বিচারিক আদালতে স্থবিরতা
নিরাপত্তাহীনতায় পিপি-জিপিরা, আসছেন না শুনানিতে!
শেখ হাসিনা সরকার পতনের দুমাস পার হলেও ঢাকার বিচারিক আদালতগুলোতে শুনানিতে অংশগ্রহণ করছেন না ওই সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া পাঁচ শতাধিক পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এবং গভর্নমেন্ট প্লিডাররা (জিপি)। ফলে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, মহানগর দায়রা জজসহ ঢাকার সব বিচারিক আদালতের বিচারিক কার্যক্রমে।
বেশ কয়েকজন পিপি ভিউজ বাংলাদেশকে বলেছেন, ‘নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে আমাদের নিয়োগ থাকবে কি না, তা নিয়ে নিশ্চয়তা না থাকায় আমরা শুনানিতে যাচ্ছি না’।তবে তারা নিজ নিজ চেম্বারে নিয়মিতভাবেই উপস্থিত থাকছেন। তারা দাবি করেন যে, আদালত কক্ষে যেন অপ্রীতিকর কোন ঘটনা না ঘটে সেজন্যই তারা শুনানিতে আসছেন না।
এ ছাড়াও অনেকেই ভাবছেন, তাদের নিয়োগ বিষয়ে আদেশ যে কোনো মুহূর্তে আসতে পারে। এই অবস্থায় তারা কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাচ্ছেন না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোনো কোনো পদে আগের সরকারের নিয়োগ বাতিল করলেও সেসব পদে নতুন নিয়োগ দেয়নি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গত ১৫ বছর ধরে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান সরকারি কৌঁসুলি বা পিপির দায়িত্ব পালন করেন আবদুল্লাহ আবু।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকেই আদালতে আসছেন না তিনি। পরে গত ২৮ আগস্ট তার নিয়োগ বাতিল করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ওই দিনই আইন মন্ত্রণালয় ওই পদে নিয়োগ দেন সিনিয়র আইনজীবী এহসানুল হক সমাজীকে। তবে নিয়োগ পাওয়ার দুদিনের মাথায় ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে দায়িত্ব নিতে অপারগতা জানান তিনি। গত ২৯ আগস্ট আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর অনুবিভাগে (জিপি-পিপি শাখা) আপত্তি জানিয়ে চিঠি পাঠিয়ে দেন। সমাজী তার চিঠিতে উল্লেখ করেন, তিনি সততা ও নিয়মানুবর্তিতার সঙ্গে গত ৩৮ বছর ধরে আইন পেশায় যুক্ত আছেন; কিন্তু ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণে তিনি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি হিসেবে যোগ দিতে পারছেন না।
তিনি বলেন, ‘আমাকে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি হিসেবে নিয়োগ দেয়ায় আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতি আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। তবে আমি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণে এই পদে কাজ করতে অপারগ।’ পরে আর যোগদানই করেননি এহসানুল হক সমাজী। ফলে পদটি শূন্য রয়েছে। এতে গুরুত্বপূর্ণ ফৌজদারি বা দেওয়ানি মামলার বিচারে এখন হ-য-ব-র-ল অবস্থা। শুনানির দিনও শুধুই পেছাচ্ছে।
একটি ফৌজদারি মামলার আসামি আশুলিয়ার তোফাজ্জল হোসেন। বর্তমানে আছেন কারাগারে। গত ১২ আগস্ট তার জামিনের আবেদন জানানো হয় ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে। রাষ্ট্রপক্ষের কোনো আইনজীবীই (পিপি বা জিপি) ওইদিন হাজির না থাকায় শুনানির দিন পিছিয়ে দেন আদালত। তখন থেকে গত ৪ অক্টোবর পর্যন্ত তোফাজ্জলের জামিনের আবেদনটি তিনবার আদালতে উঠলেও শুনানি হয়নি। কারণ, গত দুমাস ধরে ঢাকার বিচারিক আদালতগুলোতে শুনানিতে আসছেন না রাষ্ট্রপক্ষের কোনো আইনজীবীই।
ঢাকা আইনজীবী সমিতি সূত্র জানায়, ঢাকায় শতাধিক বিচারিক বা নিম্ন আদালত আছে। এসব আদালতে সরকারি কৌঁসুলিরা তাদের নিয়মিত দায়িত্ব পালন করা থেকে বিরত আছেন।একদিকে তাদের বদলির আদেশ হচ্ছে না, অন্যদিকে তাদের স্থলে নতুন পিপি-জিপিও নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। যদিও এই সময়ের মধ্যে গত ২৬ সেপ্টেম্বর প্রশ্নপ্রত্র ফাঁসের আলোচিত একটি মামলায় রায় দেন ঢাকার সিএমএম আদালত। এতে ১০ জনের সাজা হয়, খালাস পান ১১৪ জন। রাষ্ট্রপক্ষে মামলাটি পরিচালনাকারী সরকারি কৌঁসুলি রায় ঘোষণার দিন আদালত কক্ষেই ছিলেন না।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) চেয়ারপারসন ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী না থাকায় ঢাকার বিচারিক আদালতে মামলার কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব দক্ষ ও যোগ্য আইনজীবীদের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপক্ষের নতুন আইনজীবী (পিপি-জিপি) নিয়োগ করা দরকার। নইলে মামলাজট আরও তীব্র হবে।’
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী পারভিন সুলতানা ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, দেশের মহানগর ও জেলার বিচারিক আদালতে রাষ্ট্রের হয়ে ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করেন পিপিরা আর দেওয়ানি আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা লড়েন জিপিরা। সরকার পতনের দুই মাস পার হলেও ঢাকার নিম্ন আদালতগুলোতে নতুন সরকারি আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়নি। গত ৫ আগস্টের পরে আদালতগুলোতে আসছেন না পুরোনো পাঁচ শতাধিক পিপি ও জিপির কেউই। ফলে আমাদের বিভিন্ন মামলা থমকে আছে। আদালত শুধু সময় পিছিয়ে দিচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে তো প্রধান সরকারি কৌঁসুলিই (পিপি) নেই, যা মামলার শুনানিতে চরম সমস্যা তৈরি করছে। এই সমস্যার দ্রুত সমাধান হওয়া দরকার।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য আইনজীবী জাহাঙ্গীর হোসেন ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘যে কোনো মামলায় দুটি পক্ষ থাকেন, বাদীপক্ষ ও বিবাদীপক্ষ। বাদীপক্ষ থেকে মামলা পরিচালনায় সহায়তা করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা (পিপি ও জিপি)। কিছু মামলায় বাদীপক্ষে শুধু রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী থাকেন; কিন্তু গত ৫ আগস্টের পর থেকে রাষ্ট্রপক্ষের কোনো আইনজীবীই ঢাকার কোনো আদালতে থাকছেন না। এমনটি হলে রাষ্ট্রের পক্ষে কথা বলবেন কে? তাই মামলার শুনানিও থমকে আছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা, অন্যদিকে বেড়েই চলেছে মামলাজট। এই ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা কঠিন হবে।’
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘নতুন পিপি ও জিপি নিয়োগে সম্ভাব্য আইনজীবীদের তালিকা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন। শিগগিরই নিয়োগের প্রজ্ঞাপন হবে বলে জানতে পেরেছি। আমরাও অপেক্ষায় আছি।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে