Views Bangladesh Logo

ভারত পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ যুদ্ধের সম্ভাবনা

Mohshin  Habib

মহসীন হাবিব

মে থেকে ১০ মে পর্যন্ত চার দিন শুধু উপমহাদেশের জন্য নয়, সারা বিশ্বের মানুষের মধ্যেই ভয় ও আতঙ্ক বিরাজ করেছে। এই চার দিন ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে পাল্টাপাল্টি যে মিসাইল, ড্রোন ও বিমান হামলা চলেছে তা দুই পরমাণু শক্তিধর দেশকে ফুল স্কেল ওয়ারের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। বিশ্বব্যাপী এত আতঙ্ক সত্ত্বেও যুদ্ধ শুরুর পর প্রথম তিন দিনে দুপক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী কাউকে দেখা যায়নি। তখন ভারত এবং পাকিস্তান উভয়ের বডি ল্যাঙ্গুয়েজেই কোনো আপোষের চিহ্ন ছিল না। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের এক উক্তি বিশ্বব্যাপী শান্তিপ্রিয় মানুষকে আরও উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। তিনি বলেছিলেন, ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ আমাদের বিজনেস নয়।

কিন্তু হঠাৎ করেই ১০ মে কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই কী করে দুদেশের মধ্যে গোলা ছোড়াছুড়ি বন্ধ হয়ে গেল? যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট প্রথমে দাবি করলেন, তার হস্তক্ষেপেই দুই দেশ যুদ্ধ বন্ধ করেছে এবং তার কথা শুনেছে। দুই দেশের সরকার এবং জনগণের প্রশংসা করলেন। ভবিষ্যতে কাশ্মীর ইস্যুতে তিনি মধ্যস্থতা করে স্থায়ী সমাধান করার আশা ব্যক্ত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট মার্কো রুবিও এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তাদের চেষ্টায় এই যুদ্ধ থামানো সম্ভব হয়েছে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উক্তি করেছেন জেডি ভ্যান্স। তিনি বলেছেন, এই যুদ্ধ দ্রুত থামানো না গেলে ডিফারেন্ট কাইন্ড অব এস্কেলেশন হতো।

তিনি পরিষ্কার বুঝিয়েছেন, যুদ্ধটি পরমাণু যুদ্ধের দিকে মোড় নিতে যাচ্ছিল। কথা হয়তো সত্য। দুই দেশের সরকার এবং উভয় দেশেরই জনগণ এই যুদ্ধ নিয়ে কোনো আপত্তি তোলেনি। বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যুদ্ধে জয়ের স্বপ্ন দেখছিল। ভারত চেয়েছিল, প্রচলিত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে হামলা চালিয়ে যেতে। তাদের হিসাবটা ছিল পাকিস্তানও যতদূর পারে প্রতিরোধ করুক। তাতে পাকিস্তানের ভঙ্গুর অর্থনীতি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে এবং দেশ হিসেবে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে। কিন্তু পাকিস্তান সবকিছু মিলিয়ে এই যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করতে চায়নি। তারা জানতো, যুদ্ধ এক মাস চালাতে পারবে না অর্থনৈতিক কারণে।

তাই শুরুতেই পাকিস্তান তাদের সর্বোচ্চ অস্ত্র ব্যবহার করেছে। এবং গুঞ্জন আছে, পাকিস্তান পরমাণু অস্ত্রের দিকে হাত বাড়িয়েছিল। দায়িত্বশীল দেশ হিসেবে সেটা জানতে পেরেই ভারত প্রথম সুযোগেই যুদ্ধ থামাতে রাজি হয়ে যায়। অবশ্য দুই দেশই স্বীকার করেছে, তারা সরাসরি টেলিফোন আলোচনার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ বিরতিতে সম্মত হয়েছে। উভয় দেশই সংক্ষিপ্ত যুদ্ধে জয়লাভ করেছে বলে দাবি করেছে। উভয় দেশই যুদ্ধ জয় সেলিব্রেট করেছে। দুই দেশের গণমাধ্যম নিজেদের পক্ষে জয়ের সংবাদ ফলাও করে প্রকাশ করেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ সংস্থাগুলো ভারতের একাধিক অত্যাধুনিক রাফায়েল যুদ্ধ বিমান ভূপাতিত হওয়ার কথা স্বীকার করেছে। পাকিস্তান যে ভারতের মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার এস-৪০০ ধ্বংসের দাবি করেছে তার সত্যতা এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি আন্তর্জাতিক মহল।

হঠাৎ করেই যে রাতভর আলোচনার পর যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশের যুদ্ধ থামিয়েছে বলে জানিয়েছে। কেন তারা হঠাৎ এমন সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন? তা কি পরমাণু যুদ্ধ থামাতে, নাকি পাকিস্তানকে রক্ষা করতে, নাকি ভারতকে রক্ষা করতে- এ প্রশ্ন এখন বিশেষজ্ঞদের আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পাকিস্তান বা ভারত যার দিকেই হোক না কেন তা হবে অর্থনৈতিক নানা হিসাব নিকাশের উপর ভিত্তি করে। তবে এ যুদ্ধে কোনো পক্ষকে সরাসরি সমর্থন দেওয়ার মত অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র নেই। একদিকে গাজা যুদ্ধ। এই যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের নিজেরই যুদ্ধ। গাজার হামাস, লেবাননের হেজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের হুতিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইসরায়েলকে রাজনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে যেতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের।

অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধে এক জটিল অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। একদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে রয়েছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ব্যক্তিগত সখ্যতা, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রশাসন শতশত বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সরবরাহ করেছে ইউক্রেনে যেখান থেকে বের হয়ে আসা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কঠিন। ন্যাটো ইউক্রেনের পক্ষে প্রক্সি ওয়ারে ব্যস্ত। যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর অন্যতম সদস্য। অন্যদিকে ইউক্রেনের সঙ্গে বিরল খনিজ পদার্থ নিয়ে বড় ধরনের চুক্তি করেছেন ট্রাম্প। স্বভাবতই সামনের দিনে পুরো ইউক্রেনকে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ধ্বংস হওয়া দেখতে চান না প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

আধুনিক যুগে একটি যুদ্ধে বড় দেশগুলো সেই দেশকেই সামরিক ও রাজনৈতিক সমর্থন দিয়ে থাকে, যে দেশ তার অস্ত্র ক্রয় করে এবং সেই অস্ত্র দিয়েই যুদ্ধ করছে। খুব সিম্পল হিসাব। ভারত পাকিস্তানের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব কী সেটা বোঝা খুবই মুশকিল। শুধু বড় বড় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোই বলতে পারবে। পাকিস্তানের হাতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের যুদ্ধবিমান। যুক্তরাষ্ট্রের গর্ব এফ-১৬ বিমান। যত আধুনিক যুদ্ধ বিমানই আসুক না কেন, বলা হয়, এফ-১৬ বিমান এখনো যুদ্ধাকাশে খুবই কার্যকরী। ভারতের হাতে রয়েছে রাশিয়ার সু-৩০ ও ফ্রান্সের চতুর্থ জেনারেশন রাফায়েল। যুক্তরাষ্ট্র কখনো চাইবে না তার বাণিজ্যসফল এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান রাশিয়ার সুখোই বা ফ্রান্সের রাফায়েলের দ্বারা ভূপাতিত হোক।

যদিও এফ-১৬ বিমান পাকিস্তানকে দেওয়া হয়েছে এই শর্তে যে ওই বিমানগুলো সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যবহার করা যাবে এবং ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে না। পূর্ণ মাত্রায় যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তান যে শর্ত অনুযায়ী বসে থাকবে না এটা নিশ্চিত। পরাজয়ের মুখে শুধু এফ-১৬ না, হাতে থাকা যে কোনো অস্ত্র ব্যবহার করবে এটা নিশ্চিত। ট্রাম্পের মত অর্থকৃপণ মানুষ যখন বিশ্বব্যাপী মানবিক সাহায্য থেকে শুরু করে নানা ধরনের অর্থ বরাদ্দ বাতিল করছে, তখন গত এপ্রিলে পাকিস্তানকে ৩৯৭ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে নিরাপত্তা সহায়তা হিসাবে, এফ-১৬ বিমান সচল রাখার স্বার্থে।

অন্যদিকে চীনা যুদ্ধবিমান জে-১০ ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে পাকিস্তান। ভারত কোনো মন্তব্য না করলেও ৯মে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে রয়টার্সকে জানানো হয়েছে, ভারতের অন্তত দুটি রাফায়েল ভূপাতিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যে সংবাদ গোপন করে না তা মোটেই নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে উৎসাহ নিয়ে জানান দেয়ার কারণও স্পষ্ট: রাফায়েল এবং এফ-১৬ এর বাজার প্রতিযোগিতা।

যুক্তরাষ্ট্র কেন উদ্যোগ নিয়েছে দুই দেশের যুদ্ধ থামাতে এবং তার সমর্থন কোন পক্ষে সেটা বোঝা বহু কারণে কঠিন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর নরেন্দ্র মোদিকে ‘মাই ফ্রেন্ড’ বলা ছাড়া এমন কোনো পদক্ষেপ নেননি যাতে মনে হয় ভারত বা নরেন্দ্র মোদি তার বিশেষ বন্ধু। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে অশোভন আচরণ করতে দেখা গেছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে সব ভারতীয়কে বের করে দেওয়া হয়েছে, তাদের সামরিক বিমানে হাত-পা বেঁধে অপমানজনকভাবে ভারতে পাঠানো হয়েছে, যা না করলেও কোনো ক্ষতি ছিল না। ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানে পাঞ্জাবের ভারত বিরোধী নেতা পান্নুনকে নিমন্ত্রণ জানানো হয়, যিনি ওই অনুষ্ঠানে বসেই খালিস্তান জিন্দাবাদ বলে আঙুল তুলে ভিক্টরি চিহ্ন দেখান। এসব কিন্তু ভারতের নজর এড়ায়নি।

একটি গুঞ্জন আছে যে নির্বাচনের পূর্বে নরেন্দ্র মোদি যখন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন তখন ট্রাম্প আশা করেছিলেন, মোদি তাকে সমর্থন দেবেন যাতে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় বংশোদ্ভুত ভোটাররা রিপাবলিক দলকে সমর্থন করে। কিন্তু মোদি সেখানে গিয়ে কমলা হ্যারিসের সঙ্গে দেখা করেছেন, বাইডেনের স্ত্রীকে হীরার আংটি উপহার দিয়েছেন, যা ট্রাম্পকে ক্ষুব্ধ করেছে। অন্যদিকে ট্রাম্প প্রশাসনের পলিসি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে তারা চীনের সঙ্গে বাণিজ্য প্রতিযোগিতা করতে চায়, সামরিক প্রতিযোগিতাকে উপেক্ষা করে। এটিও ভারতের জন্য খুব ভালো সংবাদ নয়। ৭ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত সময়ে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে চীন ও তুরস্ক পাকিস্তানের জন্য সামরিক সহায়তা নিয়ে প্রস্তুত। কিন্তু ভারতের জন্য তেমন কারো প্রস্তুতি দেখা যায়নি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের কেউ তুরস্ক বা চিনের নিন্দা জানায়নি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, আমরা যুদ্ধ বিরতিতে গিয়েছি; কিন্তু সামনের দিনগুলোতে আমরা দেখব পাকিস্তান কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়। সন্ত্রাস ও আলোচনা একসঙ্গে চলতে পারে না। ভারতীয়দের কাছে নরেন্দ্র মোদি বার্তা দিতে চেষ্টা করেছেন যে ভবিষ্যতে কোনো ধরনের হামলা হলে তিনি চরমভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। তিনি মুখে যাই বলুন না কেন, ২২ এপ্রিলের পেহালগাম হামলার মত উসকানি না হলে ভারত কোনো ক্রমেই যুদ্ধে জড়াবে না। কিন্তু একটি বিপদের সম্ভাবনা রয়ে গেছে। আমরা জানি, বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা আমাদের এ অঞ্চলে সক্রিয়। যদি কোনো একটি গোয়েন্দা সংস্থার উসকানিতে কোনোরকম হামলা হয়, তাহলে যুদ্ধ হয়ে উঠবে অবধারিত। তাই সামনের দিনে ভারত পাকিস্তান উভয় দেশের নিরাপত্তা আর এই দুইটি দেশের ইচ্ছা অনিচ্ছার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। দুদেশের মধ্যে লড়াই বাঁধিয়ে দিতে পারে বাহিরের কোনো শক্তি। মে মাসের যুদ্ধের পর থেকে এই ঝুঁকি রয়েই গেল।

মহসীন হাবিব: সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ