সবজির মূল্যে ধস: উদ্বিগ্ন কৃষক
গত পঞ্জিকা বর্ষে দীর্ঘতম খরা, পরবর্তী বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে শাকসবজির উৎপাদন ব্যাহত হয়েছিল। অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল মূল্য। পরে কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আশানুরূপ উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। এখন সবজির ভরা মৌসুম। বাজারে শীতের সবজির বিপুল সমারোহ। হরেক রকম সবজির বৈচিত্র্যময় পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। সরবরাহ বাড়ছে প্রতিদিন। ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে সবজির দাম। এখন সব ধরনের সবজির দামই ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে চলে এসেছে।
বর্তমানে একটি ফুলকপির দাম ১৫ থেকে ২০ টাকা। শিম ২০ থেকে ২৫ টাকা কেজি। করলার কেজি ৫০-৬০ টাকা। এক কেজি মুলা বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ টাকায়। একটি লাউয়ের দাম ২৫-৩০ টাকা। টমেটোর কেজি নেমে এসেছে ২০ টাকায় এবং কাঁচামরিচের কেজি ৪০ টাকা। এক মাস আগে এগুলোর দাম ছিল দ্বিগুণেরও বেশি। এর কারণ ছিল সরবরাহ সংকট। এখন দরপতন ঘটেছে সবজির। খামারপ্রান্তে এর দাম বাজার দরের অর্ধেকেরও কম। কৃষকদের অভিযোগ, সবজি বিক্রি করে উৎপাদন খরচও উঠে আসছে না। এই মূল্যবৃদ্ধি ও দরপতনের চালচিত্র হরহামেশাই আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত আমাদের জানা থাকা দরকার। দেখতে হবে বিভিন্ন সবজির উৎপাদন খরচ কত? কত এর গড় বিক্রয়মূল্য? আর তাতে কৃষকের লাভ কত? তাতে মৌসুমি মূল্যবৃদ্ধি ও দরপতনে ধৈর্যশীল হতে পারবেন আমাদের কৃষক ও ভোক্তাগণ। বিভিন্ন সবজির দামের ন্যায্যতা তারা অনুভব করতে পারবেন।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের উদ্যোগে সম্প্রতি বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন খরচ, এদের খামারপ্রান্তের বিক্রয়মূল্য, লাভ ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা সম্পর্কে গবেষণা হয়েছে। এ গবেষণার একটি প্রধান অংশীদার প্রতিষ্ঠান ছিল বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। ঐ ইনস্টিটিউটের কৃষি অর্থনীতি বিভাগ সমীক্ষা পরিচালনা করছে সবজির উৎপাদন খরচ ও এর লাভ নিয়ে। তারা যে তথ্য উপস্থাপন করেছে তাতে দেখা যায় সবজির উৎপাদন লাভজনক; কিন্তু খামারপ্রান্তে এর লাভ কম। কারণ, এর ওপর যানবাহন ও বাজারজাতকরণ খরচ, মধ্যস্বত্বভোগীদের মুনাফা এবং পচনশীলতার আর্থিক ক্ষতি যোগ করে নির্ধারণ করা হয় খুচরা বিক্রয়মূল্য। সবজি একটি পচনশীল পণ্য। এর পরিমাণ প্রায় ৩০ শতাংশ। সে কারণে খুচরা পর্যায়ে সবজির দাম খামারপ্রান্ত থেকে বেশি। নিষ্ফল মৌসুমে সবজির দাম চড়া থাকে। তখন ভোক্তরা থাকেন হতাশার মধ্যে। আবার উৎপাদনের ভরা মৌসুমে ভোক্তরা স্বস্তিতে থাকেন। অস্বস্তিতে থাকেন উৎপাদনকারী কৃষক।
গত তিন বছর ধরে পেঁয়াজের উচ্চমূল্যে ভোক্তারা নাকাল। এর উৎপাদন খরচ প্রতি কেজি প্রায় ২২ টাকা। খামারপ্রান্তে এর গড় মূল্য ৩০ টাকা। লাভ প্রায় ৮ টাকা প্রতি কেজি। খুচরা পর্যায়ে এর দাম হতে পারে ২৫-৩০ শতাংশ অপচয়সহ সর্বোচ্চ প্রায় ৫০-৫৫ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হলেও এর গড়মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৫০-৫৫ টাকা কেজি। সেক্ষেত্রে পেঁয়াজের দামে ধারাবাহিক উল্লম্ফন এবং পরপর দুই বছর ডাবল সেঞ্চুরি ও সেঞ্চুরি হাঁকানোর বিষয়টি উদ্বেগজনক। গত দুই বছর আগে এবং এ বছর আলুর উচ্চ মূল্যের বিষয়টিও এখানে উল্লেখযোগ্য। উৎপাদন খরচের ভিত্তিতে এবং সংরক্ষণ ও বিপণন খরচ যোগ করে আলুর সর্বোচ্চ মূল্য হতে পারত ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আলু আমদানি করা হলেও এর গড়মূল্য দাঁড়ায় ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। অথচ এবারের নিষ্ফল মৌসুমে ভোক্তাদের মূল্য দিতে হয়েছে প্রতি কেজি ৭০/৮০ টাকা। এটি ব্যবস্থাপনা সমস্যা। এতে ব্যবসায়ীদের কারসাজি আছে। এখানে সিন্ডিকেট ক্রিয়াশীল। এ সিন্ডিকেটের অতি মুনাফা আদায়ের কারসাজিকে অকার্যকর করার ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপ ছিল অপর্যাপ্ত। ফলে এ সংকট প্রলম্বিত হয়েছে। তাতে ভোক্তারা ঠকেছেন। এখন আবার আলু/পেঁয়াজের ভরা মৌসুমে খামারপ্রান্তে মূল্য কমে গেছে। তাতে উৎপাদক কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আলু খাদ্যশস্যের অন্তর্ভুক্ত। পেঁয়াজ মসলাজাতীয় ফসল। এগুলো সবজিরও অন্তর্ভুক্ত। চাহিদার তুলনায় কম উৎপাদন, আমদানির অনিশ্চয়তা, অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি ও বাজারে সরবরাহ সংকটের কারণে এ দুটো পণ্যের দাম অনেক সময় হয়ে পড়ে আকাশচুম্বী। খুচরা মূল্যের সঙ্গে যৌক্তিক মূল্যের ব্যবধান হয় অনেক বেশি।
পণ্যমূল্যের অস্থির অবস্থায় কৃষক ও ভোক্তাদের পথনির্দেশ করতে পারে পণ্যের উৎপাদন খরচ ও সরকার নির্ধারিত যৌক্তিক মূল্য। উৎপাদন খরচের সঙ্গে কৃষকের লাভ, মধ্যবর্তী বাজারজাতকরণ খরচ ও মুনাফা যোগ করে বাজারজাতকরণের বিভিন্ন ধাপে নির্ধারণ করা হয় পণ্যের যৌক্তিক মূল্য। আমদানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে আমদানি মূল্যের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাজারজাতকরণ খরচ ও মুনাফা যোগ করা হয়। বাজারে পণ্য সরবরাহ কম হলে যৌক্তিক মূল্যের চেয়ে খুচরা মূল্য বেশি হয়। আবার উৎপাদন মৌসুমে পণ্য সরবরাহ বেড়ে গেলে যৌক্তিক মূল্যের চেয়েও কমে যায় খুচরা মূল্য। পণ্যের নিষ্ফল মৌসুমে যখন বাজারে দাম চড়া থাকে তখন যৌক্তিক মূল্যের কথা অনেকে বলে থাকেন; কিন্তু যখন বাজারে দাম কম থাকে তখন যৌক্তিক মূল্যের কথা বলতে তেমন শোনা যায় না। বর্তমানে বাজারে সবজির দাম খুবই নেমে গেছে। ক্ষেত্র বিশেষে তা যৌক্তিক মূল্যের অনেক কম। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষক। উদাহরণ স্বরূপ ফুলকপি ও বাঁধাকপির প্রতি কেজি উৎপাদন খরচ এবার কমবেশি ১০ টাকা। এর সঙ্গে ন্যূনতম বিশ শতাংশ মুনাফা যোগ করে খামার প্রান্তে এর যৌক্তিক মূল্য হওয়া উচিত অন্তত ১২ টাকা কেজি; কিন্তু গ্রামের কৃষক এখন ৫ টাকাও পাচ্ছেন না। ফেসবুক পেজ “কৃষকের কৃষি ভুবণে” (গ্রুপ সদস্য সংখ্যা ১৮১৫ হাজার) পোস্ট করা এক মন্তব্যে কৃষক মো. সাকিল খান লিখেছেন, “২০২৫ সাল ইতিহাস হয়ে থাকবে কৃষকের লোকসানের বছর হিসেবে। পেঁয়াজ, আলু, বেগুন, ফুলকপিসহ সব ধরনের পণ্য বিপণনে কৃষকদের মাথায় হাত।” কোনো কোনো ক্ষেত্রে মূল্য ধসে বিক্ষুব্ধ হয়ে ক্ষেতের মুলা/কপি সেনি-দা দিয়ে কুপিয়ে কেটে ক্ষেতেই মিশিয়ে দিতে দেখা যাচ্ছে গ্রামের কৃষকদের। শুধু বাংলাদেশে নয়, উৎপাদন মৌসুমে ফসলের মূল্য হ্রাস পায় পৃথিবীর অনেক দেশেই; কিন্তু বাংলাদেশের মতো এতবেশি তলানিতে নামে না কোথাও। এত তীব্র অনুভূত হয় না কৃষকের বিলাপ।
ফেজবুক পেজ “কৃষকের প্রাণ কৃষি পরিবার” থেকে প্রাপ্ত এক স্টেটাসে কৃষক হেদায়েতুল ইসলাম গত ২০ জানুয়ারি লিখেছেন “এখন নিজের প্রয়োজনে যতটুকু দরকার ঠিক ততটুকু চাষ করব। আর বাণিজ্যিক চাষ করব না। আসুন ভায়েরা ঐক্যবদ্ধ হই”। এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অনেকেই অর্থনীতি সাশ্রয়ের কবওয়েব খিওরি পড়েছেন। পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলে পরবর্তী মৌসুমে উৎপাদন বেড়ে যায়। অতঃপর দাম কমে যায়। পরের মৌসুমে উৎপাদন হ্রাস পায়।
বাংলাদেশের চাষকৃত সবজির সংখ্যা প্রায় ৯৫। প্রধান সবজির সংখ্যা ৩০-৩৫টি। মোট উৎপাদন এলাকা কৃষি বিভাগের তথ্য অনুসারে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ১.১৬ মিলিয়ন হেক্টর। তাতে বছরে উৎপাদন হয় ২৪.১৭ মিলিয়ন টন সবজি। জনপ্রতি দৈনিক সবজি প্রাপ্তির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৮৯ গ্রাম। তবে বিবিএস প্রদত্ত তথ্য অনুসারে জনপ্রতি দৈনিক সবজি গ্রহণের পরিমাণ ২০২ গ্রাম (এইচআইইএস ২০২২)। এই দুই উৎসের পরিসংখ্যানের মধ্যে বিস্তর ফাঁরাক।
একসময় শীতকালীন মৌসুমেই সবজির উৎপাদন হতো বেশি। গ্রীষ্মকালে এর আবাদ ছিল কম। এখন দুটো মৌসুমেই বেড়েছে সবজির আবাদ। গ্রীষ্মকালীন টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, পেঁয়াজ সম্পর্কে আমাদের দেশে ৩০ বছর আগেও তেমন বেশি ধারণা ছিল না। এখন তা বাস্তবে সম্ভব হচ্ছে। এটি কৃষি গবেষণার অবদান। শীতকালে এখন মোট উৎপাদনের প্রায় ৬০ শতাংশ সবজির উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। বাকি ৪০ শতাংশ সবজির উৎপাদন হচ্ছে গ্রীষ্মকালে। শীতকালীন সবজিগুলোর মধ্যে ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, গাজর, লেটুস, পালংশাক, ব্রকলি, শালগম, টমেটো, মুলা, লাউ, বেগুন ও শিম অন্যতম। গ্রীষ্মকালীন সবজির মধ্যে আছে ঢ্যাঁড়শ, পটোল, মিষ্টি কুমড়া, কাকরোল, চিচিঙ্গা, ঝিঙা, ডাঁটা, লালশাক, পুঁইশাক, করলা, শসা ইত্যাদি। কিছু সবজি উভয় মৌসুমেই জন্মে অর্থাৎ সারা বছরই উৎপাদিত হয়। এগুলোর মধ্যে আছে বেগুন, কচু, পেঁপে, কাঁচকলা, শজিনা ইত্যাদি। বাংলাদেশ বর্তমানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সবজি রপ্তানি করছে বিদেশে। বছরের পর বছর এর পরিমাণ ও আয় বাড়ছে। ১৯৯৩-৯৪ সালে সবজি রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৪২২ টন। আয় হয়েছিল ৯.৪৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর ১৫ বছর পর ২০০৮-০৯ সালে সবজি রপ্তানি হয়েছে ২২ হাজার ৭৯১ টন। আয় হয়েছে ৪৪.৬৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি করা হয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার ৫৪৫ টন সবজি। তাতে আয় হয়েছে প্রায় ১১৮.৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ কিছুটা কমে আয় হয়েছে ১১২.৪৭ মিলিয়ন ডলার।
পৃথিবীর ৩৫টি দেশে বর্তমানে বাংলাদেশের ফল ও সবজি রপ্তানি হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশগুলো হলো যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, ইতালি ও অন্য ২৮টি দেশ। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় শাকসবজির উৎপাদন ব্যয়বহুল। সে তুলনায় বাংলাদেশ থেকে সবজির আমদানি সুবিধাজনক। এক্ষেত্রে বিদেশি বাজারে বাংলাদেশি সবজি রপ্তানি সম্প্রসারণের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। তবে এর জন্য বিদেশি বাজার-চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে মানসম্মত সবজির নিরন্তর সরবরাহ নিশ্চিত করা দরকার। সে লক্ষ্যে দরকার ভালোমানের সবজি উৎপাদন। চাই সংগ্রহোত্তর যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ। এছাড়া বিদেশে সবজি পরিবহনের জন্য পর্যাপ্ত বিমান ও কার্গো স্পেস নিশ্চিতকরণের সঙ্গে এর ভাড়া হ্রাস করাও সবজি রপ্তানি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। সর্বোপরি যা প্রয়োজন, সেটি হলো বিদেশে বাংলাদেশি সবজির বাজার সম্প্রসারণের জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা। সম্প্রতি বাংলাদেশে অর্গানিক সবজি আবাদ হচ্ছে। বিদেশে এগুলোর বেশ কদর আছে। দেশের অভ্যন্তরেও এগুলোর চাহিদা আছে বেশ। অতি সম্প্রতি ঢাকায় নিরাপদ সবজি বাজারজাতকরণের জন্য ফারমার্স মার্কেট চালু করা হয়েছে। তাতে অর্গানিক সবজির চাহিদা বাড়ছে। বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি মিশনগুলো এর বাজারজাতকরণে ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। এ লক্ষ্যে বিদেশি বাজার ও পণ্যমূল্য সম্পর্কে আমাদের রপ্তানিকারকদের নিয়মিত অবহিত রাখা প্রয়োজন।
খাদ্য হিসেবে সবজির জনপ্রিয়তা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর কারণ সবজির পুষ্টিমান সম্পর্কে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ বিদ্যমান। সবজিতে আছে ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’। আছে প্রোটিন। আছে ক্যালসিয়াম ও লৌহ। সবজি বিভিন্ন অনুপুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ। এটি চোখে দেখা যায় না; কিন্তু শরীরের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। এর অভাবে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। দৈহিক বৃদ্ধি হয় ব্যাহত। ভিটামিন ‘এ’-র অভাবে রাতকানা, আয়োডিনের অভাবে গলগণ্ড এবং আয়রনের অভাবে রক্তশূন্যতা ইত্যাদির প্রতিকার হচ্ছে খাবার হিসেবে সবজি গ্রহণ। তাছাড়া সবজি আমিষজাতীয় খাদ্যের আত্তীকরণে সহায়ক। এটি পাচনতন্ত্রের কার্যকারিতাও বৃদ্ধি করে। সবজিতে চর্বি ও শর্করার হার কম থাকায় শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে তা অত্যন্ত সহায়ক। এতে কোলেস্টেরল তেমন না থাকায় হৃদরোগ বা উচ্চ রক্তচাপজনিত শারীরিক সমস্যার ঝুঁকি কম থাকে। তাছাড়া সবজি পাচনতন্ত্রের কার্যকারিতাও বৃদ্ধি করে। সবজিতে কিছু ফাইটোকেমিক্যাল বিদ্যমান থাকায় টিউমারসহ অন্যান্য রোগ প্রতিরোধে তা অত্যন্ত সহায়ক।
অপুষ্টির সমস্যা সমাধানে সবজি গ্রহণ খুবই কার্যকর। এর জন্য চাই নিরাপদ সবজি। উৎপাদন ব্যবস্থায় বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার সীমিত মাত্রার মধ্যে রাখতে হবে। সবজির জৈব চাষকে উৎসাহিত করতে হবে। সবজির ফুডভ্যালু চেইনকে সংক্রামক জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে। সবজি ধোয়ার ক্ষেত্রে দূষিত পানির ব্যবহার পরিহার করতে হবে। কোল্ডস্টোরেজ এবং ‘শীতল চেইন পরিবহনের সুবিধা’ বৃদ্ধি করে উৎপাদনকারী থেকে ভোক্তা পর্যন্ত নিরাপদ সবজি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকল্পে সবজির প্রাক-উৎপাদন, উৎপাদনকাল এবং ফসল কর্তনোত্তর প্রক্রিয়াজাতকরণে উত্তম কৃষি কার্যক্রম (গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিসেস, জিএপি) অনুশীলন করতে হবে। ভোক্তাদের জন্য মানসম্পন্ন সবজি সরবরাহ করতে উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের পরিবেশ উন্নত করতে হবে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শাকসবজির চুক্তিভিত্তিক চাষ হচ্ছে। অনেক শিক্ষিত তরুণ এগিয়ে এসেছে সবজি চাষে। তারা উপযুক্ত মূল্যে বিক্রি করছে উৎপাদিত সবজি। এগুলো দেশের বড় বড় সুপার মার্কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিক্রির জন্য। বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়াকে নীতি ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে উৎসাহিত করতে হবে। তাতে মানসম্মত সবজির উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। রপ্তানি আয় বাড়বে। দেশের ভোক্তারাও ন্যায়সংগত মূল্যে সবজি ক্রয় করতে পারবে। তাতে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতসহ উপাদেয় সবজি গ্রহণ সম্ভব হবে। দূর হবে আমাদের পুষ্টি সমস্যা।
ড. জাহাঙ্গীর আলম: কৃষি অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও শিক্ষাবিদ। সাবেক উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ। সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে