সৌন্দর্যবর্ধনের চেয়ে জরুরি পরিবেশ উপযোগী গাছ
‘এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস’ এলিয়টের পোড়োভূমির পোড়খাওয়া অভিজ্ঞতা এবার এপ্রিলে ঢাকাবাসীর ভালোই হলো। সারা দেশেই যখন চলছে তীব্র তাপপ্রবাহ, ঢাকায় তা জ্বলন্ত উনুনের মতো। এর সবচেয়ে বড় কারণ ঢাকায় গাছের অভাব। খোলা জায়গা তো নেই-ই, নেই কোনো জলাশয়ও। তাই ঢাকাবাসীর ওপর গরম নেমেছে নরকযন্ত্রণার মতো।
ঢাকায় গাছপালা থাকা উচিত ২০ শতাংশ; কিন্তু আছে মাত্র ২ শতাংশ। আর ২১ শতাংশ জলাভূমি কমে হয়েছে প্রায় ৩ শতাংশ। এর মধ্যে গতকাল (২৮ এপ্রিল) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এক গবেষণা থেকে জানা গেছে, ঢাকায় যাও কিছু বৃক্ষ লাগানো হয়েছে, তার বেশির ভাগই পরিবেশ উপযোগী নয়।
ঢাকার আবহাওয়া ও মাটির সঙ্গে সেসব গাছের কোনো সম্পর্ক নেই। উপকারী তো নয়ই, বরং অপকারী। এসব গাছ অধিক পরিমাণ পানি টেনে নেয়, পর্যাপ্ত অক্সিজেনও উৎপন্ন করে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের একদল গবেষক রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন, এসব এলাকার ৫৮ শতাংশ গাছই বিদেশি প্রজাতির।
শোভাবর্ধন উদ্ভিদ আছে ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া, বাংলাদেশ জার্নাল অব প্ল্যান্ট ট্যাক্সনমিতে প্রকাশিত ২০২১ সালে গবেষণায় দেখা গেছে, সড়ক বিভাজকে ১৫ প্রজাতির গাছের সন্ধান পাওয়া গেছে, যার ৯টিই ছিল আগ্রাসী বিদেশি প্রজাতির।
গবেষকরা জানিয়েছেন, অথচ ঢাকার লাল মাটিতে শাল, চালতা, সিন্দুরির মতো প্রজাতির গাছ ভালো হয়। পরিবেশের সঙ্গে মানানসই; কিন্তু গত এক দশকে এসব প্রজাতির একটি গাছও কেউ লাগায়নি। উদ্ভিদবিদরা বলেছেন, ঢাকায় এমন গাছ লাগানো উচিত, যেসব গাছের পাতা বড় থাকবে। বড় পাতা থাকলে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে এবং বেশি করে অক্সিজেন দেবে।
কিন্তু তা না করে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে অনেক বিদেশি প্রজাতির গাছ লাগানো হচ্ছে। সরেজমিনে দেখা যায়, গত বছর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ‘নগর সবুজায়ন’ প্রকল্পের অধীনে যেসব গাছ লাগিয়েছে, তার বেশির ভাগই চায়নিজ টগর, রঙ্গন ফুল, বাগানবিলাস। কোথাও কোথাও লাগানো হয়েছে ঝাউজাতীয় গাছ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘বিদেশি প্রজাতির একাধিক গাছ ও চরাঞ্চলের গাছ কীভাবে রাজধানীতে লাগানো হয়?’
নগরায়নের সামগ্রিক অরাজক পরিস্থিতিই যেন এর মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে। এতেই বোঝা যায়, আমাদের নীতিনির্ধারকরা কতটা অসচেতন। একে তো উন্নয়নের নামে সব উন্মুক্ত স্থান ধ্বংস করে, বৃক্ষনিধন করে তারা ঢাকা শহরটাকে নরকতুল্য করেছেন, অন্যদিকে গাছ লাগানোর নামেও যা-তা কর্মকাণ্ড করছেন। তাদের যেন কোথাও জবাবদিহির বালাই নেই। কেন, দেশে কি উদ্ভিদবিদ নেই?
গাছ লাগানোর আগে তাদের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে না? তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগ আছে কী জন্য? শুধু লোক দেখানো সৌন্দর্যবর্ধনের চেয়ে আমাদের এখন জরুরি পরিবেশ উপযোগী গাছ লাগিয়ে যতটা পারা যায়, ঢাকা শহরকে একটু শীতল রাখা।
নানা কারণেই রাজধানী ঢাকা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এখনো হয়তো সময় আছে, উপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়ে ঢাকা শহরকে বাঁচানোর। নগর কর্তৃপক্ষ ঢাকাকে বাঁচিয়ে আমাদেরও প্রাণ বাঁচাবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা। অন্তত, ঢাকায় বৃক্ষরোপণে নগর কর্তৃপক্ষ সুবিবেচনার পরিচয় দেবেন- এটুকু ভরসা তো আমরা করতেই পারি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে