জলাধার রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর তাগিদ: বাস্তবায়ন করবেন কে?
দেশের জলাধারগুলোকে রক্ষার তাগিদ দিয়ে প্রকৌশলীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেদিন (১১ মে, শনিবার) বললেন যে, ‘প্রয়োজনে জলাধার সংরক্ষিত রেখে এবং নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর এলাকায় পানির প্রবাহ ধরে রেখে স্থাপনা নির্মাণ করতে হবে; বৃষ্টির পানি ধরে রেখে তা কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা নিতে হবে’- সেদিনই বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মনির হোসেন গাজীপুর সদর রাজস্ব সার্কেলের সিকুলিয়া মৌজার উদুর খালের একটি ভিডিও ফেসবুকে শেয়ার করেছেন; যেখানে দেখা যাচ্ছে, খালের মধ্যেই গোল্ডক্রেস্ট হোল্ডিং লিমিটেডের সাইনবোর্ড। এখানে একটি ইকো ভিলেজ বানানোর প্রক্রিয়া চলছে।
গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি জাতীয় দৈনিকের খবরে বলা হয়, চোখের সামনেই গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার লতিফপুর গ্রামের শীতলক্ষ্যা নদীর তীর দখল করে চলছে বালু ভরাটের কাজ। এরই মধ্যে পাঁচ বিঘা জায়গা ভরাট হয়ে গেছে। এসব জমি একটি বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করা হতে পারে। এসব কাজ দিনের চেয়ে রাতেই বেশি হয় (আজকের পত্রিকা, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)। বছরের পর বছর ধরে দেশের নদী, খাল, পুকুর, জলাশয় ও প্লাবনভূমি দখল করে, ভরাট করে কল-কারখানা, আবাসিক ভবন, হোটেল-মোটেল, ইকোপার্ক, ইকো ভিলেজ ইত্যাদি তৈরি করা হচ্ছে।
যেখানেই এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায়, সেখানেই অভিযুক্ত দখলদাররা দাবি করেন, এই জমির মালিকানা তাদের অথবা তারা ভরাট হওয়ার পরে কিনেছেন; কিন্তু নদী খাল ও প্রাকৃতিক জলাশয়ের মালিকানা কোন ব্যক্তি কীভাবে দাবি করেন এবং স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের চোখের সামনে কীভাবে এসব প্রাকৃতিক জলাধার ও জলরেখা ভরাট ও দখলের পরে সেখানে স্থাপনা গড়ে তোলা হয়, সেটি বিরাট প্রশ্ন। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪৩(১) অনুচ্ছেদ বলছে, বাংলাদেশের যে কোনো ভূমির অন্তঃস্থ সব খনিজ ও অন্যান্য মূল্যসম্পন্ন সামগ্রী; বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জলসীমার অন্তর্বর্তী মহাসাগরের অন্তঃস্থ কিংবা বাংলাদেশের মহীসোপানের উপরিস্থ মহাসাগরের অন্তঃস্থ সব ভূমি, খনিজ ও অন্যান্য মূল্যসম্পন্ন সামগ্রী এবং বাংলাদেশে অবস্থিত প্রকৃত মালিকবিহীন যে কোনো সম্পত্তির মালিক প্রজাতন্ত্র বা রাষ্ট্র।
১৮ (ক) অনুচ্ছেদ বলছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন। অর্থাৎ এখানে রাষ্ট্রকেও দায়িত্বশীল করা হয়েছে যে, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করবে। আর ৭(১) অনুচ্ছেদ বলছে, প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ। ক্ষমতার মালিক জনগণ মানে হলো রাষ্ট্রের সব সম্পদের পাহারা দেয়ার মালিকও তারা; কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, সেই জনগণেরই একটি অংশ যখন খাল, নদী, জলাশয়, পুকুর ভরাট করে; দখল করে; দূষণে বিপন্ন করে- তখন সংবিধান প্রদত্ত এই মালিকানাটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তখন এটি প্রমাণিত হয় যে, সংবিধান যাদের রাষ্ট্রের সব ক্ষমতার মালিক বলে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেই জনগণ আসলে ক্ষমতা গ্রহণে রাজি নয় কিংবা তারা এই মালিকানা চায় না বরং সে দেশের সম্পদ নিজের মালিকানায় নিতে চায়।
বস্তুত বাংলাদেশের প্রাকৃতিক জলাধার, নদী ও প্রাণ-প্রকৃতি বিপন্ন হওয়ার আরেকটি প্রধান কারণ প্রকল্প ও অবকাঠামোভিত্তিক উন্নয়নচিন্তা ও দর্শন। অর্থাৎ শুরু থেকেই নদী ও প্রাণ-প্রকৃতিবিরোধী একটি উন্নয়ননীতি ও দর্শন আমাদের নীতিনির্ধারকদের মগজে গেঁথে গেছে যে, উন্নয়ন মানেই প্রকল্প। উন্নয়নের যে সংজ্ঞা বছরের পর বছর ধরে জনপরিসর তথা নাগরিকের মানসকাঠামোয় গেঁথে দেওয়া হয়েছে, তা হচ্ছে কংক্রিট। যেমন, রাস্তা বানাও, সেতু ও কালভার্ট বানাও। এক স্থান থেকে আরেক স্থানে দ্রুত যাও। মানুষও দ্রুত যেতে চায়। নৌপথে দ্রুত যাওয়া যায় না। ফলে রাস্তা বানাও। রাস্তা বানানো মন্দ কিছু নয়; কিন্তু সেই রাস্তা, সেতু ও কালভার্ট বানাতে গিয়ে কত শত নদী, খাল ও জলাশয় ভরাট করা হলো- সেই পরিসংখ্যান কি রাষ্ট্রের কাছে রয়েছে?
সড়ক যোগাযোগ উন্নত করার নামে যে হাজার হাজার বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে, তার ফলে কত শত ছোট ছোট নদী ও খাল বিপন্ন হয়েছে; কত নৌপথ চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে; কত শত খাল ও নদীতে মাছের প্রজনন ধ্বংস করা হয়েছে, সেই হিসাব করার সময় কি আসেনি? নদী তীরে কল-কারখানা গড়ে তুলে সেই কল-কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলে নদীতে বিপন্ন করা হলো। নদীকে হত্যা করা হলো, যার বড় উদাহরণ রাজধানীর পাশের তুরাগ ও বুড়িগঙ্গা; কিন্তু এসব কারখানায় কর্মসংস্থান এবং জাতীয় অর্থনীতিতে তাদের অবদানের বিপরীতে নদী বিপন্ন করার অর্থনৈতিক মূল্য কত, সে হিসাব কি রাষ্ট্রের কাছে আছে?
এরকম বাস্তবতায় দেশের জলাধার রক্ষায় প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশনা দিয়েছেন, সেটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়; কিন্তু মুশকিল হলো, মাঠ পর্যায়ে এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে কতটুকু সেটি বিরাট প্রশ্ন। কেননা, গত বছরের অক্টোবর মাসেও তিনি এই নির্দেশনা দিয়ে বলেছিলেন, ‘উন্নয়ন প্রকল্প যাতে নদী, খাল ও জলাশয়ের অবাধ প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। নদীগুলোর নিরবচ্ছিন্ন পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। সে কথা মাথায় রেখেই আমাদের প্রকল্প ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে। যখনই কোনো প্রকল্প গ্রহণ বা বাস্তবায়িত হয়, তখনই পানি সম্পদ সংরক্ষণে সবাইকে পদক্ষেপ নিতে হবে।’ (ইউএনবি, ১৬ অক্টোবর ২০২৩)।
দেশের নদী, খাল, পুকুর ও প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবেদনশীলতা সর্বজনবিদিত; কিন্তু তার নির্দেশনা মাঠ পর্যয়ে কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে; মাঠ প্রশাসন এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা দেশের নদী-খাল-জলাশয় সুরক্ষায় কতটুকু ভূমিকা রাখছেন, তা নিয়ে প্রশ্নের অন্ত নেই। কেননা প্রাকৃতিক জলাধার তথা নদী খাল ভরাট করে অবকাঠামো নির্মাণের চিত্র কমবেশি সারা দেশেই। অন্তত বড় শহরগুলোয় এই চিত্র ভয়াবহ। রাজধানীর অতি নিকটবর্তী কেরানীগঞ্জে আগামী ১০ বছর পরে কোনো প্রাকৃতিক জলাধার ও খালের অস্তিত্ব থাকবে কি না, সেটি নিয়ে স্থানীয়রাই শঙ্কিত। অসংখ্য আবাসন কোম্পানি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কারণে একসময়ের কৃষিনির্ভর কেরানীগঞ্জে আগামী এক দশক পরে কোনো ফসলি জমি খুঁজে পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ আছে।
অথচ মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সব পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০-এ প্রাকৃতিক জলাধার সুরক্ষার কথা স্পষ্ট উল্লেখ আছে। আইনে ‘প্রাকৃতিক জলাধার’ অর্থে লেখা হয়েছে নদী, খাল, বিল, দীঘি, ঝরনা বা জলাশয় হিসেবে মাস্টার প্লানে চিহ্নিত বা সরকার, স্থানীয় সরকার বা কোনো সংস্থা কর্তৃক, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, বন্যা প্রবাহ এলাকা হিসেবে ঘোষিত কোনো জায়গা এবং সলল পানি এবং বৃষ্টির পানি ধারণ করে এমন কোনো ভূমিও এর অন্তর্ভুক্ত হবে। এই আইনের বিধান অনুযায়ী ব্যতীত প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন করে ভাড়া, ইজারা বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করাও নিষিদ্ধ।
শুধু তাই নয়, কোনো উদ্যানের গাছপালা কেটে তার মৌলিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট করা যাবে না বলেও আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। আর কোনো ব্যক্তি এই আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে তিনি অনধিক ৫ বছরের কারাদণ্ডে বা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এ ছাড়া এই আইনের বিধান লঙ্ঘন করে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা হলে আদালতের আদেশে সেটি বাজেয়াপ্ত হবে। প্রশ্ন হলো, এখন পর্যন্ত প্রাকৃতিক জলাধার, নদী ও খাল ভরাট করে কিংবা জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে গড়ে তোলা কতগুলো অবকাঠামো বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে বা ভেঙে দেয়া হয়েছে? নদী খাল প্রাকৃতিক জলাশয় ভরাট করায় কতজনের কারাদণ্ড হয়েছে?
নদী খাল প্রাকৃতিক জলাশয় দখল ও ভরাট করার এই প্রক্রিয়ায় স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ও টাকাওয়ালাই জড়িত থাকেন এবং স্থানীয় প্রশাসনের ওপর চাপ প্রয়োগ করে কিংবা তাদের ঘুষ দিয়ে জলাধারকে জমিতে পরিণত করা হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত একটি নদী খাল ও জলাধার নিতান্তই জলধারা, ততক্ষণ পর্যন্ত এর কোনো বিক্রয়মূল্য নেই; কিন্তু যখনই একে বালু দিয়ে ভরাট করা গেলো, তখনই এর মূল্য শতাংশ হিসেবে। রাজধানীর আশপাশে এবং বড় শহরের মধ্যে হলে দশ শতাংশ জায়গার দাম কোটি টাকা। এর সঙ্গে আছে বালুর ব্যবসা। অর্থাৎ একদিনে কোটি টাকার বালুর ব্যবসা, অন্যদিকে সেই বালু দিয়ে জলাশয় ভরাট করে জলকে জমিতে পরিণত করার মোটা অঙ্কের ব্যবসা। মানে নগদ টাকা। যেখানে নগদ টাকা, সেখানে নীতির কথা বলে খুব একটা সুবিধা করা যায় না। প্রয়োজন আইনের কঠোর প্রয়োগ। দলমত ও পরিচয় নির্বিশেষে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি; কিন্তু যারা আইনের প্রয়োগ করবেন, তারাই যদি ওই টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যান, তারা যদি ক্ষমতার কাছে মেরুদণ্ড বাঁকা করে দেন, তাহলে দেশের নদী-খাল জলাধার রক্ষার সাধ্য কারও নেই।
মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের ভূমির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিন ভাগের দুই ভাগ প্লাবনভূমি (নদী, জলাভূমি, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় প্রভৃতি)। দেশের ৬৭ শতাংশ জমি বর্ষায় প্লাবনভূমিতে রূপান্তর হয়, আবার শুষ্ক মৌসুমে এ ভূমিতেই দেশের ফসল আবাদ হয়; কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে নিচু জমি ভরাট করে তৈরি হচ্ছে আবাসন, কল-কারখানা এমনকি সাম্প্রতিক বছরগুলোয় গ্রামাঞ্চলে কৃষি ফার্ম গড়ে তোলার নামেও প্রচুর ফসলি জমি ও জলাশয় ভরাট করে আলিশান ভবন বানানো হচ্ছে। বস্তুত এগুলো রিসোর্ট। রিসোর্টের মালিক মাঝেমধ্যে এখানে অবকাশ যাপন করেন। কেউ কেউ ভাড়াও দেন; কিন্তু এই বিরাট অবকাঠামো গড়ে তুলতে গিয়ে তিনি কী পরিমাণ কৃষিজমি ও জলাশয় ভরাট করলেন, সেই হিসাবটিও এখন করার সময় এসেছে। বাংলাদেশের মতো স্বল্প আয়তনের এবং জনঘনত্বপূর্ণ একটি দেশে এই ধরনের বিলাসিতার সুযোগ থাকা উচিত কি না, তা নিয়েও ভাববার সময় হয়েছে।
লেখক: সম্পাদক, কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, নেক্সাস টেলিভিশন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে