বেবিচকের অনুসন্ধানেই বের হলো থলের বিড়াল
প্রশিক্ষণের ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়েই তিনি উড়োজাহাজ চালিয়েছেন দুই যুগ!
প্রশিক্ষণের ভুয়া সার্টিফিকেট ও উড্ডয়ন ঘণ্টার ভুল তথ্য দিয়ে তিনটি বেসরকারি এয়ারলাইন্সে পাইলট হিসেবে প্রায় দুই যুগ চাকরি করেছেন তিনি। একটি এয়ারলাইন্সের পাইলটদের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তবে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে পাইলট হিসেবে নিয়োগের আবেদন করার পর তদন্তে সব জালিয়াতি ধরা পড়ে গেছে তার। তদন্ত করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি এখন দেশের বিমান চলাচল খাতে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। তবে তদন্তে এই অপকর্ম ধরা পড়ার পরও বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ।
এই পাইলটের নাম ক্যাপ্টেন নুরুদ্দীন আহমেদ আল মাসুদ। কমার্শিয়াল ফ্লাইটের পাইলট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করার আগে দেশের প্রশিক্ষণ শেষ করে তিনি ২০০১ সালের মার্চে ফিলিপাইনে শিক্ষানবিশ পাইলট হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য যান। তার তখনকার ভিসা ও পাসপোর্টের তথ্য অনুযায়ী তিনি ওই বছরের ৫ মার্চ ফিলিপাইনে যান পেশাগত প্রশিক্ষণের জন্য। সে সময়ের দলিলপত্র অনুযায়ী ফিলিপাইনের সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ ক্যাপ্টেন মাসুদকে ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ফিলিপাইনে প্রশিক্ষণ গ্রহণের অনুমতি দেয় এবং এ সময়ের পর তার ওই দেশে উড়োজাহাজ উড্ডয়ন প্রশিক্ষণ গ্রহণের আর কোনো সুযোগ ছিল না।
ফিলিপাইন থেকে দেশে ফিরে বাণিজ্যিক ফ্লাইটের পাইলট হিসেবে ক্যাপ্টেন মাসুদের পেশাগত অধ্যায়ের শুরু হয় বন্ধ হয়ে যাওয়া দেশের প্রথম বেসরকারি বিমান সংস্থা জিএমজি এয়ারলাইন্সে। এরপর কাজ করেন ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সে। এই এয়ারলাইন্সও বন্ধ হয়ে যায়। পরে ক্যাপ্টেন মাসুদ যোগ দেন ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সে। পরে এই বেসরকারি এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট অপরেশনের পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
২০২১ সালে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সেভেন থ্রি সেভেনের পাইলট হিসেবে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেন মাসুদ। ওই পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী হিসেবে সিভিল এভিয়েশনে পাঠানো হয় সব আবেদনকারীর কাগজপত্র। এসব কাগজপত্র যাচাই করে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। যাচাই বাছাই প্রক্রিয়ায় ক্যাপ্টেন মাসুদের জমা দেয়া দুটি সনদের একটি ভুয়া প্রমাণিত হয়। উড্ডয়ন ঘণ্টার তথ্যেও বড় ধরনের অনিয়ম ধরা পড়ে।
সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের যাচাই-বাছাই এর সময় দেখা যায়, ক্যাপ্টেন মাসুদ ২০০১ সালে ফিলিপাইনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ-সংক্রান্ত তিনটি সার্টিফিকেট জমা দিয়েছেন। এর একটিতে ২০০১ সালের ৫ মার্চ থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ১৩৩ ঘণ্টা ১২ মিনিট উড়োজাহাজ উড্ডয়নের উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ পাসপোর্টের তথ্য অনুযায়ী ক্যাপ্টেন মাসুদ ৫ মার্চ ফিলিপাইনে প্রবেশ করেন। এরপর তার প্রশিক্ষণ একাডেমিতে ডাক্তারি পরীক্ষাসহ উড্ডয়ন শুরুর জন্য কমপক্ষে তিন দিন থেকে এক সপ্তাহ সময় লাগার কথা। ফলে সার্টিফিকেটে ৫ মার্চ থেকে ফিলিপাইন উড্ডয়ন শুরুর তারিখ উল্লেখ করার বিষয়টি বড় ধরনের সন্দেহের সৃষ্টি করে। আর এই সার্টিফিকেটটি স্বাক্ষরিত হয়েছে ২০০১ সালের ২০ মার্চ! ফলে জালিয়াতির বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। ক্যাপ্টেন মাসুদ এ সময় ফিলিপাইন থেকে পাওয়া আরও একটি সার্টিফিকেট জমা দেন। এই সার্টিফিকেটে ২০০১ সালের ২৭ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ১৩৩ ঘণ্টা ১২ মিনিট উড্ডয়ন সম্পন্ন করার কথা বলা হয়েছে। এই সার্টিফিকেটটি স্বাক্ষরিত হয়েছে একই বছরের ৩০ এপ্রিল।
এরপর ক্যাপ্টেন মাসুদ ফিলিপাইনে নিজের প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে আরও একটি সার্টিফিকেট জমা দেন। এখানে ২০০১ সালের ২৭ মার্চ থেকে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত ৩৪৬ ঘণ্টা উড্ডয়নের তথ্য দেয়া হয়েছে অথচ ক্যাপ্টেন মাসুদের ৩০ এপ্রিলের পর ফিলিপাইনে প্রশিক্ষণ গ্রহণের কোনো অনুমতিই ছিল না। ফলে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ফিলিপাইনে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সার্টিফিকেটটি ভুয়া প্রমাণিত হয়। এ ছাড়া ক্যাপ্টেন মাসুদের জমা দেয়া লগ শিট অনুযায়ী ১৩৩ ঘণ্টা ১২ মিনিট উড্ডয়নের মধ্যে ২০০১ সালের ৫ এপ্রিল থেকে ১৮ এপ্রিল উড্ডয়ন করেছে ১৪ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট। আর ২৭ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত মাত্র ৯ দিনে বাকি ১১৮ ঘণ্টা উড্ডয়নের তথ্য দিয়েছেন, যা যে কোনো প্রশিক্ষণ উড্ডয়নের ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য। কারণ ৯ দিনে ১১৮ ঘণ্টা উড্ডয়নের অর্থ প্রতিদিন ১৩ ঘণ্টা উড্ডয়ন সম্পন্ন করা। এত দীর্ঘ ফ্লাইট পরিচালনার সুযোগ কোনো অবস্থাতেই একজন শিক্ষানবিশ প্রশিক্ষণার্থী পাইলটকে কোনো কর্তৃপক্ষই দিতে পারে না। প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষানবিশ পাইলটরা সাধারণত দিনে ৪ ঘণ্টার বেশি উড্ডয়নের অনুমতি পান না।
যাচাই-বাছাই পর্যায়ে এসব অনিয়ম তদন্তে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ফ্লাইট সেফটি ও রেগুলেশনস পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মুকিত উল আলম মিয়ার নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তবে এই তদন্ত কমিটি ক্যাপ্টেন মাসুদের দেয়া ৩৪৬ ঘণ্টার অবিশ্বাস্য উড্ডয়ন অভিজ্ঞতাকে সঠিক বলে জানায়। বেবিচকের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন নিয়েও গভীর সন্দেহের সৃষ্টি হলে বেবিচকের তৎকালীন চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল (অব.) মফিদুর রহমান ক্যাপ্টেন মাসুদের তিনটি সার্টিফিকেটের তথ্য যাচাই করার জন্য ফিলিপাইনের সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি লেখেন।
তিনি ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, 'সার্টিফিকেটের সত্যতা যাচাই-বাছাই না করে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হলে, বাংলাদেশ সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিকভাবে শাস্তির মুখোমুখি হতে পারে। একারণেই সার্টিফিকেটের তথ্য যাচাই করার প্রয়োজন ছিল।'
জবাবে ফিলিপাইনের সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ জানায়, তাদের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী ক্যাপ্টেন নুরুদ্দীন আহমেদ আল মাসুদের ২০০১ সালের ৫ মার্চ ফিলিপাইনে প্রবেশের পর তার মেডিকেল টেস্ট সম্পন্ন হয়। ফলে তার ১৯ মার্চের আগে প্রশিক্ষণের জন্য উড্ডয়নের কোনো সুযোগই ছিল না এবং ৫ মার্চ থেকে ১৮ মার্চ পর্যন্ত তার উড্ডয়নের কোনো রেকর্ড কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। এ ছাড়া ৯ দিনে ১১৮ ঘণ্টা উড্ডয়ন একেবারেই ‘অবাস্তব’ বলে উল্লেখ করে ফিলিপাইন সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিলের পর বাংলোদেশের শিক্ষানবিশ পাইলট নুরুদ্দীন আহমেদ আল মাসুদের ফিলিপাইনে অবস্থান, প্রশিক্ষণ গ্রহণ, উড্ডয়ন এবং ২০০১ সালে পরবর্তী সময়ে নতুন করে ফিলিপাইনে প্রবেশের কোনো তথ্য নেই, ফলে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ৩৪৬ ঘণ্টা উড্ডয়নের তথ্যও গ্রহণযোগ্য নয় বলেও জানায় ফিলিপাইন কর্তৃপক্ষ।
তবে এই ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদ দিয়েই ক্যাপ্টেন নুরুদ্দীন আহমেদ আল মাসুদ দেশের তিনটি বেসরকারি এয়ারলাইন্সে চাকরি করেছেন। ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট অপরেশনের পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। অবশ্য বেসমারিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে অভিজ্ঞতার তথ্য ও সনদ জালিয়াতির মতো গুরুতর অনিয়মের সত্যতা পেলেও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
এ বিষয়ে আর বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া ভিউজ বাংলাদেশকে জানিয়েছেন, ‘বিষয়টি বেবিচকের নজরদারির মধ্যে আছে। আইন মেনেই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোনো অনিয়ম প্রশ্রয় পাবে না’। তবে এ বিষয়ে জানার জন্য ক্যাপ্টেন নুরুদ্দীন আহমেদ আল মাসুদের বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হয়নি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে