অমর একুশে বিশেষ সংখ্যা ২০২৪
বিকেল সোয়া ৩টার পর পুলিশ গুলি চালায়
আহমদ রফিক একজন ভাষাসংগ্রামী। মহান ভাষা আন্দোলনের সামনের সারির সংগঠক। রবীন্দ্র গবেষক। একইসঙ্গে তিনি প্রাবন্ধিক, কবি ও কলামিস্ট হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। শিক্ষা জীবনে প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যে কারণে তার শিক্ষাজীবন বিপর্যস্ত হয়। একাধিক সাহিত্য ও বিজ্ঞান পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যুক্ত থেকেছেন সংবেদনশীল হৃদয় নিয়ে। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৩০-এর বেশি। ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আহমদ রফিকের সঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাহাত মিনহাজের কথা হয় লেখকের ইস্কাটনের বাসায়। সংক্ষিপ্ত এক আলাপচারিতায় তিনি তুলে ধরেন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের নানা অজানা দিক।
রাহাত মিনহাজ: একুশে ফেব্রুয়ারির সকালটা কেমন ছিল?
আহমদ রফিক: ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ। শীত বেশ জেঁকে বসেছে। কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল। তবে চাপা উত্তেজনা পুরো ক্যাম্পাসে। সূর্যের দেখা পাওয়ার আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ে জড়ো হয়েছিল শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীর পদচারণায় সরব কলাভবন। মধুর ক্যান্টিনে অনেক আগেই এসেছেন ছাত্র নেতারা। আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক চলছিল ১৪৪ ধারা ভাঙা নিয়ে। এদিকে কলাভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছে খাকি হাফপ্যান্ট পরা পুলিশ। কারও হাতে লাঠি, কারও কারও হাতে অস্ত্র। পাশে দাঁড়ানো জিপ, ট্রাক। বলা যায় পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল নূরুল আমিনের [পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী] পুলিশ বাহিনী।
রাহাত মিনহাজ: ভাষা আন্দোলনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বা পর্যায় ছিল ২১ ফেব্রুয়ারি সকালের আমতলার ছাত্রসভা। যেখান থেকে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ওই সভা সম্পর্কে আমাদের কি জানাতে পারেন...
আহমদ রফিক: যতদূর মনে আছে আমতলায় ওই ছাত্রসভা শুরু হয় সকাল ১১টার দিকে। সেখানে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের শামসুল হক ১৪৪ ধারা ভাঙার বিপক্ষে বক্তব্য দেন। তবে ছাত্ররা তা প্রত্যাখ্যান করেন। মাঝ পথেই তিনি বক্তব্য বন্ধ রাখেতে বাধ্য হন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির আহ্বায়ক আব্দুল মতিন ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে মত দেন। ধীর স্থির সাবলীল যুক্তিতে ১০ জনের ছোট ছোট দলে ১৪৪ ধারা ভাঙার পরিকল্পনা তুলে ধরেন। যার গন্তব্য হবে অ্যাসেম্বলি হল। এরপর সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি গাজীউল হকের বক্তব্যের মাধ্যমে সভা শেষ হয়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয় ১৪৪ ধারা ভাঙার। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই স্লোগানে প্রকম্পিত কলাভবন।
রাহাত মিনহাজ: এরপর কি হলো। অর্থাৎ গুলিতো শুরু হলো বিকেলের দিকে এই মাঝের সময়টাতে কি ঘটলো?
আহমদ রফিক: সভা শেষ হতে হতেই চারদিকে উত্তেজানা ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা ১০ জনের দল করে কলাভবনের বাইরে আসতে থাকেন। এ সময় পুলিশ প্রচুর কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। হাফপ্যান্ট পরা পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে লাঠিচার্জও করে। কয়েকজনকে আটক করে গাড়িতেও তোলা হয়। যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হাবিবুর রহমান শেলী [তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি], আবদুস সামাদ, আনোয়ারুল হক খানসহ আরও কয়েকজনকে। এখানে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয় ছাত্রীরাও ১৪৪ ধারা ভঙ্গের মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন। যাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন পুলিশের লাঠিচার্জে আহতও হন, তবে তাদের আটক করা হয়নি। এ সময় মূলত আমতলা থেকে ঢাকা মেডিকেলের ব্যারাক পর্যন্ত উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
রাহাত মিনহাজ: ছাত্রদের এ আন্দোলনে কারা যোগ দিয়েছিলেন। শোনা যায় অনেক সাধারণ মানুষ, যারা ছাত্র নন তারাও সেদিন আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন?
আহমদ রফিক: আসলে ভাষার প্রতি মমতা সবারই ছিল। এখনো আছে। তাই ছাত্রদের এ আন্দোলনে সবারই সমর্থন ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন থেমে থেমে ছাত্র পুলিশ সংঘর্ষ চলছে, তখন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। যেমন সচিবালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী, দোকান রেস্তোরাঁর কর্মী ও সাধারণ মানুষ। পুরোনো ঢাকার মানুষ এক সময়ে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করলেও এ দিনর পুরাতন ঢাকার অনেক সাধারণ মানুষকেও ভাষা আন্দোলনের পক্ষে রাস্তায় নেমে আসতে দেখা যায়।
রাহাত মিনহাজ: ঐ দিন প্রথম গুলি কোথায়, কখন হলো। তাতে কে মারা গেলেন বা কারা আহত হলেন?
আহমদ রফিক: আমার যতদূর মনে পড়ে ঐদিন বিকেল সোয়া ৩টা থেকে সাড়ে ৩টা মাঝামাঝি কোনো এক সময় পুলিশ গুলি চালায়। ছাত্ররা আসলে কলাভনের মূল দরজা দিয়ে বাইরে আসতে চাচ্ছিল। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও লাঠিচার্জের মাধ্যমে তা আটকে রেখেছিল। তবে দুপক্ষ থেকে ক্রমাগত ইট পাটকেল নিক্ষেপেরে ফলে পরিস্থিতির অবনতি হয়। এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি চালায়। সরকারি প্রেস নোটে বলা হয়েছিল পুলিশ গুলি চালায় ৩টা ২০ মিনিটে। গুলির সংখ্যা ২০ রাউন্ড। পুলিশের গুলিতে প্রথমে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন বরকত। দীর্ঘদেহী বরকত ছিলেন এমএ ক্লাসের শেষ বর্ষের ছাত্র। এ ছাড়া গুলিবিদ্ধ হন সালামসহ আরও অনেকে। যাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন পরে হাসপাতালে মারা যান।
রাহাত মিনহাজ: গুলিতে ছাত্র হত্যার প্রতিক্রিয়া কেমন হয়েছিল?
আহমদ রফিক: সে ছিল এক অভূতপূর্ব অবস্থা। গুলিতে ছাত্র হত্যার পর যেনো মুহূর্তেই প্রতিবাদে ফেটে পড়ে পুরো ঢাকা শহর। তখন আর এ আন্দোলন ছাত্রদের ছিল না। পুরো ঢাকা শহর তখন বিক্ষোভের নগরী। নূরুল আমিন সরকারের পুলিশ বাহিনীর নির্মমতা দেখে ক্ষুব্ধ সারা দেশ। ১৪৪ ধারা, সরকারের সব বিধি নিষেধ ভেঙে রাজপথে হাজার হাজার মানুষ। সবাই তখন ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ফুঁসছিল। ছাত্র হত্যার ঘটনায় সেদিন পরিষদ ভবনেও ঝড় ওঠে। মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশসহ বেশ কিছু নেতা এ ঘটানার প্রতিবাদে সোচ্চার হন। পরিষদের সভা মুলতবি রাখার প্রস্তাব গৃহীত না হলেও ভবন থেকে বেরিয়ে আসেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মনোরঞ্জন ধর, খয়রাত হোসেন, আনোয়ারা খাতুনসহ অন্যরা। সেদিন পুলিশের গুলির পর যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা ২২ ফেব্রুয়ারিতেও অব্যাহত ছিল। ওই দিনও পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন নিহত হন।
রাহাত মিনহাজ: ভাষার দাবিতে অন্দোলনরত ছাত্রদের গুলি হত্যার ঘটনায় একটা বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করা হয়েছে। সে কমিশন প্রতিবেদনে কি বলা হয়েছিল?
আহমদ রফিক: এ ঘটনার পর পাকিস্তান সরকার বিচারপতি এলিসকে দিয়ে একটা কমিশন গঠন করে। যা এলিস কমিশন নামেই পরিচিতি লাভ করে। এ কমিশন যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে তা ছিল পক্ষপাতদুষ্ট। মিথ্যাচারে পরিপূর্ণ। একজন বিচারপতি এমন প্রতিবেদন দিতে পারেন বিষয়টি সে সময় খুবই আশ্চর্যজনক বিষয় ছিল। তিনি তার প্রতিবেদনে বলেন, সেদিন ছাত্ররা ছিলেন উচ্ছৃঙ্খল, দাঙ্গাবাজ। আর পুলিশ যে ২৭ রাউন্ড গুলি চালিয়েছে তা ছিল নিতান্তই আত্মরক্ষামূলক। আর পুলিশ গুলি চালিয়েছে কলাভবনের বাইরে থেকে। অর্থাৎ পুলিশ আত্মরক্ষার স্বার্থেই গুলি চালিয়েছে। বিচারপতি এলিসের এমন প্রতিবেদন পূর্ব বাংলার মানুষ প্রত্যাখ্যান করে। এ ছাড়া ওই প্রতিবেদন তৈরির আগে তিনি বেশ কিছু ছাত্রের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। যারা বলেছিলেন, সেদিন গুলি চালানোর মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। তারপরও পুলিশ গুলি চালিয়েছে। বিচারপতি এলিসের প্রতিবেদনে এসব কিছুই আসেনি।
রাহাত মিনহাজ: ভাষার দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণ এবং এর পরের বেশ কিছু ঘটানায় কিছু বাঙালি অনেকটা বিশ্বাসঘাতকের মতো ভূমিকা পালন করেছিলেন। তারা কারা, তাদের ভূমিকা আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আহমদ রফিক: বাঙালি হয়েও ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে যিনি সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ভূমিকা রাখেন তিনি নূরুল আমিন। ১৯৫২ সালে তিনি পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। তার নির্দেশে না হলেও তার অনুমোদনেই ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো হয়। এমনকি গুলি করে ছাত্র হত্যার পর এক বেতার ভাষণে তিনি বলেছিলেন, পুলিশ বাধ্য হয়ে গুলি চালিয়েছে। আর সেদিন যদি পুলিশ এ দায়িত্ব পালন না করত তাহলে তারা আগামী প্রজন্মের কাছে অপরাধী হয়ে থাকতেন। এ ছাড়া বাঙালি এসপি মোহাম্মদ ইদরিস, ডিআইজি ওবাইদুল হকও অত্যন্ত নেতিবাচক ভূমিকা রাখেন। একজন বাঙালি হিসেবে বাংলা ভাষার আন্দোলনের বিরুদ্ধে তাদের এই অবস্থান সবার মধ্যে তীব্র ঘৃণা তৈরি করে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে