পুলিশ হেফাজত মানে সুরক্ষা, মৃত্যু নয়
বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ পুলিশকে ভয় পায়, পুলিশের কাছ থেকে দূরে থাকে। অথচ পুলিশের হওয়ার কথা জনগণের বন্ধু। আগে বন্ধুত্বের দুটি উদাহরণের কথা বলি। কদিন আগে এক চোর গিয়েছিল বাজারে এক দোকানে চুরি করতে; কিন্তু চুরির মাল গোছাতে গোছাতে ভোর হয়ে যায়। লোকজন চলে আসে। চারপাশে লোকজনের আওয়াজে চোর ভয় পেয়ে যায়। তার ভয় ছিল, লোকজন যদি দোকানের ভেতরে তাকে পায়, তাহলে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে। চতুর চোর ৯৯৯-এ ফোন করে পুলিশের সহায়তা চায়। পুলিশ এসে দোকানের ভেতর থেকে চোরকে উদ্ধার করে। পরে অবশ্য তাকে গ্রেপ্তারও করা হয়; কিন্তু সময়মতো পুলিশ এসেছে বলেই চোরটি প্রাণে বাঁচতে পেরেছে।
বাজারের লোকজন ধরলে তাকে গণপিটুনিতে মরতে হতো। সিনেমাতেও অনেকসময় দেখি, নায়কের প্রতিশোধ-পরায়ণতা থেকে বাঁচতে ভিলেন পুলিশের কাছে আশ্রয় নেয়। ভিলেনেরও ধারণা, নায়ক তাকে প্রাণে মেরে ফেললেও পুলিশ অন্তত প্রাণে মারবে না, আইনি-প্রক্রিয়ায় বিচার করবে। এবার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। বছর বিশেক আগে একবার আমি সপরিবারে সিলেট অঞ্চলে বেড়াতে যাই। পরিকল্পনা ছিল ফেরার পথে একরাত শ্রীমঙ্গলে থাকব। পরদিন চা বাগান দেখে ঢাকায় ফিরব; কিন্তু সিলেট থেকে রাতে শ্রীমঙ্গলে এসে থাকার মতো ভালো হোটেল খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এক পর্যায়ে রাতেই সিদ্ধান্ত নিই, তারচেয়ে ভালো ঢাকায় চলে যাব।
রাত ৯টার দিকে শ্রীমঙ্গল থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। রাস্তা সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। শহর থেকে বেরোনোর পরই নির্জন সড়ক। দুপাশে চা বাগান-টিলা, ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমাদের গাড়ি ছাড়া রাস্তায় আর কোনো গাড়িই ছিল না। গাড়িতে আমার স্ত্রী ও সন্তান। সবারই মিশ্র অনুভূতি। অসাধারণ সুন্দর সেই সড়ক, অন্যরকম পরিবেশ; কিন্তু সেটা ছিল ভয়ংকর সুন্দর। আমি স্ত্রী ও সন্তানকে অভয় দিচ্ছিলাম, কোনো ভয় নেই। আসলে আমি নিজেই ভয় পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল, এই অবস্থায় ডাকাতের কবলে পড়লে আমাদের খোঁজ পেতে তিন দিন লাগবে। কোনো কারণে গাড়িতে সমস্যা হলেও বিপদে পড়ব। আশপাশে কোনো লোকালয় নেই। গাড়ি চালাতে চালাতে এক পর্যায়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে পৌঁছালাম। তখন আমাদের সবার জানে পানি এলো। একটু পর দেখি হাইওয়েতে পুলিশ চেকপোস্ট। তারা সন্দেহজনক গাড়ি দাঁড় করিয়ে চেক করছে। বিশ্বাস করবেন, পুলিশ দেখে এত ভালো কখনো লাগেনি।
পুলিশের ডিউটি দেখলেও আমার মায়া লাগে। অন্য সবারই নির্ধারিত অফিস টাইম থাকে। পুলিশের টাইমের কোনো বালাই নেই। সারাক্ষণ ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়। যেখান থেকে সবাই পালায় সেখানে যেতে হয় পুলিশকে। করোনার সময় সন্তান যখন মাকে জঙ্গলে ফেলে গেছে, তখন সেই মাকে উদ্ধার করতে ছুটে গেছে পুলিশ। করোনার সময় সবাই যখন ঘরে, তখনো পুলিশ বাইরে ছিল। ঝড়-বৃষ্টি-রোদ সবসময় ট্রাফিক পুলিশ রাস্তায় থাকে। পুলিশের ডিউটির যে ধরন, তাতে তাদের আমার পুরোপুরি মানুষ মনে হয় না। মারামারি, খুনাখুনি, হরতাল, ভাঙচুর- সর্বত্র পুলিশ সবার আগে। সারা দিন অমানুষিক পরিশ্রম করার পর পুলিশের সাধারণ সদস্যরা রাজারবাগ পুলিশলাইনে অমানবিক পরিবেশে রাত কাটায়। পুলিশের চাকরি সবসময় জরুরি। অন্য অনেক পেশার মতো পুলিশ ছুটিছাঁটাও পায় না।
দিনের পর দিন এত অমানবিক ডিউটি করতে করতে পুলিশের মানবিকতাও বোধহয় ফুরিয়ে যায়। সারা দিন খুন-খারাবি, রক্ত, লাশ দেখতে দেখতে তাদের আবেগ ভোতা হয়ে যায়। কারো কান্না, কারো মৃত্যু তাদের স্পর্শ করে না। এ কারণেই মানুষ তাদের ভয় পায়। অবশ্য ভয় না পেয়েও উপায় নেই। পুলিশের হাতে আছে আইন। আর আইনের হাত অনেক লম্বা। আপনি যদি মনে করেন, আপনি কোনো অপরাধ করেননি। তাই আপনার কোনো ভয় নেই। কোনো লাভ নেই। পুলিশ চাইলে যে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকেও ফাঁসিয়ে দিতে পারে। থানায় অনেক মামলা হয়, যাতে কয়েকজন আসামির নাম থাকে, পাশাপাশি থাকে অজ্ঞাতপরিচয় আরও অনেকের কথা।
পুলিশ চাইলে যে কোনো মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে আপনার নাম ঢুকিয়ে দিতে পারে। পুলিশ চাইলে আপনার পকেটে গাজা বা ইয়াবা ঢুকিয়ে রাস্তা থেকে আপনাকে তুলে নিতে পারে। কথায় বলে না, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশ ছুঁলে ছত্রিশ ঘা। কোনো কারণে একবার যদি পুলিশ আপনাকে পায়, আপনার জীবন শেষ। হয়তো পাড়ায় ছোট কোনো ঘটনায় আপনি আটক হলেন, তারপর আপনার জীবন পাল্টে যাবে। এরপর চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, হত্যাকাণ্ড- একের পর এক মামলার জালে জড়িয়ে যাবেন। পুলিশের আয়ের সবচেয়ে সহজ উপায় হলো, কাউকে থানায় ধরে এনে তার পরিবারের কাছ থেকে টাকা আদায়। না পেটানোর জন্য টাকা, কম পেটানোর জন্য টাকা, ছেড়ে দেয়ার জন্য টাকা- আপনার সামর্থ্যের ওপর নির্ভর করবে আপনার সঙ্গে পুলিশের আচরণ।
পুলিশ কাউকে ধরে নিলে থানায় নিয়ে তাকে পেটাবে, এটা যেন সাধারণ ব্যাপার। রিমান্ডে আনলে তো থার্ড ডিগ্রি টর্চার করা হবে, এটাও যেন গ্রহণযোগ্য ও মামুলি ব্যাপার। অথচ আইনের কোনো পর্যায়েই কিন্তু কারও গায়ে হাত তোলার অধিকার কারোই নেই। পুলিশ চাইলে কোনো মামলার আসামি বা সন্দেহভাজন কাউকেও গ্রেপ্তার করতে পারবে; কিন্তু তাকে পেটাতে পারবে না। পুলিশের কাজ হলো গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে আদালতে হাজির করা। আদালত তাকে জামিন দিতে পারেন, কারাগারে পাঠাতে পারেন, এমনকি পুলিশ চাইলে আদালত অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আসামিকে রিমান্ডেও পাঠাতে পারেন। রিমান্ডে এনে পুলিশ আসামিকে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে; কিন্তু পিটিয়ে তথ্য আদায় করতে পারে না। আদালতও বিচার শেষে আসামি খালাস দিতে পারেন, কারাদণ্ড দিতে পারেন, এমনকি মৃত্যুদণ্ডও দিতে পারেন। গ্রেপ্তার থেকে বিচার কোনো পর্যায়েই শারীরিক নির্যাতনের কোনো সুযোগ নেই।
কিন্তু পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনা আকছার ঘটে। পুলিশ পিটিয়ে তাদের ইচ্ছামতো স্বীকারোক্তি আদায় করে। পুলিশের ভয়ে আসামি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছেও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে আদালতে গিয়ে তারা সেটা অস্বীকার করে। একবার নারায়ণগঞ্জে এক ব্যক্তি পুলিশের পিটুনিতে নিখোঁজ এক ব্যক্তিকে হত্যার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। পরে দেখা গেল, যাকে হত্যার স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, সেই ব্যক্তি বেঁচে আছেন। পুলিশের হাতে আছে আইন এবং অস্ত্র। তারা চাইলে দিনকে রাত, তিলকে তাল বানাতে পারে।
মাঝে মধ্যে পত্রিকায় দেখি ‘পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু’। এটা আমার কাছে অদ্ভুত লাগে। হেফাজত মানে তো কাউকে সুরক্ষা দেয়া। আপনি যখন কাউকে হেফাজতে নেবেন, আপনার দায়িত্ব হলো তার সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আপনার হেফাজতে কেউ মারা গেলে তার দায়-দায়িত্ব সম্পূর্ণ আপনাকেই নিতে হবে। অথচ বাংলাদেশে ঘটে উল্টো ঘটনা। পুলিশ কাউকে হেফাজতে নেয়ার পর থেকেই পেটানো শুরু করে। আগেই বলেছি, পেটানোর মাত্রা নির্ভর করে আপনার পরিবারের সামর্থ্যের ওপর। পেটানোর মাত্রা বেশি হয়ে গেলে আপনার মৃত্যুও হতে পারে। র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কমে এসেছে; কিন্তু একেবারে বন্ধ হয়েছে, এটা বলা যাবে না। আসলে পুলিশ হয়তো হত্যা করতে চায়নি; কিন্তু মারের মাত্রা বেশি হয়ে গেলে বা অনেক সময় বেমক্কা আঘাতে মৃত্যু ঘটতে পারে।
রোববার (২ জুন) যশোরের অভয়নগর থানায় পুলিশ হেফাজতে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর আগের দিন শনিবার রাত দেড়টার দিকে উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রাম থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশের দাবি আফরোজা বেগম নামে ওই নারীকে ৩০টি ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রোববার সকাল ৮টা ২০ মিনিটের দিকে আফরোজা বেগম থানা হাজতে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে চিকিৎসার জন্য অভয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হয়। প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাকে আবার থানায় ফিরিয়ে আনা হয়। পৌনে ১০টার দিকে আবার অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে আবার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হয়। পরে তাকে উন্নত-চিকিৎসার জন্য যশোর জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হলে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
রাত দেড়টা থেকে সকাল পর্যন্ত তার ওপর কী ধরনের নির্যাতন হয়েছে, সেটা আমরা জানি। আমরা কেবল দেখেছি একজন সুস্থ-স্বাভাবিক নারীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ১০ ঘণ্টার মধ্যে তিনি মারা গেছেন। আফরোজা বেগম নির্দোষ না কি সত্যি তিনি ইয়াবা ব্যবসা করতেন, আমরা জানি না। ধরে নিচ্ছি, তিনি ইয়াবা ব্যবসাই করতেন; কিন্তু ৩০টি ইয়াবাসহ আটকের সাজা নিশ্চয়ই মৃত্যুদণ্ড নয়। পুলিশ যথারীতি দাবি করছে, তাকে থানায় কোনো নির্যাতন করা হয়নি; কিন্তু নিহতের সন্তানের দাবি, আটকের সময় থেকেই পুলিশ তাকে নির্যাতন শুরু করে। এমন কি বাসায় তাকে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে পেটানো হয়েছে। বাধা দেয়ায় পুলিশ তার সন্তানকেও থাপ্পড় মেরেছে।
পুলিশ যে রাতে তাকে থানায় এনে মারধর করেনি, এটা কেউই বিশ্বাস করবে না। এমনিতেই বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে নানা অভিযোগ, সমালোচনা। সেখানে পুলিশের এই নিষ্ঠুরতা আমাদের আরও বিপাকে ফেলবে। আমরা চাই আফরোজার মৃত্যুর জন্য যারাই দায়ী, তাদের যেন আইনের আওতায় আনা হয় এবং কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হয়। আমরা আইনের শাসন চাই, আইনি হেফাজতে নির্যাতন এবং মৃত্যু চাই না।
প্রভাষ আমিন: কলামিস্ট ও হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে