পিলখানা হত্যা মামলা: এখনো অপেক্ষা আপিল নিষ্পত্তির
আজ বিভীষিকাময় পিলখানা হত্যা দিবস। ঢাকার পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দপ্তরে ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সংঘটিত হয়েছিল দেশের ইতিহাসে নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড। বর্বরোচিত ওই হত্যাকাণ্ডে জাতি হারিয়েছিল কৃতী ও চৌকস ৫৭ সেনা সদস্যসহ মোট ৭৪ জন। বিডিআরের বিপথগামী সদস্যরা বিদ্রোহের নামে প্রথমেই তৎকালীন বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদকে হত্যা করে। এরপর বিভীষিকাময় দুদিনে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা, নারী-শিশুসহ ৭৪ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
ওই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলায় ৮৪৬ জনকে আসামি করে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা হয়। মামলা দুটি পরবর্তীতে স্থানান্তর করা হয় নিউমার্কেট থানায়। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন বিচারিক আদালত। আর ২০১৭ সালে হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করেন।
বহুল আলোচিত এ ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতের রায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, এ ছাড়া ২৫৬ জনকে ১৭ থেকে ১ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। মামলায় খালাস পেয়েছেন ২৭৮ জন। বাকি ৪ আসামি নিম্ন আদালতে রায় ঘোষণার আগেই মারা যান।
এরপর এই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি শুরু হয় হাইকোর্টে। ৩৭০ কার্যদিবস শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর রায় ঘোষণা করে হাইকোর্ট। সেখানে মোট ৫৫২ জনকে শাস্তির আওতায় আনা হয়। খালাস দেয়া হয় ২৮৩ জনকে। নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৫২ জন আসামির মধ্যে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখে হাইকোর্ট। ৮ জনকে মৃত্যুদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন প্রদান করা হয় এবং ৫ জন খালাস পান। নিম্ন আদালতে ১৬০ জন যাবজ্জীবন প্রাপ্ত আসামির মধ্যে হাইকোর্ট ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখে এবং ১৪ জনকে খালাস দেন। নিম্ন আদালত যাদের খালাস দিয়েছিল, তাদের মধ্যে ৬৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে হাইকোর্ট ৩১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। এদের মধ্যে ৪ জনকে ৭ বছরের কারাদণ্ড এবং ৩৪ জনের খালাস আদেশ বহাল রাখেন হাইকোর্ট। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই প্রথম এত বেশিসংখ্যক আসামির সাজা হাইকোর্টে অনুমোদন হয়। দীর্ঘ বিচার ও রায় শেষে ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি পিলখানা হত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন হাইকোর্ট। তবে রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের করা আপিল শুনানি শুরু না হওয়ায় হত্যা মামলাটির নিষ্পত্তি হয়নি আজও। ফলে মামলাটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তির বিষয়টি থমকে আছে।
হাইকোর্টের রায়ে খালাস ও সাজা কম পাওয়া মোট ৮৩ জন আসামির মৃত্যুদণ্ড চেয়ে লিভ টু আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এ ধরনের আপিলের সংখ্যা ২০টি। অন্যদিকে, মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া দুই শতাধিক আসামি খালাস চেয়ে আপিল করেছেন। এ ধরনের আপিলের সংখ্যা ৪৭টি। সব মিলিয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত দুপক্ষের ৬৭টি আপিল ও লিভ টু আপিল দায়ের করা হয়েছে। যা এখন চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। তবে একে দীর্ঘসূত্রতা বলতে চান না অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। তিনি ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘দেশের ইতিহাসে আসামি ও সাজাপ্রাপ্তদের সংখ্যায় সবচেয়ে বড় এই মামলা তুলনামূলক দ্রুত নিষ্পত্তি হয়েছে। এটি অনেক বড় কাজ। সে হিসাবে নিম্ন আদালত ও উচ্চ আদালতে খুব অল্প সময়ে রায় ঘোষণা হয়েছে।’ ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পেলেও বিচারিক প্রক্রিয়ার জটিলতার কারণে আপিল শুনানি শুরু হতে দেরি হচ্ছে কি-না, জানতে চাইলে রাষ্ট্রের প্রধান এই আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী রায়ের কপি পাওয়ার ত্রিশ দিনের মধ্যে আপিল করার বিধান রয়েছে। আপিলের সময় পেরিয়ে গেলেও কারণ দেখিয়ে ও জরিমানা দিয়ে আপিলের সুযোগ রয়েছে। সে অনুযায়ী আপিল হয়েছে। সব আপিল দায়ের সম্পন্ন হলে রাষ্ট্র ও আসামি পক্ষ সার সংক্ষেপ জমা দেন। এরপর আপিল শুনানির জন্য তৈরি হয়েছে। এভাবেই বিচার প্রক্রিয়া চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন হবে। এরপর রিভিউ আবেদন করারও সুযোগ থাকবে, যা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।’
এদিকে বিডিআর বিদ্রোহের বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা মামলাটির বিচারকাজ ২০১১ সালে শুরু হলেও ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে তা এখনো চলছে। দুটি মামলার একই আসামি হওয়ায়, তাদের নিরাপত্তাজনিত কারণে প্রতি মাসে দুই থেকে তিন দিন মামলার কার্যক্রম চালানো হয়। এভাবে ধীরগতিতে এই মামলার কার্যক্রম চলতে থাকায় চূড়ান্ত নিষ্পত্তি কবে হতে পারে, সেটা এখনো অনিশ্চিত। হত্যা মামলায় খালাস পাওয়া ব্যক্তিরা এই বিস্ফোরক মামলার আসামি হওয়ায় তাদের মুক্তিও দেওয়া যাচ্ছে না।
অ্যাটর্নি জেনারেল জানান, বিস্ফোরক মামলায় আসামির সংখ্যা অনেক বেশি হলেও প্রসিকিউশন যদি মনে করে তার সবার সাক্ষ্য গ্রহণের দরকার নেই। অল্প কয়েকজনের সাক্ষ্য গ্রহণের ভিত্তিতে মামলা প্রমাণ করা সম্ভব। তাহলে তারা সবার সাক্ষ্য ছাড়াই রায় ঘোষণা করতে পারেন। সাক্ষিদের সাক্ষ্য নিতে পদ্ধতিগত বাধা থাকলেও রাষ্ট্রপক্ষের আন্তরিকতার অভাব নেই।
আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, ‘২৭৮ জন আসামি এ ঘটনায় হওয়া হত্যা মামলায় খালাস পেয়েছিলেন। তারা বিস্ফোরক মামলায়ও আসামি। তাই মামলাটি শেষ না হওয়ায় তারা কারাগার থেকে বের হতে পারছেন না। তাই আমরা আসামি পক্ষে চাই মামলাটি দ্রুত শেষ হোক; কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটি শেষ করার ক্ষেত্রে সিরিয়াস নয় বলে মনে হয়।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে