অর্থনীতির পাশাপাশি রাজনৈতিক সংস্কারও জরুরি হয়ে পড়েছে
ব্যাংক খাতে এখন যে খারাপ অবস্থা, তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকও অনেকাংশে দায়ী। এখন দেখার বিষয়, কেন তারা অনিয়মে সহায়তা করেছে। মনে রাখতে হবে, সামগ্রিকভাবে জাতিগত পতনের সঙ্গে ব্যাংক খাতের এই দুরবস্থা তৈরি হয়েছে। তাছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ। এটা কমে আসবে। তবে আজই কমবে, তা নয়; কীভাবে তা কমিয়ে আনা যায়, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। রিজার্ভ বাড়ানো ও মূল্যস্ফীতি কমাতে কাজ করা হবে। অর্থ পাচার ঠেকাতে সরকারের সঙ্গে মিলে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করবে।
আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যা অনেক গভীরে এবং তার সমাধানও রাতারাতি সম্ভব নয়। তার পরও অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার কী হতে পারে, সে বিষয়ে কিছু আলোকপাত করতে চাই। প্রথমেই ব্যাংকিং খাতের কথা বলা দরকার। এ খাতের অবস্থা দুর্বল। ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সরকার শুরুতেই ১০০ দিনের একটা পরিকল্পনা নিতে পারে। এই ১০০ দিনের কাজ হবে অর্থনীতির সমস্যা চিহ্নিত করা। পাশাপাশি সম্ভাব্য সমাধানের পথও বের করতে পারে। ব্যাংক খাত এবং পুঁজিবাজারের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। অর্থনীতির বাইরে অন্যান্য বিষয় সরকারের ১০০ দিনের পরিকল্পনার মধ্যে থাকতে পারে।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে দুটি দিক– একটা হলো সামষ্টিক, আরেকটি ব্যষ্টিক। সামষ্টিক অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে মানুষ বাঁচতে চায়। সরকার আগামী ছয় মাস বা এক বছরে মূল্যস্ফীতি কতটুকু কমাতে চায়, পরিকল্পনায় তা বলুক। আমি মনে করি, রাজস্ব খাতে সংস্কার খুবই জরুরি। কর আদায় ও কর প্রশাসনে যথাযথ সংস্কার না হলে অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়া কঠিন। পাশাপাশি বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিকল্পনা জানানো উচিত।
সরকার স্থানীয় সরকারকে কতটুকু উজ্জীবিত করবে, তাও দেখার বিষয়। স্থানীয় সরকারের অবস্থা খুবই শোচনীয়। স্থানীয় সরকার উজ্জীবিত না হলে নেতৃত্ব তৈরি হবে না। আমরা যদি স্থানীয় সরকারকে ক্ষমতায়ন করি, সেখানে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় ব্যয় করি, তবে তৃণমূলের মানুষ উপকৃত হবে। তৃণমূল থেকে নেতৃত্ব তৈরি হলে তা অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখবে।
মানুষ খুব সহজে উপকৃত হতে পারে যদি তারা সরকারি সেবা যথাসময়ে পায়। যেমন– ভূমি অফিসে গিয়ে হয়রানির শিকার হওয়ার কথা শোনা যায়। সেখানে কাজ আদায় করতে গেলে ঘুষের কারবার প্রচলিত। এর অবসান ঘটাতে হবে। এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, কেউ ঘুষ চাইলে যেন সহজে অভিযোগ করা যায় এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়। এ জন্য প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। যেমন– সিসি ক্যামেরা লাগানো এবং গ্রাহকের সঙ্গে সব কথাবার্তা রেকর্ডের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সেবাপ্রার্থী যে কাজ নিয়ে আসবেন, তা দীর্ঘদিনের জন্য ঝুলিয়ে রাখা যাবে না। দ্রুত করে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। সবকিছুই স্বচ্ছ হতে হবে।
যথাযথ সেবা দেওয়ার বিষয়টি আলাদাভাবে সব মন্ত্রণালয় বা বিভাগ নিশ্চিত করবে। মানুষ যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে কিনা, তা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দেখবে। শিক্ষা প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে সার্ভিস বেনিফিটের জন্য যাতে শিক্ষকদের দিনের পর দিন ঘুরতে না হয়, তা নিশ্চিত করবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ভূমি অফিস দেখবে ভূমি মন্ত্রণালয়। পাসপোর্ট অফিসের বিষয়টা দেখবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।
অর্থনীতির পাশাপাশি রাজনৈতিক সংস্কারও জরুরি হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংস্কার প্রয়োজন। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। রাজনৈতিক দলের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা বাড়াতে হবে। নেতৃত্ব নির্বাচনে গণতান্ত্রিক চর্চা করতে হবে।
আমি মনে করি, সরকারের তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন। সেনাবাহিনীকে নিয়েই তা দ্রুত করতে হবে। পুলিশ বাহিনীর ক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হলো, এর পুনর্গঠন দরকার। পর্যায়ক্রমে তাদের সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
ড. আহসান এইচ মনসুর: অর্থনীতিবিদ, গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে