Views Bangladesh Logo

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ

তদন্তে থাকবে না পুলিশ, মামলা পরিচালনায় অ্যাটর্নি সার্ভিস

রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে বর্তমান অন্তর্বতীকালিন সরকার। যার মধ্যে অন্যতম বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। গতকাল শুক্রবার ৩ জানুয়ারি এই কমিশনের কমিশনের কাজ শেষ করার সময় বেঁধে দেওয়া হলেও শেষ দিনে তা ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বৃদ্ধি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। তবে বেঁধে দেওয়া সময়েই বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন বেশ কিছু সুপারিশের খসড়া প্রস্তুত করেছে বলে জানা গেছে। যা প্রাথমিক প্রতিবেদন হিসেবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দেওয়া হয়েছে।

কমিশনের সূত্রে জানা গেছে, খসড়া সুপারিশে হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক নিয়োগের প্রক্রিয়া, নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা ও অপসারণের বিধির বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। একইসঙ্গে হাইকোর্ট বিভাগ ও অধস্তন আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ করে বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্ট বিভাগ ও উপজেলা পর্যায়ে অধঃস্তন আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বলা হয়েছে। কমিশন মামলা তদন্তের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছে। যাতে বলা হয়েছে, মামলা তদন্তে পুলিশের পরিবর্তে পৃথক তদন্ত সংস্থা গঠনের পাশাপাশি রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য স্থায়ী আইনজীবী নিয়োগ দিতে পৃথক অ্যাটর্নি সার্ভিস করা প্রয়োজন। কারণ দেশে বিরোধী পক্ষকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মিথ্যা মামলা এবং পুলিশকে ব্যবহারের মাধ্যমে হেনস্তার ঘটনা অহরহ ঘটে। এর ওপর রয়েছে পুলিশের কিছুসংখ্যক সদস্যের দুর্নীতি, যা রোধের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা নেই। তদন্ত সংস্থায় নিয়োজিত জনবল পুলিশ বাহিনী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হবে। তাদের নিয়োগ, চাকরির শর্তাবলি, নিয়ন্ত্রণ, বাজেট, অবকাঠামো ও আনুষঙ্গিক বিষয় একটি স্বতন্ত্র সংগঠন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোভুক্ত হবে। মামলা হওয়ার পরই কেবল তদন্ত সংস্থা কাজ শুরু করবে। তবে জরুরি ক্ষেত্রে এবং ঘটনার জটিলতা ও গুরুত্ব বিবেচনা করে পুলিশ আনুষ্ঠানিক মামলা করার আগেও সম্ভাব্য তদন্তের অংশ হিসেবে তদন্ত সংস্থার সহায়তা নিতে পারবে। তদন্ত শুরুর প্রথম পর্যায় থেকেই তদন্তকারী কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট অ্যাটর্নি বা প্রসিকিউটরের তদারকিতে তদন্তকাজ চালাবেন। পুলিশ বিভাগ ও তদন্ত সংস্থার কাজের সুনির্দিষ্ট বিভাজন থাকবে। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধন এবং যথাযথ বিধানসংবলিত নতুন আইন তৈরি করতে হবে।’এতে আরো বলা হয়, ‘শুধু থানা পুলিশ নয়, ডিবি, পিবিআই ও সিআইডি বর্তমানে মামলার তদন্ত করে। এসব সংস্থাও পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট। তাই এসব বাহিনীর পরিবর্তে পৃথক তদন্ত সংস্থা গঠন করা প্রয়োজন।’

এ ব্যপারে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এমদাদুল হক ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘যেকোনো অভিযোগ বা মামলা তদন্তে পুলিশ, ডিবি, সিআইডি ও পিবিআই-এর পরিবর্তে পৃথক তদন্ত সংস্থা গঠনের জন্য সুপারিশ করে প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া স্বল্প সময়ে ও স্বল্প ব্যয়ে বিচার প্রার্থীদের বিচারপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম, রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য স্থায়ী আইনজীবী নিয়োগ, পৃথক অ্যাটর্নি সার্ভিস, বিচার বিভাগের আর্থিক স্বাধীনতা, পর্যাপ্ত বাজেট নিশ্চিত করাসহ বেশ কয়েকটি বিষয় কমিশন সুপারিশ করেছে। আইনজীবী নিয়োগ পরীক্ষার সিলেবাসে সংশোধনীসহ কিছু প্রয়োজনীয় আইনের অন্তর্ভুক্তি ও সিলেবাস সম্প্রসারণ, বার কাউন্সিল কর্তৃক আইনজীবী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপন ও নতুনভাবে নিয়োগকৃত আইনজীবীদের ছয় মাস মেয়াদী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, বার কাউন্সিল অর্ডার ১৯৭২ সংস্কার, এনরোলমেন্ট কমিটির সদস্যপদ বৃদ্ধি বিষয়েও সুপারিশ করেছে কমিশন।’

তিনি বলেন, 'সরকার নোটিফিকেশনে তার পলিসি স্পষ্টভাবে জানিয়েছে। কমিশন সেভাবেই কাজ করছে।’

কমিশন এরই মধ্যে তাদের কাজের শতকরা আশি ভাগ সম্পন্ন করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কিছু দাপ্তরিক কাজ ড়বাকি আছে। বিচারিক আদালত সংক্রান্ত কিছু সংস্কারের বিষয়ে আরো কাজ কিছু কাজ করতে হবে। হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক নিয়োগের পদ্ধতি ও মানদন্ড কেমন হবে- সে বিষয়ে আলোচনা এখনো চলমান। দেশের প্রচলিত আইনসমূহ এবং একই ধরনের লিগ্যাল সিস্টেমের অন্যান্য দেশে প্রচলিত পদ্ধতি সমূহের তথ্য সংগ্রহ করে সংস্কারের সম্ভাব্য দিকগুলো বিবেচনা করছি। এগুলো সম্পন্ন হলেই আমরা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে দেব। এর জন্য আমরা ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় নিয়েছি। আশা করছি এর মধ্যেই সব কাজ সম্পন্ন করবে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন।’

এ ব্যপারে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে পুলিশের পরিবর্তে পৃথক তদন্ত সংস্থা গঠনের পাশাপাশি রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য স্থায়ী আইনজীবী নিয়োগ দিতে পৃথক অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনের যে প্রস্তাব দিয়েছে তা সুবিচারের জন্য খুবেই গুরুত্বপূর্ণ। এতে বিচারপ্রার্থী মানুষের ভোগান্তি কমবে বলেই মনে করছি। এছাড়া হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক নিয়োগ ও আইনজীবী নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের সুপারিশও গুরুত্বপূর্ণ হবে বিচার বিভাগের জন্য। এক্ষেত্রে বর্তমান সরকারকে আন্তরিক হতে হবে সুপারিশগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও বিএনপির আইন বিসয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে পুলিশের পরিবর্তে পৃথক তদন্ত সংস্থা গঠনের প্রস্তাবটি অবশ্যই ভালো। আমরা দেখেছি বিগত সরকারের সময় কিভাবে পুলিশ বাহিনীর প্রতিটি ইউনিট দিয়ে বিরোধী মতের মানুষদের হয়রানি করা হয়েছে। বাদ যায়নি সাধারণ মানুষও। তাই এই সংস্তার জরুরী। এছাড়া নতুন নিয়োগকৃত আইনজীবীদের ছয় মাস মেয়াদী প্রশিক্ষণ, বার কাউন্সিল অর্ডার ১৯৭২ সংস্কার ও এনরোলমেন্ট কমিটির সদস্যপদ বৃদ্ধি সুপারিশও বিচার বিভাগের জন্য মঙ্গলজনক হবে। তবে এসব সুপারিশের কতটা বাস্তবায়ন হবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।’

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানকে প্রধান করে গত ৪ অক্টোবর বিচার বিভাগ সংস্কার এই কমিশন গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনে সদস্য হিসেবে রয়েছেন-হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এবং সাবেক জেলা ও দায়রা জজ বিচারপতি এমদাদুল হক, হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এবং সাবেক জেলা ও দায়রা জজ বিচারপতি ফরিদ আহমেদ শিবলী, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ এবং সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার সাইয়েদ আমিনুল ইসলাম, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ এবং মাজদার হোসেন বনাম রাষ্ট্র মামলার বাদী মাজদার হোসেন, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী তানিম হোসেন শাওন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এসোসিয়েট প্রফেসর কাজী মাহফুজুল হক (সুপন) এবং শিক্ষার্থী প্রতিনিধি।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ