সংস্কার থেকে বেশি যৌক্তিক চলমান খেলার চর্চা
ক্রীড়াঙ্গনে পরিবর্তনের স্বপক্ষে মানুষ এখন সোচ্চার- কারণ হলো কমবেশি সচেতনতা বেড়েছে। মানুষ বুঝতে পারছে ক্রীড়াঙ্গন যেভাবে চলা উচিত ছিল গত পাঁচ যুগেও সেভাবে চলেনি। আর তাই জাতির প্রত্যাশিত ক্রীড়াঙ্গন স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে। স্বাধীনতার পর নতুন দেশে আকাঙ্ক্ষা ও অঙ্গীকার নিয়ে ক্রীড়াঙ্গনের যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেই ক্রীড়াঙ্গনে এখনো আস্থা ও বিশ্বাসের সংকটে ভুগছে। বারবার বিভিন্নভাবে হোঁচট খাচ্ছে। এক ধরনের অনিশ্চয়তা এবং অস্থিতিশীলতা থেকে ক্রীড়াঙ্গন মুক্তি পায়নি। মুখের সুন্দর সুন্দর কথা, আশ্বাস আর তথাকথিত লোক দেখানো উদ্যোগ ক্রীড়াঙ্গনকে সঠিক পথ দেখাতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন বাস্তবধর্মী সমষ্টিগত উদ্যোগ। মানুষের ঐক্যবদ্ধ আন্তরিকতা, তাদের মধ্যে সমন্বয় এবং ঐক্যবদ্ধ ইচ্ছাশক্তি।
আমাদের জীবনযাপনে অন্য যে কোনো ক্ষেত্র থেকে ক্রীড়াঙ্গনের বিষয়টা পুরোপুরি ভিন্নধর্মী। এই চত্বরের আবেগ এবং স্পর্শকাতরতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ক্রীড়াঙ্গন পরিচালনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টিভঙ্গি মনমানসিকতা প্রাণের টান! ক্রীড়া সংগঠকরা ‘নিজের খেয়ে বলের ধরনের তৃপ্তি, আনন্দ এবং দায়বদ্ধতা উপভোগ করেন। খেলাধুলার প্রতি ভালোবাসা এবং অনুরাগ না থাকলে বছরের পর বছর ধরে এই ক্ষেত্রে লেগে থাকা সম্ভব নয়। মানসিক প্রশান্তি আর সম্মানবোধ তো অন্য ক্ষেত্রেও ঘাটতি নেই। এরপরও ক্রীড়াঙ্গনের সান্নিধ্য বড় বেশি প্রিয়। এই ক্ষেত্রে অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রমের আলাদা আবেদন আছে।
ক্রীড়াঙ্গনে সংস্কার। ক্রীড়া চর্চায় তো পরিবর্তনের প্রয়োজন সব সময় সময়ের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে। আর তাই এটি নতুন কিছু নয়। কথা হলো এখন কোনো ধরনের সংস্কারকে ক্রীড়াঙ্গনে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত ছিল। নীতিগতভাবে আমলাতন্ত্রের স্বার্থ জোট অনুযায়ী ক্রীড়াঙ্গনে পরিবর্তন সাধন কতটুকু সম্ভব। সংস্কার সাধন কার্যক্রম যদি কার্যকরী না হয়- তাহলে সেই সংস্কার নিয়ে ক্রীড়াঙ্গনে হৈ চৈ করে লাভ নেই। কারা কমিটি তৈরি করে দিয়েছে, কারা সেই প্রস্তাবিত কমিটির তালিকায় নাক গলানোর মাধ্যমে পরিবর্তন, নতুন সংযোজনে খেলা খেলছেন- এসব বিষয়ে সাধারণ মহলের কোনো উৎসাহ নেই। সাধারণ মানুষ দেখেছে গত সাড়ে আট মাস ধরে সার্চ কমিটির বিভিন্ন উদ্যোগ আর পদক্ষেপ। কে বা কারা দেরি করিয়ে দিয়েছে কাজ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে এসবই অর্থহীন বিষয়। অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক শাসনের অভাবে যা হয় এ ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। দেশের সার্বিক ক্রীড়াঙ্গনে এক ধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে জেলা শহরগুলোর ক্রীড়াঙ্গনে বিভিন্ন খেলার চর্চা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সংস্কারের নামে ক্রীড়াচর্চা কমে যাওয়া, বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি উদ্বেগজনক।
সময়ের সঙ্গে ছুটে চলা ক্রীড়াঙ্গন একবার পিছিয়ে পড়লে এটি আবার পুনরুদ্ধার করা বড় চ্যালেঞ্জ। সংস্কার তো খেলার স্বার্থে যদি খেলার চর্চা বাধাগ্রস্ত হয় তাহলে তো এই সংস্কার সাধনের উদ্যোগ ত্রুটিপূর্ণ বলতেই হবে। ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিলে তো হবে না। সংগঠকরা ক্রীড়াঙ্গনের চালিকাশক্তি। আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে যোগ্য সংগঠকের বড় অভাব। সেখানে যারা আছেন তাদের সবাইকে যদি অদ্ভুত চিন্তার মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা হয় তাহলে ক্রীড়াঙ্গন চলবে কীভাবে। কীভাবে চলবে ক্রীড়াঙ্গনের গাড়ি। ক্রীড়াঙ্গনের সাংগঠনিক কার্যক্রমে হঠাৎ করে তো বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। ক্রীড়াঙ্গনে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষের তো দরকার আছে। ‘কম্বলের সব লোম’ তুলে ফেলা তো সমস্যার সমাধান নয়। ৫৩টি জাতীয় খেলার ফেডারেশন এবং অ্যাসোসিয়েশন কার্যক্রম এখন কীভাবে চলছে। নতুন এডহক কমিটি তৈরি করে দেয়া হয়েছে। যাদের স্থান হয়েছে তারা কারা? ক্রীড়াঙ্গনে স্থান হবার আগে তারা কোথায় ছিলেন? কে এক সময় খেলোয়াড় ছিলেন আর কে কখনো খেলার মাঠে পা রাখেননি এসব তর্ক-বিতর্ক করে কোনো মানে নেই। সাংগঠনিক যোগ্যতা অন্য জিনিস- এ ক্ষেত্রে আগ্রহ, উদ্যোগ এবং নেতৃত্ব দেয়ার সক্ষমতা বড় বিষয়। বিভিন্ন খেলার কমিটিতে ব্যস্ত পদস্থ সরকারি আমলাদের সাধারণ সম্পাদক এবং প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে- এরা ফেডারেশনের কার্যক্রম পরিচালনায় কতটুকু সময় দিতে পারবেন।
দেশের ক্রীড়াঙ্গন বছরের পর বছর ভুগেছে কাজ করার মতো মানুষ এবং যোগ্য সংগঠনিক দক্ষতাসম্পন্ন মানুষের অভাবে। এই যে ফেডারেশনগুলো এডহক বডি দেয়া হলো এরা কতকাল দায়িত্ব পালন করবে আপাতত এটি বলা মুশকিল। সবকিছুই নির্ভর করছে আগামীতে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে বাঁক নেয় সেটির ওপর।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর যখন ক্রীড়াঙ্গনে সংস্কার নিয়ে কথা উঠেছে- আমরা বলেছি এ ক্ষেত্রে কাজ করার আগে বাস্তবতাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত। আমূল পরিবর্তনের কথা মাথায় আনলে সবকিছু ‘লেজে গোবর’ হয়ে যাবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রয়োজন আছে তবে সেটি ক্রীড়াচর্চা চালানোর পাশাপাশি হওয়া উচিত।
অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা প্রথম থেকেই বলেছি প্রতিটি খেলার ফেডারেশন এবং অ্যাসোসিয়েশনের নিজেদের তৈরি গঠনতন্ত্র নিয়ে কাজ করা উচিত। পুরোটা নয় গঠনতন্ত্রে কয়েকটি ধারা নতুনভাবে সংযোজন করে পাশাপাশি পুরনোগুলো ঐকমত্যের মাধ্যমে বাদ দিয়ে- নতুনভাবে নির্বাচন দেয়া হলেই ক্রীড়াঙ্গনের অনেক সমস্যারই আশু সমাধান সম্ভব! বুঝা উচিত ছিল ক্রীড়াঙ্গনে সংস্কার কতটুকু বাস্তবায়ন করা সম্ভব স্বল্প সময়ের মধ্যে। আর সেই পরিবর্তন হবে কতটুকু কার্যকরী এবং টেকসই। এখন তো মনে হচ্ছে পরিস্থিতি বেশ ঘোলাটে হয়ে পড়েছে। ক্রীড়াঙ্গনে সুস্থ চিন্তা ও জীবনবোধের জয় হোক। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে গুণগত পরিবর্তন আসুক।
ইকরামউজ্জমান: কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে