography) hasten to enrich the tourist’s album... the botanist’s; let it reproduce those precious but fragile things...If photography is allowed to supplement art in some of its functions, it will soon have supplanted or corrupted it altogether.’
কারণ, ফটোগ্রাফির সঙ্গে কল্পনার মিশেল হয় না, তা নিছকই বাস্তবের প্রতিরূপ। আলোচ্য প্রবন্ধের মূল সুর- কল্পনাশক্তিই মানুষের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য যা ছাড়া সত্যিকার অর্থে শিল্পের সৃজন হয় না। তার কাছে বাস্তবতার সংজ্ঞাও ভিন্ন, আমাদের কল্পনা ও স্বপ্নের ভেতরের জগৎকে ফুটিয়ে তোলাই রিয়ালিজম।
ফটোগ্রাফি নিয়ে বোদলেয়ারের ভাবনার প্রতিফলন আমরা তার পরের কবি রবীন্দ্রনাথের মধ্যে দেখি। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে বিশ্বকবি ক্যামেরা সম্পর্কে বলছেন, ‘ফোটোগ্রাফের ক্যামেরাকে কৃত্রিম চোখ বলিতে পারি। এই ক্যামেরা খুব স্পষ্ট করিয়া দেখে; কিন্তু সম্পূর্ণ করিয়া দেখে না, তাহা চলতিকে দেখে না, যাহাকে দেখা যায় না তাহাকে দেখে না। এইজন্য বলা যায় যে, ক্যামেরা অন্ধ হইয়া দেখে। সজীব চোখের পিছনে সমগ্র মানুষ আছে বলিয়া তাহার দেখা কোনো আংশিক প্রয়োজনের পক্ষে যতো অসম্পূর্ণ হোক মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পূর্ণ ব্যবহারক্ষেত্রে তাহাই সম্পূর্ণতর। বিধাতার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ যে তিনি চোখের বদলে আমাদিগকে ক্যামেরা দেন নাই।’
তবে ফটোগ্রাফির প্রতি বোদলেয়ার রবীন্দ্রনাথের চেয়ে অনেক বেশি নির্দয় ছিলেন। তার মতে, ফটোগ্রাফিকে (সেকালে) গ্রহণ করেছিল ব্যর্থ ও অলসরা,
‘The photographic industry became the refuge of all failed painters-with too little talent, or too lazy to complete their studies.’
তবে তিনি তার নিজের বক্তব্য নিয়ে কিছুটা সন্দিহানও ছিলেন বলে মনে হয়। তিনি বলছেন, তিনি জানেন তাকে বলা হবে, নকল করার প্রবণতা আসলে নির্বোধ ব্যক্তিদের থাকে। একজন খাঁটি শিল্পী বা সত্যিকার শিল্পপ্রেমী শিল্প ও কারিগরির মধ্যে পার্থক্য করতে জানে; কিন্তু বোদলেয়ারের শঙ্কা ‘অস্বীকার করার উপায় নেই-শিল্পী সমাজকে প্রভাবিত করে, আর সমাজও শিল্পীর ওপর প্রভাব ফেলে।’ (It is an indisputable and irresistible law that artist acts upon the public, that the public reacts on the artist) শিল্পী যদি বাস্তবের অনুলিপিকে ‘শিল্প’ বলে চালিয়ে দেয় তাহলে তার প্রভাব সমাজে পড়তে বাধ্য অন্যদিকে সমাজ যদি অনুলিপিকে ‘শিল্প’ বলে মানতে শুরু করে তাহলে শিল্পীও সেই অভিপ্রায় দিয়ে প্রভাবিত হতে পারে। বোদলেয়ারেরইবা দোষ কোথায়! তিনি তো তার সময়ে এমনটি হতেও দেখেছেন,
‘More and more, as each day goes by, art is losing in self-respect, is prostrating itself before external reality, and the painter is becoming more and more inclined to paint, not what he dreams, but what he sees.’
‘প্রতিদিন একটু করে, শিল্প তার আত্মসম্মান হারাচ্ছে, বাহ্যিক বাস্তবতার কাছে মাথা নিচু করে ফেলছে। ফলে একজন চিত্রশিল্পী কল্পনানির্ভর না হয়ে যা চোখে দেখছে তাই আঁকতেই বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে।’
ফটোগ্রাফি সম্বন্ধে বোদলেয়ারের কথাগুলো রূঢ় মনে হলেও-অসত্য নয়। প্রবন্ধটি লেখার দেড়শ বছরেও বেশি সময় পরও আমরা দেখছি, ক্যামেরা বস্তু, মানুষ ও দৃশ্যের প্রতিলিপি করার কাজে লাগানো হচ্ছে। এই জাদুর বাক্সটি দিয়ে শিল্পকর্ম উদ্ভাবনের চর্চার ভীষণ অভাব। বোদলেয়ার আসলে ক্যামেরাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাননি-তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন ক্যামেরার পেছনের মানুষটির সৃজনশীল চিন্তার প্রতি। সেই সন্দেহ আজও করার সুযোগ রয়েছে।
সহায়ক গ্রন্থ:
শার্ল বোদলেয়ার: তার কবিতা - বুদ্ধদেব বসু
ছোটো ও বড়, কালান্তর, ১৩৪৪ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
The Flowers of Evil / Les Fleurs du Mal – Translated by William Aggeler
Baudelaire, Charles – The Painter of Modern Life (1863)
T.J. Clark – The Painting of Modern Life: Paris in the Art of Manet and His Followers
"Baudelaire and the Aesthetics of Modernity" - in The Cambridge Companion to Baudelaire
Jonathan Mayne (Translator & Editor) - The Painter of Modern Life and Other Essays (Phaidon Press)
Rosemary Lloyd. Baudelaire’s World. Cornell University Press, 2002
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে