নববর্ষ উৎসব বাঙালির সরলরেখার ঐকতান
নববর্ষের শুরুতে সবাই কেবল মঙ্গল শুভেচ্ছাই প্রকাশ করে। আমি কিন্তু শুভেচ্ছার পাশাপাশি ঘৃণার কথা বলি। ঘৃণা, ঘৃণা, ঘৃণা! রুদ্র, প্রচণ্ড, প্রকট, প্রচুর, পবিত্র ঘৃণা! হ্যাঁ, বর্ষ শুরুতে অন্যের মতো আমিও শুভেচ্ছা জানাই বটে। তবে পাত্র-অপাত্র-নির্বিশেষে সবাইকে শুভেচ্ছা জানাতে রাজি নই। বন্ধুর জন্য আমি শুভেচ্ছার ডালি উজাড় করে দিই; কিন্তু শত্রুর জন্য শুভেচ্ছা নয়, তাকে কেবলই ঘৃণা। ঘৃণা জানাই তাদের যারা নববর্ষের মতো ধর্মনিরপেক্ষ ও অরাজনৈতিক উৎসবকে বিভিন্ন রং মাখিয়ে বিতর্ক তৈরি করে নিজেদের সুবিধা হাসিল করে। তাই নববর্ষের দিনেও এদের যদি আমরা ক্ষমা করে দিই, তবে সে ক্ষমাকে তারা আমাদের দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ বলেই ধরে নেবে এবং শত্রুতা সাধনে আরও প্রচণ্ড হিংস্র হয়ে উঠবে।
আবহমানকাল ধরেই বাংলার লোকসমাজ ‘নববর্ষ’ উদযাপন করে এসেছে। লোকসমাজের সেই উদযাপনে একটুও কৃত্রিমতা ছিল না। লৌকিক ধর্মনিরপেক্ষ রীতিতে চিরায়ত ঐতিহ্যের ধারাবাহিক অনুবর্তিতাতেই উদযাপিত হতো বাংলা ও বাঙালির নববর্ষ; কিন্তু ‘পাকিস্তান’ নামক কৃত্রিম রাষ্ট্রটির চাঁইয়েরা বাঙালির এই ঐতিহ্যানুসারিতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলল।
তারা নববর্ষের মতো সব ধর্মনিরপেক্ষ লৌকিক ঐতিহ্যমণ্ডিত উৎসবের মধ্যেই হিন্দুয়ানির ভূত দেখতে পেলেন। নববর্ষ ও ঋতুবরণমূলক উৎসবকে তারা চিহ্নিত করল প্রকৃতি পূজা বলে। এ-রকম উৎসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকেই তারা প্রকৃতি-পূজক তথা ইসলামবিরোধী তথা ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানের শত্রু বলে অভিযুক্ত করল। এর ফলে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেল গ্রামীণ লোকসমাজও। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে গ্রামেও নববর্ষ উৎসবের তাল কেটে যায়। গ্রামীণ মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যেও পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক ভাবধারার প্রভাবে নববর্ষ উৎসবের প্রতি বিমুখতা দেখা দেয়। অন্যদিকে শহুরে এলিটরা তো দীর্ঘদিন ধরেই লৌকিক ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন, নববর্ষ উৎসব উদযাপনের রীতিনীতি বা ভাবনাধারার সব পরিচয় চিহ্নই তাদের মনোভূমি থেকে অপগত।
এ অবস্থাতেই শহুরে এলিটদের যে অংশটির চিত্তে পাকিস্তানি ভাবধারার প্রতি বিরোধিতা ও বাঙালিত্বের প্রতি আকর্ষণ দেখা দেয়, সে অংশটির মধ্যেও একধরনের শূন্যতা অত্যন্ত প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এরা স্বভাবতই নববর্ষের মতো উৎসব সম্পর্কে পাকিস্তানপন্থিদের বক্তব্য মেনে নিতে পারেন না; কিন্তু লৌকিক ঐতিহ্য ও জীবনচেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন বলে নববর্ষ উৎসবটি কী পদ্ধতিতে উদযাপন করে পাকিস্তানপন্থি প্রচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো যায়, তা-ও বুঝে উঠতে পারেন না। তাই পাক জমানার গোড়ার দিকে (অর্থাৎ বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে) শহুরে এলিটদের বাংলা নববর্ষ উদযাপনের মধ্যে প্রতিবাদী চেতনার প্রকাশ ঘটে; কিন্তু তাদের উদযাপিত উৎসবের মধ্যে প্রাণের ছোঁয়া তেমন একটা পাওয়া যায় না, সে উৎসব বাঙালিত্বের মর্মবাণীর ধারক হয়ে ওঠে না।
তবু এ অবস্থাতেই, বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে শহর-নগরের সচেতন শিক্ষিত বাঙালিদের মধ্যে বাঙালিত্বের বোধ অত্যন্ত তীব্র হয়ে ওঠে। সেই বোধ থেকেই তাদের ভেতর রবীন্দ্রপ্রীতির নতুনতর উৎসারণ ঘটে, নজরুলের খণ্ডায়নরোধের তাগিদ দেখা দেয়। এককথায়, বাঙালিত্বের প্রকৃত রূপের প্রতিষ্ঠাদানের লক্ষ্যেই তাদের বোধ পুষ্ট হয়ে ওঠে। দেশজুড়ে বাঙালিত্বের চেতনার ধারক অনেক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে উঠতে থাকে। এসব সংগঠনের মধ্যে একান্ত উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য নিয়ে দেখা দেয় তদানীন্তন প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকার ‘ছায়ানট’।
ছায়ানট একটি অসাধারণ ও অবিস্মরণীয় কাজ করেছিল। রমনার বটমূলে যে বছর ছায়ানটের উদ্যোগে নববর্ষ উদযাপনের প্রবর্তন ঘটে, সে বছর থেকেই বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে একটি নবধারা সূচিত হয়ে যায়। এর দৃষ্টান্তে উদ্বুদ্ধ হয় বাংলাদেশের পুরো বাঙালি সমাজ; সারা দেশের প্রতিটি শহরে-বন্দরে উদযাপিত হতে থাকে বাংলা নববর্ষ উৎসব; এবং সেক্ষেত্রে সর্বত্র ছায়ানটেরই অনুকরণ ও অনুসরণ চলে। এই উৎসবে ধর্মতান্ত্রিকতার কোনো ছায়াপাত নেই, সব প্রকার ধর্মতন্ত্রী সাম্প্রদায়িক রীতিনীতির স্পর্শ থেকে মুক্ত এই উৎসব, ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালিত্বের বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে সবাই এই উৎসবে এসে মিলিত হয়। এ উৎসবের সূচনামন্ত্র কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ’, পুরাতনের হৃদয় টুটে নতুনকে ফুটিয়ে তোলার আর্তিই ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে এ উৎসবে গানে-কবিতায়-নৃত্যে।
বিশ শতকের মধ্যপর্বে বাংলা অঞ্চলের যে ভূখণ্ডটি ‘পাকিস্তান’ নামক এক মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রের শাসনাধীন হয়ে পড়ে, সে ভূখণ্ডের সচেতন শিক্ষিতজনের পক্ষেও কিন্তু পূর্বসূরিদের পন্থানুসরণ করা সম্ভব হয় না। সামান্যতম রবীন্দ্রানুরাগ প্রকাশ করলেও কর্তৃপক্ষীয় ধমক খেতে হয় তাদের।
এ রকম এক বিরূপ ও শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে ছায়ানট যখন রমনার বটমূলে রবীন্দ্র প্রবর্তিত রীতির অনুসরণে নববর্ষ উৎসব উদযাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করে, তখন শত্রুর প্রতিরোধের মোকাবিলা করার কথা মাথায় রেখেই তাকে তা করতে হয়। অর্থাৎ ছায়ানটের মতো সুকুমার কলার অনুশীলনকারী সংগঠনটিও তার সুকোমল ও নিরীহ রূপ বজায় রাখতে পারে না, তাকেও সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। তবে, তাকে একা একা সংগ্রামে নামতে হয় না। ছায়ানটের সঙ্গে কোনো রকম সম্পর্ক ছিল না যাদের, বাঙালিত্বের চেতনায় উদ্বুদ্ধ এ রকম সব শিক্ষিত সচেতন নগরবাসীও ছায়ানটের নববর্ষ উৎসব উদযাপনে হন সকর্মক সহযোগী। এর ফলে উৎসবটিতে যুক্ত হয় প্রতিবাদের প্রতিরোধের নবতর মাত্রা। সেই প্রতিবাদ প্রতিরোধই বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে এক মোহনায় এসে মিলিত হয়ে যায়। স্বাধীন রাষ্ট্র রূপে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর নববর্ষ উৎসব আরও অধিকতর উৎসাহের সঙ্গে উদযাপিত হতে থাকে। নববর্ষ আর স্বাধীনতার মূল্যবোধ যেন একাকার হয়ে যায়।
এ রকম একাকার হয়ে যাওয়াটাই অসহ্য ঠেকে স্বাধীনতার দুশমনদের। পাকিস্তানবাদের উত্তরাধিকার যারা এটি স্বাধীন বাংলাদেশেও বহন করছে, তাদের আসল লক্ষ্য এ দেশে পাকিস্তানায়ন ঘটানো। সেই লক্ষ্যেই তারা ইতোমধ্যে অনেকদূর এগিয়ে গেছে, পাকিস্তানের মতোই এ দেশটিকে ধর্মতন্ত্রী রাষ্ট্রে পরিণত করতে তারা তৎপর হয়ে উঠেছে।
কিন্তু তাদের সেই তৎপরতা তথা অপতৎপরতা প্রচণ্ড মার খাচ্ছে ঐ নববর্ষ উৎসবের কাছেই। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখেই নববর্ষ উৎসবের সমারোহের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষ ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি তাদের নির্দ্বিধ প্রত্যয়ের কথা ঘোষণা করে। তারা জানিয়ে দেয় যে, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানের মতো বিবিধ ধর্মীয় সম্প্রদায়ে অন্তর্ভুক্ত থেকেও জাতি হিসেবে তারা এক ও অভিন্ন। ধর্মগত সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের চেয়ে ভাষাগত ও কৃষ্টিগত জাতি পরিচয়টাই তাদের কাছে অনেক বড়। সেই জাতি-পরিচয়ের গৌরবই তাদের ধর্মনিরপেক্ষ নববর্ষ উৎসবে প্রতি বছর ঘোষিত এবং দেশটিকে পাকিস্তানের মতো সাম্প্রদায়িক ধর্মতন্ত্রী রাষ্ট্র বানানোর সব অপপ্রয়াস প্রত্যাখ্যাত। ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’- এই প্রত্যয় তাদের চিত্তমূলে একান্ত সুদৃঢ় রূপেই প্রতিষ্ঠিত।
এই সুদৃঢ় প্রত্যয় গণচিত্ত থেকে উৎপাটন করে ফেলার জন্য পাকিস্তানবাদের ধারক-বাহক বাংলাদেশি নামীয়রা নানা কৌশলেরই সন্ধান করছে। সে সব কৌশলের মধ্যে যেমন আছে ধর্মতন্ত্রের মৌলবাদী ভাষ্যের অবিরাম প্রচার চালিয়ে মানুষের মস্তিষ্ককোষ ধর্মান্ধতার মৌতাতে আচ্ছন্ন করে ফেলার অপচেষ্টা, তেমনই আছে লোভের জাল বিছিয়ে তাতে মানুষকে আটকে রাখা এবং ভয়ের নির্মম প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে জনগণকে ধর্মনিরপেক্ষতার পথ থেকে ফিরিয়ে আনা। এই ভয়ের প্রদর্শনী তারা ‘উদীচী’র মতো অসাম্প্রদায়িক সংগঠনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী রাজনৈতিক দলের সমাবেশে যেমন ঘটিয়েছে, তেমনই ঘটিয়েছে ছায়ানটের নববর্ষের অনুষ্ঠানে। ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমা ফেলাটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ওই ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদীরা মনে করেছিল যে, একবার যদি রমনার বটমূলের নববর্ষের অনুষ্ঠান পণ্ড করে দেয়া যায় তাহলে আর কোনো বছরেই মানুষ সে অনুষ্ঠানের ধারেকাছে যাবে না, সবাই ভয়ে জবুথবু হয়ে ঘরের কোণে বসে থাকবে। এভাবেই সবাই ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব পালন করা থেকে নিজেদের নিবৃত্ত করবে এবং দেশে ধর্মনিরপেক্ষ ভাবনারও সমাপ্তি ঘটবে।
প্রতিবারের নববর্ষ উৎসবে যোগদানকারী মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বহুগুণিত হচ্ছে। শুধু ঢাকায় নয়, দেশের সব শহরে নগরে-বন্দরে। ভয় পাওয়ার বদলে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী মানুষ এভাবেই ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদীদের চিত্তে ভয়ের কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে। আমরা একান্তভাবেই বিশ্বাস করতে পারি যে, বাঙালি নববর্ষ উৎসব পালনের মধ্য দিয়েই জানিয়ে দিয়েছে যে ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদীদের সব কৌশলই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এ দেশের মানুষ প্রকৃত মানুষের ধর্মের অনুসারী, ধর্মকে তারা হৃদয়-কন্দরে একান্ত শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতার সঙ্গে লালন করে। ধর্মকে সাম্প্রদায়িকতার যূপকাষ্ঠে তারা বলি দেয় না। ইহলৌকিক ও আদিভৌতিক রাষ্ট্রনীতির অধীন বানিয়ে ধর্মের পবিত্রতায় ও আধ্যাত্মিকতায় সামান্য কালিমা লেপনেও এ দেশের মানুষ রাজি নয়। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যই তারা পাকিস্তানবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছে। কেউই কোনোমতেই এ দেশে যে পাকিস্তানবাদের পুনঃপ্রত্যাবর্তন ঘটাতে পারবে না, প্রতি বছর ধর্মনিরপেক্ষ রীতিতে নববর্ষ উৎসব পালন করেই এ দেশের মানুষ তা জানিয়ে দেয়।
যতীন সরকার: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে