Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

ব্যবহারে সচেতনতা ছাড়া গ্যাস দুর্ঘটনা প্রতিরোধ সম্ভব না

Mamun–Or–Rashid

মামুন–অর–রশিদ

বুধবার, ৩ এপ্রিল ২০২৪

ত কয়েকদিন ধরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মৃত্যুর খবর চোখে পড়ছে। সম্প্রতি গাজীপুরে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। একজন-দুজন করে বাড়তে বাড়তে এক সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে এখন ১৭ জনে দাঁড়িয়েছে। ভাবা যায়, সেদিনের সন্ধ্যা এই মানুষগুলোর জীবনে কি এক বিভীষিকা বয়ে এনেছিল। একজনের অসচেতনতার কারণে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দগ্ধ হতে হয়েছে ৩০ জনকে। এর মধ্যে ১৭ জনকেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হয়েছে।

এই ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী নাজমা বেগম, যার স্বামী আব্দুল কুদ্দুস এই অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হন। তার বর্ণনায় জানা যায়, কালিয়াকৈর উপজেলার তেলিরচালা এলাকায় শফিক খান তার স্ত্রীর সঙ্গে গ্যাস সিলিন্ডার কেনা নিয়ে ঝগড়া করছিলেন। পরে শফিক খান সিলিন্ডার কিনে আনার পর রাগ করে মাটিতে ফেলে দিয়ে স্ত্রীকে বলেন, ‘এই নে সিলিন্ডার এনে দিলাম’। তখনই সিলিন্ডারের ভালব খুলে গ্যাস বের হতে থাকে। এ সময় পাশেই রান্না করছিলেন একজন। এভাবে চার পাঁচ মিনিট সিলিন্ডার থেকে গ্যাস বের হওয়ার পর পাশের চুলার আগুনের সংস্পর্শে এসে সিলিন্ডারটি বিস্ফোরিত হয়।

নাজমা বেগমের ভাষ্য অনুযায়ী, সিলিন্ডারের গ্যাস বের হওয়ার সময় তিনি নিজেও রান্না করছিলেন; কিন্তু তিনি তার চুলাটি পানি দিয়ে দ্রুত বন্ধ করেছিলেন। নাজমা বেগম পাশের মহিলাকে চুলা বন্ধ করতে বলেছিলেন কিন্তু তিনি সেই কথায় কর্ণপাত করেননি। এতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া গ্যাসে আগুন লেগে যায়। এই ঘটনায় অন্তত ৩৫ জন দগ্ধ হন। তাদের মধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ৩০ জনকে শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি করা হয়।

পুরো ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সিলিন্ডারটি মাটিতে আঘাত করে ফেলা ঠিক হয়নি। কারণ সিলিন্ডারের ভেতরে থাকা তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) চাপ/প্রেশার দিয়ে প্রবেশ করানো হয়। ফলে কোনো কারণে সিলিন্ডারের ভালব খুলে গেলে দ্রুত গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে। এই গ্যাস বাতাসের সংস্পর্শে এলেই অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটতে পারে।

দ্বিতীয় বিষয়টি হলো এলপিজির প্রধান উপাদান প্রপেন এবং বিউটেন বাতাসের তুলনায় যথেষ্ট ভারী। ফলে কোনো কারণে গ্যাস বের হলে সেটি নিচের দিকে জমা হয়। প্রাকৃতিক গ্যাস বা মিথেনের মতো এই গ্যাস উড়ে যায় না। সংগত কারণে জানালা বা দরজা দিয়ে এলপিজি বের হয়ে যায় না বরং সেটি দীর্ঘ সময় একই জায়গায় থাকে। এখানেও ৫-৬ মিনিট গ্যাস বের হয়েছে। এভাবে আগুনের সংস্পের্শে এসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

একটু সচেতন হলেই এই দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল। এলপিজি যখন বের হচ্ছিল তখন ভেজা কাপড় দিয়ে সিলিন্ডারটি মুড়ে দিলেই আর গ্যাস বের হতো না। এমনকি সিলিন্ডারে যদি কোনো কারণে আগুন লেগে যায়, তাও মোটা ভেজা কাপড় দিয়ে সেটিকে পেঁচিয়ে ধরলে আগুন নিভে যায়। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে সিলিন্ডার থেকে গ্যাস বের হওয়ার পর পাশের চুলাটি যদি নিভিয়ে ফেলা যেত, তাহলেও এই আগুনের ঘটনা ঘটতো না।

ইদানীং প্রায়ই এমন দুর্ঘটনার খবর শোনা যায়। মানুষ মৃত্যুর মুখে পড়ে। কিন্তু সব ঘটনাই অসচেতন ব্যবহারের ফল। সিলিন্ডারকে একটি বোমা বিবেচনা করে যদি এর রক্ষণাবেক্ষণ করা যায় তাহলেই মানুষ এমন দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করতে পারবেন। অন্যথায় সেটি সম্ভব নয়।

তবে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে মানুষকে সচেতন করে তুলতে সরকারি এবং ব্যবসায়ীদের তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। এ কারণে যে গ্রাহক সিলিন্ডার ব্যবহার করছেন তিনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জানেন না এই সিলিন্ডার তার জীবন কেড়ে নিতে পারে।

এখন প্রত্যেক উপজেলায় ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স সেন্টার রয়েছে। আগুন লাগলে এরা নিভাতে যায় মানুষকে উদ্ধার করে; কিন্তু আগুন লাগার আগেই যদি প্রতিরোধের জন্য এদের নিয়ে প্রচার চালানো যায়, তাহলে মানুষ সচেতন হয়ে উঠবে।

যেসব গ্রাহক ঘরের মধ্যে সিলিন্ডার ব্যবহার করেন, তাদের উচিত সিলিন্ডারটি এমন জায়গায় রাখা, যাতে কোনো কারণে গ্যাস বের হলেও তা জমে না থেকে বের হয়ে যেতে পারে। প্রতিদিন সকালে চুলা জ্বালানোর আগে অনন্ত ১৫ মিনিট জানালা-দরজা খুলে রেখে বাতাস প্রবাহের ব্যবস্থা করা। তবে এক্ষেত্রে একটি বিষয় মাথায় রাখা উচিত। সেটি হলো জানালা দরজা খোলার আগে ঘরের ইলেক্ট্রিক সুইচ অন না করা। কারণ অনেক সময় ইলেক্ট্রিক সুইচ অন করার সময় স্পার্ক হয়। এতেও আগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে।

দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে সিলিন্ডারের ওপরের ভালব নির্দিষ্ট সময় অন্তর পরিবর্তন করা। আমাদের দেশে এটি করা হয় না। একবার চুলার সঙ্গে যে ভালব কেনা হয়, সেটি দিয়েই চালিয়ে দিতে চান। তৃতীয়ত, চুলা এবং সিলিন্ডারের মধ্যের যে প্লাস্টিকের পাইপ ব্যবহার করা হয়, তা নিয়মিত পরীক্ষা করা। যাতে কোথাও লিকেজ হয়ে গ্যাস বের হচ্ছে কি না, তা বোঝা যায়। চতুর্থ বিষয়টি হচ্ছে এই পাইপ লাইনটিও নির্দিষ্ট সময় অন্তর পরিবর্তন করা।

অন্যদিকে এখন রাজধানী ঢাকার মতো বড় শহরগুলোতে রেটিকুলেটেড এলপিজি ব্যবহার হয়ে থাকে। অর্থাৎ বাড়ির নিচে কোথাও এক বা একাধিক সিলিন্ডারে এলপিজি রাখা হয়। এরপর পাইপ লাইন দিয়ে তা রান্নাঘরের সঙ্গে সংযুক্ত করা থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ডে সিলিন্ডারগুলো থাকে। এখানে কোনো কারণে লিকেজ হলে গ্যাস বাইরে বের হতে পারে না। আন্ডারগ্রাউন্ডে একই সঙ্গে আবার গাড়িও থাকে। গাড়ি স্টার্ট দেয়ার সময় স্পার্ক হলে জমে থাকা গ্যাসের সংস্পর্শে এলে বাড়িটি বিধ্বস্তও হতে পারে। ফলে সিলিন্ডার এমন জায়গায় রাখতে হবে, যেখানে লিকেজের ঘটনা ঘটলেও গ্যাস না জমে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

ইদানীং আরও একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সেটি হলো রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার অটোগ্যাস স্টেশন থেকে ভর্তি করা হচ্ছে। গ্রাহক নিজে যেমন করছেন আবার একশ্রেণির অসাধু চক্রও এই কাজ করছেন। এখানে সমস্যা হচ্ছে একটি সিলিন্ডার যখন কারখানায় নিয়ে ভর্তি করা হয়, তখন সঠিক চাপে এটি ভর্তি করা হয়। একই সঙ্গে সিলিন্ডারটি পরীক্ষা করা হয়; কিন্তু অটোগ্যাস স্টেশনে এগুলো দেখার কোনো সুযোগ নেই। এখন গাড়ির জ্বালানি সরবরাহ করার জন্য উপজেলা পর্যায়ে অনেকে অটোগ্যাস স্টেশন স্থাপন করেছেন। ফলে কিছুটা কমে পাওয়ার জন্য এভাবে সিলিন্ডারের সঙ্গে আপনি নিজের মৃত্যুকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন কি না, সেটি মাথায় রাখতে হবে।

এর বাইরেও সিলিন্ডার নিয়ে অন্য ব্যবসাটি হচ্ছে অনেক সময় ৩৫ কেজির একটি সিলিন্ডার থেকে গ্যাস বের করে তিনটি সাড়ে ১২ কেজির সিলিন্ডার ভর্তি করা হয়। এতে বিক্রেতার কিছুটা মুনাফা হলেও মানুষের জীবন ঝুঁকিতে পড়ে।

ফলে মানুষ যতদিন গ্যাস ব্যবহারে পূর্ণ সচেতন না হবে, তত দিন এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই রান্নার গ্যাস হিসেবে এলপিজি ব্যবহার হয়; কিন্তু কোনো দেশে এমন নিত্যদিন দুর্ঘটনা ঘটে না। আমাদের দেশেও বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্ত এমনকি এসব নিয়ন্ত্রণ এবং মানুষকে সচেতন করে তোলার জন্য বিস্ফোরক পরিদপ্তর নামের একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যাদের দুর্ঘটনার পর কেবল একটি তদন্ত করতে দেখা যায়। যেখানে জীবনই বিপন্ন, সেখানে এই তদন্ত দিয়ে আসলে কি হয়! এর চাইতে প্রতিষ্ঠানটি যদি মানুষের জীবন রক্ষায় মানুষকে সচেতন করার দায়িত্বের কিছুটাও পালন করে, তাহলেই বরং কিছু উপকার হয়।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ