সক্ষমতার চেয়ে কম উৎপাদন হচ্ছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে
দেশে ২৬ হাজার ৩৬৪ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে গত ৩০ এপ্রিল দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। এর বাইরে সাধারণত ১০ থেকে ১২ হাজার মেগাওয়াট এবং রাতেরবেলা ১৪ থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। অর্থাৎ সর্বোচ্চ উৎপাদনের দিন বিবেচনা করলেও প্রতিদিন বসে থাকছে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ ভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন না করেই বসে থাকছে। এখন প্রশ্ন উঠছে এত বিদ্যুৎকেন্দ্রর কি আসলেই খুব দরকার ছিল!
এখনো নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। শুধু কেন্দ্রই নির্মাণ করা হচ্ছে না দেশের বাইরে থেকেও বিদ্যুৎ আনার চেষ্টা করা হচ্ছে; কিন্তু কেন? অবশ্যই সরকারের কাছে এর যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা আছে। তবে সেই ব্যাখ্যা যদি কেবল ব্যয় বৃদ্ধি আর ডলার খরচের কারণ হয়, তাহলে ভেবে চিন্তে অগ্রসর হওয়া উচিত।
বিদেশ থেকে যে বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়, তার মূল্য সরাসরি ডলারে পরিশোধ করতে হয়। এর বাইরে জ্বালানি আমদানি ব্যয় মেটাতে হয় ডলারে। সরকার দেশের মধ্যে নতুন নতুন যে গ্যাস বা কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে তার জন্য জ্বালনি ব্যয় মেটানো দিনের পর দিন কঠিন হয়ে উঠছে। এরপরও কেন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। সরকার ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে; কিন্তু এই বিদ্যুৎ এত বিদ্যুতের ব্যবহার নিশ্চিত করা কি সম্ভব হবে।
আমরা যদি ২০০৯ সালে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সরবরাহর দিকে লক্ষ্য করি, তাহলে দেখা যাবে দেশে তখন ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো। প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং করা হতো। অর্থাৎ বিদ্যুতের নিট চাহিদা ছিল ৮ হাজার মেগাওয়াট। এবার যদি এ বছরের গ্রীষ্মের সর্বোচ্চ চাহিদা বিবেচনা করি তাহলে দেখা যাবে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট উৎপাদনের দিনও দেশে অন্তত দেড় থেকে ২ হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং ছিল। অর্থাৎ গত ১৫ বছরে বিদ্যুতের নিট চাহিদা দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। অর্থাৎ এই ১৫ বছরে দেশে বিদ্যুতের নতুন চাহিদা তৈরি হয়েছে ১০ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। যদি গড় হিসেব করা হয়, তাহলে প্রতি বছর নতুন চাহিদা তৈরি হয়েছে প্রায় ৭০০ মেগাওয়াট। যদিও বিদ্যুতের হিসেব এমন সরল অঙ্কে করার কোনো সুযোগ নেই।
এরপরও সরকার বলছে প্রতি বছর অন্তত ১০ ভাগ হারে নতুন বিদ্যুতের চাহিদা তৈরি হয়। নতুন বাসাবাড়ি, কলকারখানা এবং শিল্পে বিদ্যুতের চাহিদার কারণে এই পরিমাণ উৎপাদন বৃদ্ধি করা জরুরি; কিন্তু এরমধ্যে সরকার প্রায় শতভাগ এলাকায় গ্রিডের বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে। এই কাজটি ২০২০ সালেই শেষ হয়েছে অর্থাৎ আগামীতে নতুন করে আবাসিকে চাহিদা খুব একটা বাড়বে না। এর বাইরে রয়েছে শিল্প কারখানা; কিন্তু সেখানেও নতুন চাহিদা তৈরি করা কঠিন। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে গ্রিডের বিদ্যুতের ওপর শিল্প মালিকদের আস্থা কম। সব জায়গাতেই শিল্প মালিকরা নিজেদের উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে শিল্প চালাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তবে এটি তাদের দোষ না। আমাদের গ্রিডের বিদ্যুৎ শিল্পবান্ধব নয়। এক দিকে গ্রিডের বিদ্যুৎ মানেই ভয়াবহ লোডশেডিং অন্যদিকে গ্রিডের বিদ্যুতের দামও তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। এ জন্য বড় শিল্প মালিকরা পেট্রোবাংলার কাছ থেকে গ্যাস নিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সেই বিদ্যুৎ দিয়ে শিল্প কারখানা চালিয়ে আসছে। তাহলে নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র কি বসে থাকবে। এ নিয়ে শিল্প মালিকদের সঙ্গে সরকার একাধিকবার আলোচনায় বসলেও ফলপ্রসু কোন কিছু করা সম্ভব হয়নি। কোনো বিদ্যুৎ বিরতরণ কোম্পানিই শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে স্বক্ষম হয়নি। এতে করে দেশে শিল্পের বিদ্যুৎ ব্যবহার আশানুরূপ বৃদ্ধি পায়নি।
বিদুৎ উৎপাদন অঞ্চলের দিকে তাকালে দেখা যায় ঢাকা অঞ্চলে ৩৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। সব শেষ ইউনিক মেঘনাঘাট ৫৮৪ মেগাওয়াট এবং সামিট পাওয়ারের ৫৮৯ মেগাওয়াট দুটি বড় গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে। ঢাকার ৩৬ বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ১৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাসচালিত। বাকি ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র ফার্নেস অয়েলে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র সৌর বিদ্যুতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। বাকি ১৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। কেন্দ্রগুলোর মধ্যে চারটি ভাড়ায়চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল। যেগুলোর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নো ইলেক্ট্রিসিটি নো পেমেন্ট অর্থাৎ বিদ্যুৎ কেনা হলে টাকা পাবে না এই শর্তে রেখে দেয়া হয়েছে। তবে মজার বিষয় হচ্ছে এসব কেন্দ্র কোন কোনটি আগে বছরে ১০ ভাগ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে (উৎপাদন ক্ষমতা) চলতো না এখন সেখান থেকে বাধ্যতামূলকভাবে ২০ ভাগ বিদ্যুৎ কেনার শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন সিস্টেমে বাড়তি ব্যয়ের খাত সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে।
ঢাকা বিভাগে এমন বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ৪০০ মেগাওয়াট। এই চিত্র কেবল ঢাকা অঞ্চলে না সব অঞ্চলেই কম বেশি একটি দুটি করে রেখে দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম এলাকায় ২৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে যেখানে ১০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট অপশনে রেখে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া কুমিল্লা অঞ্চলে ৫৫ মেগাওয়াটের একটি, ময়মনসিংহে ৫০ মেগাওাটের একটি, খুলনায় ১৫৫ মেগাওয়াটের দুটি, বরিশালে ৩৩ মেগাওয়াটের একটি এবং রাজশাহীতে ৫০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে।
সারা দেশে যেখানে গড়ে অর্ধেক বিদ্যুৎকেন্দ্র বসেই থাকে সেখানে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র সিস্টেমে রেখে দেয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও পিডিবে এতে কোনো পাত্তা দিচ্ছে না। এতে প্রতি বছর সরকারের বিপুল পরিমাণ লোকশান গুনতে হচ্ছে। পিডিবির হিসেব অনুযায়ী গত অর্থ বছরে তাদের ভর্তুকি প্রয়োজন হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। অর্থ বিভাগ থেকে পিডিবিকে এই ভর্তুকি ঋণ হিসেবে দেয়া হলেও পিডিবি কোনো দিনই এই ঋণ পরিশোধ করে না। অর্থাৎ এটি সরকারের বড় রকমের একটি লোকশান। এ জন্য পিডিবিকে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের আগেই এর প্রয়োজনীয়তা নিরূপণ করতে হবে। অন্যথায় বসে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পেছনে অর্থ ঢালতে গিয়ে বিপুল লোকশানের মুখে পড়বে রাষ্ট্র।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে