Views Bangladesh Logo

ঘোলা জলে রাজনীতি: অস্থির সময়ের প্রতিচিত্র

Habib Imon

হাবীব ইমন

রাজনীতিতে যে অস্পষ্টতা, দ্বিধা ও উত্তেজনা জমে উঠছে, তা কেবল ঘটনার সমাহার নয়- এ এক সময়চিত্র। তা আমাদের শাসনব্যবস্থার গভীরে জমে থাকা দুর্বলতা, বৈপরীত্য ও অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ। সরকার পরিবর্তনের প্রায় এক বছর হতে চলছে, অথচ একটি স্পষ্ট রূপরেখা, সময়সীমা, কিংবা দায়িত্ববোধপূর্ণ রাজনৈতিক ভাষ্য নির্মাণ করতে পারিনি। বরং স্পষ্ট হয়ে উঠছে অনিশ্চয়তা, দায়িত্বহীনতা ও অস্বচ্ছ চর্চার এক জটিল চিত্র। ঘটনাবলির পরম্পরা দেখে অনেকে বলছেন, যেন এটি একটি অদৃশ্য পরিকল্পনার অংশ, যার উদ্দেশ্য পানি ঘোলা করে স্বার্থসিদ্ধি। বাস্তবতা হচ্ছে, কোনো না কোনো শক্তি এই ঘোলা পানিকে তাদের হাতের খেলা বানাতে চাচ্ছে বা এ পরিকল্পনার অংশীজন হচ্ছে- এতে কোনো সন্দেহ আছে? যে সরকারকে মনে করা হয়েছিল সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও শক্তিশালী, সেই সরকার আজ ১০ মাস পূর্ণ হতে না হতেই দুর্বলতার লক্ষণ স্পষ্টভাবে প্রকাশ করছে। নীতিগত স্পষ্টতা নেই, সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিভ্রান্তি, এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব জনমনে প্রশ্ন তুলেছে- এই সরকার কি আদৌ জানে কোথায় যাচ্ছে?

দুই.
মানুষ চেয়েছিল কী? একটি সুশাসনভিত্তিক প্রশাসন, যেখানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা, প্রশাসনিক দক্ষতা, মানবিকতা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, তাই তো! সেইসঙ্গে নির্বাচন ও গণতন্ত্রে ফেরার সুনির্দিষ্ট রূপরেখা ও সময়সীমাও চেয়েছিল তারা; কিন্তু তার বদলে এখন মানুষ দেখছে, ফেসবুক-ইউটিউব কেন্দ্রিক মবের শাসন প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। যেটা আমাদের ভেতরে নতুন ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছে। যেটা নতুন ফ্যাসিবাদের বন্দোবস্ত হচ্ছে। কেউ এক ভিডিও পোস্ট করলেই হুমকি দেওয়া হচ্ছে তাকে। আবার শাহবাগ থেকে যমুনায় দাবি-দাওয়া, এবং অবাক করা বিষয়- সরকার সে চাপে নতি স্বীকার করছে। নানা গোষ্ঠী, নানা উদ্দেশ্যে এবং নানা যুক্তিতে দাবি তুলছে, সময় বেঁধে দিচ্ছে, আর সরকার সেই দাবিগুলো বাস্তবায়ন করছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই সরকার তাহলে কার প্রতিনিধি? জনগণের, নাকি অদৃশ্য শক্তির? প্রশ্ন হচ্ছে, সেই অদৃশ্য শক্তি কে? সাম্রাজ্যবাদ না সম্প্রসারণবাদের গোষ্ঠী?

তিন.
সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ তৈরি করেছে, সশস্ত্র বাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্যদের একাংশের কর্মসূচি ঘিরে ঘটে যাওয়া ঘটনা। এমন কর্মসূচির পেছনে রাষ্ট্রবিরোধী অপশক্তির তৎপরতা থাকার আশঙ্কাও অমূলক নয়। পরিস্থিতি যে দিকেই যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে সরকার নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে নিয়ন্ত্রণহীনতার অভিনয় করছে।

এই অস্থিরতার মূল কারণ সম্ভবত সরকারের অভ্যন্তরীণ কোন্দল বা মতানৈক্য, সিদ্ধান্তহীনতা ও সময়সীমা নিয়ে অনিশ্চয়তা। সরকারের কিছু সিদ্ধান্ত কোথা থেকে এসেছে কিংবা কে বা কারা নেয় তা বোঝা যায় না। এমনকি উপদেষ্টাদের কেউ কেউ নানা সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তাদের অন্ধকারে থাকার কথা স্বীকার করেছেন। সবকিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি যেন একটা উদ্বেগজনক সীমায় এসে হাজির হয়েছে। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই সরকার যদি গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রকাশ করতো, সময় নির্ধারণ করত এবং জনগণের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করত- তাহলে এই বিভ্রান্তি তৈরি হতো না।

২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুদয়ের পেছনে যে বিশাল জনসমর্থন কাজ করেছিল, তা ছিল ইতিহাসে এক বিরল সম্মিলন। আওয়ামী লীগের দুঃশাসন, দমন-পীড়ন, নির্বাচনব্যবস্থার ধ্বংস, বিচারহীনতা ও সর্বগ্রাসী দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনতার বিদ্বেষ এতটাই তীব্র হয়ে উঠেছিল যে, সব মত ও পথের মানুষ একটি পরিবর্তনের পক্ষে একত্র হয়েছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেই গণদাবির বাস্তবায়ন হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।

গণ-অভ্যুত্থানই যেহেতু অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের ম্যান্ডেট এবং এসব চাওয়া যেহেতু গণ-অভ্যুত্থানেরই চাওয়া; তাই সরকারের এই স্বচ্ছ অবস্থানের বিরোধিতা করা তখন কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য কঠিন হয়ে যেত। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই কাজ না করে তার মেয়াদ নিয়ে একটি ধোঁয়াশা তৈরি করে রেখেছে। সরকারের ভেতরে একটি অংশও যেহেতু দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার পক্ষে, তাই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়েছে। শুধু রাজনৈতিক দলগুলো নয়, গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল অংশী হিসেবে আমরা যাদের বিবেচনা করতে পারি (সরকার, সশস্ত্র বাহিনী, বিএনপি, এনসিপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তি), বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের মধ্যেও বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে পড়েছে। এই ঘোলাটে পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়ার জন্য কোনো না কোনো পক্ষ যে ওত পেতে আছে, এই শঙ্কার কথা শুরুতেই বহুবার বলা হয়েছে।

এই পরিস্থিতি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের জন্য যেমন প্রশ্ন তোলে, তেমনি রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্যও এক গভীর সংকেত। যখন শাসকগোষ্ঠীর ভিত্তি নিজের কাছেই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, তখন রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ এক ধরনের আদর্শ শূন্যতার দিকে গড়ায়। বিএনপি এই সংকটে নিজেদের প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করলেও, তাদের রাজনৈতিক অবস্থান একটি সুস্পষ্ট দ্বন্দ্বে জর্জরিত। বিএনপির দ্বৈততা জনগণের মনে প্রশ্ন তোলে- দলটি কি সত্যিই গণতন্ত্র চায়, নাকি কেবল ক্ষমতার পথ খোঁজে? আবার বাংলাদেশে রাজনীতি যখন দলবদ্ধ একনায়কতন্ত্রে পর্যবসিত, তখন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নতুনভাবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।

চার.
সরকার দায়িত্ব নেওয়ার দশ মাস পর আমরা দেখছি, জনগণের প্রাথমিক প্রত্যাশা ক্রমেই ভেঙে পড়ছে। নীতি-নির্ধারণে অনিশ্চয়তা, স্পষ্ট সময়সীমার অভাব, এবং জনসম্পৃক্ত সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ার ঘাটতি স্পষ্টতর হচ্ছে। মানুষের এই প্রশ্নটা এখন জোরালো হচ্ছে- এই সরকার কি আদৌ জানে তারা কোথায় যাচ্ছে? তারা কাদের হয়ে শাসন করছে? জনগণের পক্ষে, না ঘোলাটে স্বার্থগোষ্ঠীর পক্ষে? যে সরকারকে মনে করা হয়েছিল সবচেয়ে শক্তিশালী, সেই সরকার আজ দশ মাস পূর্ণ হতে না হতেই দুর্বলতার লক্ষণ স্পষ্টভাবে প্রকাশ করছে। নীতিগত স্পষ্টতা নেই, সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বিভ্রান্তি, এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব জনমনে প্রশ্ন তুলেছে- এই সরকার কি আদৌ জানে কোথায় যাচ্ছে?

এই পরিস্থিতি শুধু একবারে সৃষ্টি হয়নি। একাধিক গোষ্ঠী এখন চায় সরকার তাদের দাবি মানুক- চায়, তাদের ভাষ্যই হবে একমাত্র সত্য। এতে করে রাষ্ট্রব্যবস্থা হয়ে উঠছে মব-নির্ভর, অথচ গণ-নির্ভর নয়। যারা ২০২৪ সালে রাস্তায় নামেনি, আন্দোলন করেনি, তারাই এখন রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার করছে। আর যারা শহীদ হয়েছে, মামলা খেয়েছে, নিখোঁজ হয়েছে- তাদের কণ্ঠ যেন ক্ষীণ হয়ে আসছে।

সরকার যদি জনগণের ম্যান্ডেটকে গুরুত্ব দিত, তবে প্রথম মাসেই একটি সুস্পষ্ট ‘রোডম্যাপ’ ঘোষণা করত- নির্বাচনের সময়সীমা, সংস্কারের ধাপ, দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ ও বিচারিক প্রক্রিয়াকে আবশ্যক মনে করত। কিন্তু সেই সাহসিকতা তারা দেখায়নি। বরং ক্ষমতার সহভাগীদের ‘খুশি রাখার’ এক ত্রিশঙ্কু কৌশলে নিজেদেরও বিতর্কিত করেছে। এখন আমরা দেখছি, বিভিন্ন পক্ষ বিভিন্ন সময়সীমা বলছে- ২০২৫ সালের ডিসেম্বর, কেউ বা বলছে ২০২৬ সালের জুন। আর সবচেয়ে বড় দল বিএনপি বলছে, এই ‘খোলা সময়সীমা’ গ্রহণযোগ্য নয়। তারা ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চায়। অন্যদিকে, এনসিপি বলছে- নির্বাচনের আগে যদি সংস্কার না হয়, তবে এই প্রক্রিয়া অর্থহীন। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, নতুন দলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে, পুরোনো সংস্কারের ভিত্তিতে নির্বাচন অর্থহীন হবে।

এই মতভেদ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আরও জটিল করে তুলছে। একটা সময়সীমা, একটা টার্গেট, একটা স্পষ্ট রাজনৈতিক চুক্তি ছাড়া দেশ এগোতে পারবে না। জনগণও বিভ্রান্ত হয়ে পড়বে, আবার কেউ কেউ সুযোগ নিয়ে ‘খালি মাঠে গোল’ দেয়ার চেষ্টা করবে। বিশেষত, যারা অতীতে ২০০৭-০৮ সালে সামরিক-পৃষ্ঠপোষক ‘সুদৃঢ় শাসন’ কায়েম করেছিল, তারা আবার নতুন ছক আঁকতে পারে।

পাঁচ.
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে পুনর্বহাল করার ইস্যুতে উপদেষ্টা ও এনসিপি নেতার মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছে। এই ঘটনা হয়তো ছোট। কিন্তু এটি এক গভীর দ্বন্দ্বের ইঙ্গিত বহন করে। এই দ্বন্দ্ব শুধু ব্যক্তিগত নয়- এটি অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসা রাজনৈতিক মতানৈক্য, গোষ্ঠীগত অসন্তোষ এবং ভবিষ্যতের ক্ষমতার লড়াইয়ের প্রাথমিক রূপ। সরকারকে বুঝতে হবে, এমন হাজারটা ছোট ইস্যু মিলেই তৈরি হয় বড় অস্থিরতা, যেখান থেকে গণঅসন্তোষ ছড়িয়ে পড়তে পারে।

দেশের ভেতরে দুর্বল নীতি-নির্ধারণ, মব চাপে সিদ্ধান্ত, এবং বাহ্যিকভাবে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত-করিডর চুক্তি, চীনের সঙ্গে পরিকাঠামোগত আলোচনা, এবং যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ- সবকিছু মিলে সরকার চরম চাপের মধ্যে রয়েছে। শুধু তাই নয়, বন্দরের নিয়ন্ত্রণ বিদেশি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্তগুলোও দীর্ঘমেয়াদি প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে- এই অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার আদৌ কি এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার বৈধতা রাখে? নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে জনমনে ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে- এমন কথাও আলোচনায় আছে। সরকারের মধ্যেও কেউ কেউ যে এমনটি চান, তা অনেকটাই স্পষ্ট।

ছয়.
এই সংকটময় সময়ে রাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রয়োজন ছিল দায়িত্বশীলতা, সংযম, এবং গঠনমূলক আত্মবিশ্লেষণ। অথচ প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব প্রকাশ্যে ‘রাজনৈতিক’ মন্তব্য করছেন। তিনি ‘বনসাই বাম’ বলে একটি গোটা রাজনৈতিক মতাদর্শ ও ইতিহাসকে তাচ্ছিল্য করেছেন, যেটি শুধু দুর্ভাগ্যজনক নয়- রাষ্ট্রীয় দায়িত্ববোধের পরিপন্থি। প্রশ্ন উঠছে- প্রেসসচিব কি আদৌ রাজনৈতিক বিশ্লেষক? তিনি কি কোনো দলের মুখপাত্র? নাকি একজন রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা, যার দায়িত্ব প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য ও সরকারি সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দেওয়া, তদারকি করা এবং সরকারি তথ্য পরিবেশন?

যখন এই ভূমিকায় থাকা ব্যক্তি বিরোধীমতের বিরুদ্ধে অবজ্ঞাসূচক শব্দ ব্যবহার করেন, তখন সেটি রাষ্ট্রযন্ত্রের পক্ষ থেকে এক ধরনের ‘অঘোষিত পক্ষপাত’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। প্রেসসচিবের এই বক্তব্য, যা প্রকৃতপক্ষে একটি দলীয় চিন্তার প্রতিধ্বনি, তা এই সরকারের গঠনমূলক অংশ নয়, বরং ক্ষতিকর উপসর্গ। এটি জানান দেয়, এই সরকার অভ্যন্তরীণভাবে কতটা আতঙ্কিত, বিভ্রান্ত, এবং আত্মসমালোচনায় অনিচ্ছুক।

‘বনসাই’ শব্দটি ব্যবহারে যে কৌশলী অবজ্ঞা প্রকাশ পেয়েছে, তা রাষ্ট্রশক্তির একটি অভ্যন্তরীণ দম্ভকে উন্মোচন করে। বনসাই হয়- কৃত্রিমভাবে কাটা-ছেঁড়া গাছ, যাতে সে বড় হতে না পারে। অথচ এই দেশের বামপন্থী রাজনীতি যদি আজ ছোট বা সীমিত হয়ে থাকে, তার দায় কি রাষ্ট্রের নয়? কিংবা রাষ্ট্র নিজেই দিন দিন বনসাইয়ে রূপ নিচ্ছে না তো? প্রতিটি সামরিক ও আধা-সামরিক সরকারের অধীনে যেভাবে বামপন্থিদের দমন করা হয়েছে, নিষিদ্ধ করা হয়েছে, জনবিচ্ছিন্ন করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে, আজও গণমাধ্যমে যেভাবে বাম রাজনীতিকে প্রান্তিক করে রাখা হয়- তা বনসাই করারই ধারাবাহিকতা।

এখানে একটি ঐতিহাসিক সত্য আমাদের স্মরণ করা জরুরি- এই দেশের প্রতিটি শাসকগোষ্ঠী, সামরিক হোক বা গণতান্ত্রিক মোড়কে মোড়া, বামপন্থিদের তুচ্ছ করেই এসেছে; কিন্তু ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে, উপেক্ষিত, নিগৃহীত এই বামপন্থী দলগুলো এই দেশের মাটি থেকে উঠে আসা সংগ্রামী রাজনীতির ধারক। এ বাম ধারাই আন্দোলনের অগ্রভাগে থেকেছে- ভাষা আন্দোলনে, স্বাধিকার সংগ্রামে, মুক্তিযুদ্ধে এবং স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থান, জাতীয় সম্পদ রক্ষা আন্দোলনে, তেভাগা আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন, কর্মসংস্থান আন্দোলনে, শ্রমিকের মজুরি আন্দোলন। যে শক্তিকে বারবার ‘অসম্ভব’ বলা হয়েছে, সময়ই তাকে করেছে ইতিহাসের মহান চালক। আর যারা বাম রাজনীতিকে অবজ্ঞা করে ইতিহাসে তাদের স্থান কোথায় থাকবে, তা সময় নিখুঁতভাবে বলে দেবে।

আজ যখন তারা শাসকগোষ্ঠীর দুর্নীতি, দমননীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে কথা বলে, তখন তাদের ‘বনসাই বাম’ বলে তাচ্ছিল্য করা হয়। এই অবজ্ঞার ভাষা একটি গভীর রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার বহিঃপ্রকাশ। তাই বামপন্থিদের বনসাই নয়, বলা উচিত তারা সেই দীপ্ত শিকড়- যাকে যতই কাটা হোক, প্রতিবারই নতুন পত্র-পল্লবে ফিরে আসে। রাষ্ট্রে সরকারি মুখপাত্রদের মুখে ঘৃণা, তাচ্ছিল্য ও দলীয় ভাষা প্রবল হয়ে ওঠে, সে রাষ্ট্রে ‘নিরপেক্ষতা’ শব্দটি ধসে পড়ে। এই ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে যায় গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা, এবং সম্মানের রাজনীতি।

সাত.
এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হলো- নির্বাচনের সময়সীমা ও কাঠামো চূড়ান্ত করা, যাতে সব দল এতে অংশগ্রহণে আগ্রহী হয়। সংস্কারপন্থি ও প্রতিশ্রুতিশীল রাজনৈতিক শক্তির নিরাপদ রাজনৈতিক মাঠ তৈরি, যাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা অর্থবহ হয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করা, যাতে মব চাপ নয়, নীতিগত দায়িত্ব ও জবাবদিহিতাই হয় প্রশাসনের ভিত্তি।
সরকার যদি এখনো এসব বিষয়ে সাহসিকতা ও স্বচ্ছতা দেখায়, তবে এখনও সময় আছে ঘুরে দাঁড়ানোর। না হলে এই ধোঁয়াশা ও দ্বিধার আবর্ত আমাদের নিয়ে যাবে এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে- যেখানে আবার সামরিকীকরণ, নিপীড়ন ও রাজনৈতিক মেরুকরণের পুরোনো ভূত জেগে উঠবে।

বাংলাদেশ একটি কঠিন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে সম্ভাবনার পথ, আবার পাশে প্রলয়ঙ্কর ঝড়েরও আভাস। আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে এই সরকার, বিরোধী দল, এবং জনগণের পারস্পরিক বোঝাপড়া, দৃষ্টিভঙ্গি ও আত্মত্যাগের ওপর। এখন সময়- আশা ও প্রজ্ঞার মধ্যে পথ খোঁজার। তাতে দেরি হলে, ইতিহাস ক্ষমা করবে না।

হাবীব ইমন : কলাম লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ