Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

রাইসির মৃত্যুতে কোন পথে ইরান

Hira  Talukder

হিরা তালুকদার

সোমবার, ২০ মে ২০২৪

হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট এব্রাহিম রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আব্দোল্লাহিয়ান নিহত হয়েছেন। রোববারের (২০ মে) এ দুর্ঘটনায় তাদের নিহত হবার বিষয়টি সোমবার নিশ্চিত করে ইরানি কর্তৃপক্ষ।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ রাইসি পরিচিত ছিলেন একজন কট্টরপন্থী ধর্মীয় নেতা হিসেবে। এ কারণে তিনি সরকারবিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভের মুখেও পড়েছেন। ৬৩ বছর বয়সী রাইসি ২০২১ সালে দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে দেশটির মরালিটি বা নৈতিকতাবিষয়ক আইন কঠোর করার নির্দেশ দেন। এই নির্বাচনে প্রভাবশালী মধ্যপন্থী ও সংস্কারপন্থী অনেক প্রার্থীকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং ওই নির্বাচনে ভোট দেননি দেশটির বেশিরভাগ ভোটার। অর্থাৎ তিনি সে অর্থে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির মতো জনপ্রিয় বা ক্ষমতাধর কোনো নেতা ছিলেন না।

যদিও অনেকেই মনে করেন, তিনি খামেনির উত্তরসূরি হওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করছিলেন। এমনকি দেশটির ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) বা দেশটির বিভিন্ন সেনা কর্মকর্তা সারা বিশ্বে যতটা আলোচিত রাইসি রাষ্ট্রপতি হয়েও এমন আলোচিত ছিলেন না। তাই তার মৃত্যুতে ইরান সর্বোস্ব খুঁইয়েছে বা বড় ধরনের সংকটের মধ্যে পড়তে চলেছে তেমনটা মনে হচ্ছে না। কারণ দেশটির পররাষ্ট্রনীতি ও যুদ্ধবিষয়ক ব্যাপারগুলোতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির কাছ থেকে। বর্তমানে বিশ্বের অনেক নেতা আছেন, যারা তাদের দেশে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী বা ওয়ানম্যান শো রাষ্ট্রপ্রধান। যেমন রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন, উত্তর কোরিয়ার কিম জং উন কিংবা চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ওয়ানম্যান শো এসব রাষ্ট্রপ্রধান মারা গেলে সে দেশ যেভাবে ভয়াবহ সংকটের মধ্যে পড়বে, ইরানের ক্ষেত্রে তেমনটা হবে না।

দেশটিতে কোনো রাষ্ট্রপতি মারা গেলে একটি প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে দ্রুতই একজন তার স্থলাভিসিক্ত হন। সেক্ষেত্রে অনুমোদন লাগে দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির। এবারও সেটাই হয়েছে। সোমবার ইরানের নতুন অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবেরের নাম ঘোষণা করেছেন দেশটির সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। সেইসঙ্গে প্রেসিডেন্ট রাইসির নিহতের ঘটনায় ৫ দিনের রাষ্ট্রীয় শোকও ঘোষণা করেছেন তিনি। ইরানের সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্টের অনুপস্থিতি বা অবর্তমানে দেশটির অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে আসেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। রোববার হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রেসিডেন্ট রাইসি নিহত হওয়ার পর সংবিধান অনুযায়ী তাই দেশটির অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন রাইসির নেতৃত্বাধীন সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবের। সাংবিধানিক বিধি অনুসারে ইরানে এখন তিন সদস্যের একটি কাউন্সিল গঠন করা হবে; সেই কাউন্সিলের প্রধান হবেন মোহাম্মদ মোখবের।

কাউন্সিলের অন্য দুই সদস্য হলেন ইরানের পার্লামেন্টের স্পিকার এবং বিচার বিভাগের প্রধান। এই তিন সদস্যবিশিষ্ট পরিষদের প্রধান দায়িত্ব থাকবে আগামী ৫০ দিনের মধ্যে দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আয়োজন করা। তবে এবার ইরানের প্রেসিডেন্ট মারা যাওয়ার ঘটনাটা অন্যরকম ও সারা বিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কারণ তিনি এমন একটি সময়ে দুর্ঘটনায় মারা গেলেন, যখন মধ্যপ্রাচ্য ইসরায়েল ও গাজা ইস্যুতে উত্তপ্ত। এমনকি সম্প্রতি ইতিহাসে নজিরবিহীন ইরান থেকে ইসরায়েলে শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালানো হয়েছিল। ইরান দ্রুতই ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করে পারমাণবিক বোমা তৈরি করে ফেলছে বলে সতর্ক করেছেন মার্কিন গবেষকরা। যুদ্ধের সাজ সাজ রব ইরানসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্যে। ইরান সমর্থিত (প্রক্সি) যোদ্ধারা যেমন- লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি, ফিলিস্তিনের হামাস এবং ইরাক ও সিরিয়ার বিভিন্ন মিলিশিয়ারা যে কোনো সময়ের তুলনায় ভীষণ সক্রিয়। এ পরিস্থিতিতে যে কারণেই হোক খোদ ইরানের প্রেসিডেন্টের এ সময়েই দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার ঘটনা অনেকের কাছেই অবাক করার বিষয় কিংবা কাকতালীয় অথবা নাশকতার অংশ বলে ধারণা হওয়াটাই স্বভাবিক। তবে এতে ইরানের শক্তিমত্তা, পারমাণবিক কর্মসূচি ও রাষ্ট্রপরিচালনায় তেমন কোনো সমস্যার সৃষ্টি হবে না বলেই ধারণা করা যাচ্ছে।

কে ছিলেন এব্রাহিম রাইসি
ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মাশহাদে ১৯৬০ সালে জন্মগ্রহণ করা রাইসি রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেকটি অংশে রক্ষণশীলদের নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করেছিলেন। রাইসির ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। তার স্ত্রী জামিলে তেহরানের শহীদ বেহেস্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা এবং তাদের দুটি সন্তান আছে। তার শ্বশুর আয়াতুল্লাহ আহমাদ আলামোলহোদা। তিনিও একজন কট্টরপন্থি ধর্মীয় নেতা এবং মাশহাদ শহরে জুমার নামাজ পরিচালনা করেন। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারান তিনি। এব্রাহিম রাইসির বাবাও ধর্মগুরু ছিলেন। শিয়া ধর্মীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী ইসলামের নবীর বংশধরদের মতো কালো পাগড়ি পরতে দেখা যেত তাকে। বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ১৫ বছর বয়সে কুম শহরে এক শিয়া মাদ্রাসায় যোগ দেন রাইসি। আন্তর্জাতিক আইনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।

শহীদ মোতাহারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেসরকারি আইনে বিশেষীকরণসহ আইনশাস্ত্র এবং আইনের মৌলিক বিষয়ে পিএইচডি লাভ করেন। সেখানে শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় তিনি পশ্চিমা সমর্থিত শাহর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশ নেন। ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লা খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে শাহর শাসনের পতন ঘটে। ছাত্র অবস্থা থেকেই তাকে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যেতে থাকে। পশ্চিমা সমর্থিত শাহের বিরুদ্ধে বিক্ষোভেও যুক্ত ছিলেন তিনি। ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর বিচার বিভাগে যোগ দেন তিনি। আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির কাছে প্রশিক্ষণের সময় বেশ কয়েকটি শহরে প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেখান থেকে এক পর্যায়ে বিচার বিভাগের প্রধান ও পরে রাষ্ট্র প্রধান হন তিনি।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ