নির্বাচন পরবর্তী পাকিস্তান
৮ তারিখ পাকিস্তানের জাতীয় এবং প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসেনি। কবে এবং কতটা আসবে তাও অনিশ্চিত। হয়তো একটি সরকার অতি দ্রুতই গঠন হয়ে যাবে। পাকিস্তানে নওয়াজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ নওয়াজ বা পিএমএলএন এবং বিলাওয়াল ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি বা পিপিপি দফায় দফায় আলোচনার পর একটি কোয়ালিশন সরকার গঠনে সম্মত হয়েছে, যদিও কীভাবে তা এখনো পরিষ্কার হয়নি। সেই অনুযায়ী নওয়াজ শরিফই প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন বলে মনে হয়।
অন্যদিকে অসন্তোষ ও আন্দোলনে থাকা সত্ত্বেও ইমরান খানের পাকিস্তান তেহেরিক-ই-ইনসাফ বা পিটিআই অফিসিয়ালি নির্বাচন করতে না পারলেও তাদের স্বতন্ত্র বিজয়ীদের নিয়ে পার্লামেন্টে যাচ্ছে বলে পিটিআইর বর্তমান প্রধান ব্যারিস্টার গহর আলী খান জানিয়েছেন। তাদের এই পার্লামেন্টে যাওয়ার উদ্দেশ্য পরিষ্কার। যে ৯৩ জন পিটিআই সমর্থিত বিজয়ী মেম্বারসহ ১০২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন, তারা হিস্যা অনুযায়ী সংরক্ষিত আসন পাবেন। পাকিস্তানে রয়েছে ৬০টি সংরক্ষিত নারী আসন এবং ১০টি সংখ্যালঘু আসন। এই ৭০টি মধ্যে পিটিআই তথা স্বতন্ত্রদের আনুপাতিক হারে সর্বাধিক আসন পাওয়ার কথা। অন্যদিকে তারা পার্লামেন্টে নিয়মাতান্ত্রিক আন্দোলন করবেন ইমরান খানসহ দলের বন্দি নেতাদের মুক্ত করতে। তবে পিটিআই একই সঙ্গে আন্দোলনে রাস্তায় আছে। বিশেষ করে খাইবার পাখতুনখা, পাঞ্জাব ও কেন্দ্রে তারা দাবী করছেন, পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এগিয়ে থাকার পরও শেষ অবধি তাদের প্রশাসনের মাধ্যমে ফলাফল পাল্টে দেওয়া হয়েছে। পিটিআই তথা স্বতন্ত্ররা সবচেয়ে বেশি আসন জিতেছে খাইবার পাখতুনখাওয়া এবং পাঞ্জাবে।
আসন সংখ্যার দিক দিয়ে তৃতীয় হলেও বিলাওয়াল-জারদারির নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি ট্রায়াম্প কার্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনোরকম সিম্পল মেজরিটি নিয়ে সরকার গঠন করতে ১৩৪টি ভোটের প্রয়োজন। ফলে পিপিপির ৫৪টি আসন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। উল্লেখ্য, ইমরান খানের দলের সমর্থিত স্বতন্ত্র এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগ নওয়াজের আসনসংখ্যা যথাক্রমে ৯২ এবং ৭৫টি। দেশটির রাজনীতিতে এখন প্রধান বৈরিতা পিএমএলএন এবং পিটিআইর মধ্যে। তাদের মধ্যে ঐকমত্য হওয়া কোনোক্রমেই সম্ভব না। এদিকে বেনজির ভুট্টোর স্বামী এবং বিলাওয়াল ভুট্টোর পিতা আসিফ আলি জারদারি ইমরানের স্বতন্ত্রদের সঙ্গে কোনোক্রমেই জোট করে সরকার গঠন করবেন না। কারণ তাতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং ক্ষমতার পেছনের ক্ষমতার বিরাগভাজন হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। তাছাড়া নিকট অতীতে পিএমএলএন এবং পিপিপি একসঙ্গে সরকার গঠন করে ১৬ মাস দেশ চালিয়েছে। নওয়াজ শরিফের ভাই ও পাঞ্জাবের সাবেক চিফ মিনিস্টার শেহবাজ ছিলেন সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং বিলাওয়াল ভুট্টো পররাষ্ট্রমন্ত্রী। পিপিপি এবার চাইছেন বড় শেয়ার। যদিও পানি কোন দিক গড়ায় এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, ধারণা করা যায় মাত্র। পাকিস্তানের চতুর্থ বৃহৎ দল মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট বা এমকিউএম পেয়েছে ১৭টি আসন। তারা পূর্ব থেকেই নওয়াজ শরিফকে সমর্থন দিয়ে আছে। এমকিউএম তাদের ফেয়ারশেয়ার চাইছে। ইতোপূর্বে নওয়াজ শরিফ নির্বাচনের পরপরই বলেছিলেন তিনি একটি ঐকমত্যের জাতীয় সরকার গঠন করতে চান।
নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রেসিডেন্ট সংসদ অধিবেশন আহ্বান করবেন। সেই সংসদে নতুন স্পিকার নির্বাচিত হবেন। এবং নতুন স্পিকার সংসদ নেতা, অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের জন্য আহ্বান জানাবেন। এই সময় প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সংরক্ষিত আসনসহ সর্বমোট ৩৩৬টি আসনের মধ্যে ১৬৯ আসনের ভোটের প্রয়োজন হবে সিম্পল মেজরিটির জন্য। যদি কোনো প্রার্থী এই মেজরিটি না পায়, তাহলে আবার ভোট করতে হবে। যদি তাতেও না হয়, তাহলে আবার- যতক্ষণ পর্যন্ত একজন প্রধানমন্ত্রী না পাওয়া যায়। ফলে এই সময় ব্যাপক রাজনৈতিক পালাবদল চলতে থাকে। কে কার সঙ্গে হাত মেলাবে, কে কোন পক্ষে যাবে, তার কোনা ঠিক ঠিকানা থাকে না, বিশেষ করে ছোট দল থেকে অনেক সংসদ সদস্য এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে।
অবশ্যই পাকিস্তানের নির্বাচন উপমহাদেশের আঞ্চলিক রাজনীতির জন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান অসিম মুনির ঠিক কথাই বলেছেন যে পাকিস্তানে প্রয়োজন স্থিতিশীল নেতা। পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে অম্লমধুর সম্পর্ক চলমান। দুটি পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হলে তা মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। এক্ষেত্রে নওয়াজ শরিফ প্রধানমন্ত্রী হলে পাকিস্তানের সঙ্গে একটি শান্তি ও সমঝোতার পথ বের হতে পারে। শরিফ বরাবরই ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে বিশ্বাসী। অন্তত বৈরিতা বাড়ার সম্ভাবনা থাকবে কম।
অন্যদিকে মার্কিন সেনারা ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে চলে যাওয়ার পর তালিবানরা দেশটির ক্ষমতা দখল করে। যুক্তরাষ্ট্রই তাদের হাতে তুলে দিয়ে যায়। সেই থেকে পাকিস্তানে তেহেরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান বা টিটিপি আক্রমণ জোরদার করেছে। আফগান শরণার্থীদের ‘অবৈধ বিদেশি’ আখ্যায়িত করে তাদেরকে আফগানিস্তানে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পাকিস্তান। এতে আফগানরা আরও ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। এখন পাকিস্তানে প্রায়ই তারা হামলা চালায় এবং পাকিস্তান সীমান্তে মাঝে মাঝেই সংঘর্ষে জড়িয়ে পরে। এই সমস্যা নওয়াজ শরিফ ক্ষমতায় এলে হয়তো খানিকটা কমতে পারে।
চিনের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক বহুকালের। কিন্তু সম্প্রতি দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক খানিকটা শীতল হয়েছে। সম্প্রতি চিনের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ চায়না পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। পাকিস্তানের মোট ঋণের এক-তৃতীয়াংশ চীনের কাছে। এই অবস্থায় চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করে তোলা পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর একটি বড় কাজ হয়ে উঠবে। পিপিপির বিলাওয়াল ভুট্টোর সে দক্ষতা ও সম্পর্ক নেই, যদিও তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।
পাকিস্তানের সঙ্গে বরাবরই আরব দেশগুলোর সুসম্পর্ক ছিল। ছিল বলছি এই কারণে যে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। পাকিস্তানের আর্থিক সহায়তার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব ও কাতার ছিল প্রধান উৎস। এখন কাতার সৌদির সম্পর্কে শীতলতা রয়েছে। পাকিস্তানের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এই দেশ দুটির কাউকেই অস্বীকার করা জো নেই। সেক্ষেত্রে নওয়াজ শরিফ কিছুটা দুপক্ষের সঙ্গে উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবেন। তা ছাড়া সৌদি-ইরানের চরম বৈরিতাও পাকিস্তানের জন্য একটি বড় বিব্রতকর বিষয়।
আবার এ কথাও ঠিক, পাকিস্তানে শরিফ প্রধানমন্ত্রী হলে ইসলামিস্ট সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো জেগে উঠতে পারে। কারণ, অধিকাংশ চরমপন্থি ও ইসলামি মৌলবাদীর সমর্থন রয়েছে ইমরান খানের দিকে। তবে পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে দেশটির ডুবতে থাকা অর্থনৈতিক অবস্থা পুনরুদ্ধার করা। যত বড় ক্যারিশম্যাটিক নেতাই হোক, অর্থনৈতিক অবস্থা দ্রুত পুনরূদ্ধার করতে না পারলে ক্ষমতায় টিকে থাকা কঠিন হবে। এমনকি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতেও হতে পারে। সোমবার পাকিস্তানের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ আতিফ মিয়াঁ বলেছেন, ‘পাকিস্তানের বর্তমান নেতারা ক্ষমতায় এসে যদি রাতারাতি জাদুকরী কোনো ফলাফলও বয়ে আনেন, তথাপি মানুষ তাদের বিশ্বাস করবে না। এই নেতারা এখন নিজভূমিতেই বিদেশির মতো হয়ে গেছেন। প্রিন্সটাউন ইউনিভার্সিটির এই অধ্যাপক বলেছেন, ‘পাকিস্তানের পরিস্থিতি এমন যে বৈদেশিক ঋণ ছাড়া একজন অফিস পিয়নের বেতন শোধ করার সামর্থ্য নেই।’
বিগত তিন বছরে পাকিস্তানে ১৬০০, অর্থাৎ দেশের এক-তৃতীয়াংশ টেক্সটাইল মিল বন্ধ হয়ে গেছে। টেক্সটাইল পাকিস্তানের মোট বৈদেশিক রপ্তানির ৬০ শতাংশ অবদান রাখে। মুদ্রাস্ফীতির হার এখন ২৯ শতাংশ। লাখ লাখ পাকিস্তানি এখন জানে না, পরদিন মুখে খাবার তুলতে পারবে কি না। এমন একটি পরিস্থিতিতে জাতি হিসেবে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়েই শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সুতরাং যিনিই ক্ষমতায় আসুন, তার জন্য কোনো সুখ সংবাদ অপেক্ষা করেনি। এরপর রয়েছে সেনাবাহিনীর চাওয়া পাওয়া। আশা করা যায়, আর দু-চার দিনের মধ্যেই কে প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন, তা পরিষ্কার হবে। যিনিই আসুন তাকে প্রথমেই আইএমএফের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে ঋণের অর্থ ছাড় দেয়ার জন্য। চীনের দরজায় যেতে হবে ঋণজনিত জটিলতা সমাধানের জন্য। মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকাতে হবে সহায়তার জন্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ধরনা দিতে হবে কূটনৈতিক অবস্থা তৈরির জন্য। মোটকথা যিনি ক্ষমতায় আসবেন তাকে একসঙ্গে আগুন, সাপ, কুমির, বাঘের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে