বিদায় প্রবীর মিত্র: ক্রিকেটার থেকে চলচ্চিত্রের ‘রঙিন নবাব’
কিংবদন্তি চলচ্চিত্র অভিনেতা প্রবীর মিত্র বলতেন, ‘অভিনয় আমার প্রেম, ধ্যান-জ্ঞান-ভালোবাসা। অভিনয় আমার সবকিছু।’ এই সবকিছু ছেড়ে চলে গেলেন বাংলা চলচ্চিত্রের ‘রঙিন নবাব’খ্যাত প্রবীর মিত্র। রঙিন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা সিনেমায় তিনি নবাবের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। এদেশে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে নিয়ে দুটি সিনেমা নির্মিত হয়েছিল। একটিতে অভিনয় করেছিলেন প্রয়াত আনোয়ার হোসেন। সেটি ছিল সাদাকালো এবং প্রথম নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা।
অনেক পরে এসে নির্মিত হয়েছিল রঙিন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, যেখানে প্রবীর মিত্র অভিনয় করেন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা চরিত্রে। হৃত্বিক ঘটকের বহুল প্রশংসিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ সিনেমায় অভিনয় প্রবীর মিত্রর ক্যারিয়ারে মাইলফলক হয়ে আছে। এই সিনেমাটি তাকে দিয়েছে অন্যরকম খ্যাতি। প্রবীর মিত্র বলতেন, ‘তিতাস একটি নদীর নাম সিনেমাটি ছিল স্বপ্নের মতো। না চাইতেও বড় কিছু পাওয়ার মতো।’
১৯৬৯ সালে প্রয়াত এইচ আকবরের ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য প্রথম প্রবীর মিত্র ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান। যদিও চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ১৯৭১ সালের ১ জানুয়ারি। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে প্রবীর মিত্র ‘নায়ক’ হিসেবে কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। এরপর চরিত্রাভিনেতা হিসেবে কাজ করেও তিনি পেয়েছেন দর্শকপ্রিয়তা।
স্কুলজীবনে রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর নাটকে অভিনয় করেন। সেই যে শুরু হলো- অভিনয় চলতেই থাকে। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘জীবন তৃষ্ণা’, ‘সেয়ানা’, ‘জালিয়াত’, ‘ফরিয়াদ’, ‘রক্ত শপথ’, ‘চরিত্রহীন’, ‘জয় পরাজয়’, ‘অঙ্গার’, ‘মিন্টু আমার নাম’, ‘ফকির মজনু শাহ’, ‘মধুমিতা’, ‘অশান্ত ঢেউ’, ‘অলংকার’, ‘অনুরাগ’, ‘প্রতিজ্ঞা’, ‘তরুলতা’, ‘গাঁয়ের ছেলে’, ‘পুত্রবধূ’সহ চার শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি।
চলচ্চিত্র অভিনেতা প্রবীর মিত্র একসময় ক্রিকেট খেলেছেন ঢাকা ফার্স্ট ডিভিশনে। হকিও খেলেছেন। এ বিষয়ে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'অভিনেতা হবো কখনো ভাবিনি। খেলতে খেলতে জীবন পার করতে চেয়েছিলাম। হঠাৎ অভিনয়টা চুম্বকের মতো টেনে ধরলো। তারপর থেকে অভিনেতাই হয়ে গেলাম।’
নান্দনিক ও রুচিসম্মত অভিনয়ের জন্য প্রবীর মিত্র বরাবরই দর্শকদের প্রশংসা পেয়েছেন; কিন্তু দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তার পুরস্কারের সংখ্যা খুবই কম। ১৯৮২ সালে বড় ভালো লোক ছিল’ সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্রে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন কেবল। এরপর ২০১৮ সালে আজীবন সম্মাননা বিভাগে তাকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান করা হয়।
গত ৫ বছর হাঁটুর ব্যথার কারণে নিজ বাসায় তার দিনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে টিভি দেখে। ঘরবন্দি থাকলেও মন পড়ে থাকে বিএফডিসি ও শুটিংয়ে। প্রবীর মিত্রের ছেলে মিথুন মিত্র জানান, তার বাবার শ্রবণশক্তি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছিল। সে কারণে তিনি ঠিকমতো কানে শুনতে পাননি। উচ্চ স্বরে কথা বললে উত্তর দিতে পারতেন। তবে তিনি ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করতেন।
প্রবীর মিত্র গত বছর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, মনে হয় হাজার বছর অভিনয় করি না। খুব মন চায় অভিনয় করি। বিএফডিসিতে যাই, আবার আড্ডা দিই পরিচিত মানুষজনের সঙ্গে। বিএফডিসি যাওয়ার জন্য আমার মন ছটফট করে। আমার স্ত্রী বেঁচে নেই প্রায় ২০ বছর। তার না থাকাও খুব মিস করি।’ এখন থেকে বাংলার রঙিন নবাব প্রবীর মিত্রকেও মিস করবে দেশের চলচ্চিত্রপ্রেমীরা।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে